আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মাস্টার ও শিক্ষক শব্দের ব্যবচ্ছেদ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১০-৩১ ২১:২৯:৪৭


|| মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন ||
‘মাস্টার’ একটি ইংরেজি শব্দ। আভিধানিক অর্থে শব্দটি বহুবিধ ব্যঞ্জণার অধিকারী। বাংলায় পূর্বে শব্দটিকে মাষ্টার লেখা হতো। শব্দটি বিদেশি হওয়ায় নতুন বানান রীতি অনুযায়ী 'ষ' এর স্থানে 'স' দিয়ে লেখার প্রচলন হয়েছে।
বাংলা অভিধান মোতাবেক 'মাস্টার' শব্দের কিছু প্রতিশব্দ দেখে নেয়া যাক--মনিব, গুরু, প্রভু, মালিক, কর্তা, নিয়ন্ত্রণকারী, শিক্ষক, অধিপতি, সর্দার, শাসক, অধ্যক্ষ, বাবু, স্বামী, নায়ক, রাজা, হুকুমদাতা, ভর্তা, পণ্ডিত, পরিচালক, হজরত, অধিশ্বর, পতি, সরকার, ঠাকুর, সুনিপুণ ব্যক্তি, পূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি, পূর্ণ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, ওস্তাদ ব্যক্তি, বিশারদ ব্যক্তি, গোস্বামী, পোতাধ্যক্ষ, প্রধান, নিয়ন্ত্রক, মুখ্য, নিয়োগকর্তা, অধিনায়ক ইত্যাদি।

এবার ইংরেজি 'টিচার' শব্দের অর্থগুলোও দেখে নিই--
শিক্ষক, গুরু, অধ্যাপক, শিক্ষাদাতা, ওস্তাদ, মাস্টার, শিক্ষয়িতা, শাস্তা, শাসিত, পাঠক, উপাধ্যায়, উপদেষ্টা, দীক্ষক, স্কুলমাস্টার, ভট্ট, ঠাকুর, আচার্য ইত্যাদি।

বিভিন্ন কল-কারখানায় 'মাস্টার অপারেটর', 'কাটিং মাস্টার' ইত্যাদি নামে এবং লঞ্চ-ইস্টিমার-জাহাজে 'মাস্টার' নামে কিছু দায়িত্বের নাম প্রচলিত আছে। এসব ক্ষেত্রে শব্দটি কোনো সংঘর্ষ তৈরি করছে না। শুধু শিক্ষকতার স্থলে শব্দটি এক অভিনব দ্বন্দ্বের উৎপাৎ  উৎপাদন করেছে। কাজের অর্থে কোনো পেশাই তুচ্ছ নয়, ছোট নয়। তবে শিক্ষিতজনের কিছু সূক্ষ্ম রস-বিরস বোধ থাকে। আমরা সেদিকটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে চাই। যৌক্তিকতা অনুসন্ধান করতে চাই।

'আনন্দ আশ্রম' নামক কালজয়ী সিনেমাতে উত্তম কুমার এক জমিদারের পুত্র এবং শর্মিলা ঠাকুর এক 'অংকের মাষ্টার মশাই' এর কন্যার ভূমিকায় অভিনয় করেন। শহর থেকে ডাক্তারি পড়া শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে উত্তম কুমার নৌকাতে উঠলে শর্মিলা ঠাকুরও বাড়ি ফেরার পথে নৌকায় উঠতে যাচ্ছিলো। কিন্তু সে উত্তম কুমারকে দেখে একই নৌকায় উঠতে সংকোচ করছিলো। উত্তম কুমার চিনতে পারে নি। কিন্তু শর্মিলা ঠাকুর ঠিকই চিনেছিলো, এ হচ্ছে তার ছোট্টবেলার পড়ার সাথী। নৌকায় বসে পরস্পর পরিচয় হলে উত্তম কুমার বললো, তার মানে তুমি আমাদের অংকের মাস্টার মশাইয়ের মেয়ে। তাহলে নৌকায় উঠতে সংকোচ করছিলে কেন? এভাবেই তাদের পরিণয়ের গল্প এগুতে থাকে।

শর্মিলা ঠাকুরের বাপ এক সময় খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে। একটা অবলা খ্রিস্টান মহিলাকে বিয়ে করে সমাজে সম্মান নিয়ে টিকে থাকতে পারছিলো না বলে। কিন্তু তার দেশীয় সংস্কৃতি ও লোকাচারের প্রতি একই রকম ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ বজায় থাকে। মেয়ে শর্মিলাকে মন্দিরে চরণামৃত আনতে পাঠালে পুরোহিত চিনতে পেরে পুজো নষ্ট করার অভিযোগ আনে শর্মিলার বিরুদ্ধে। তখন সংস্কারমুক্ত শিক্ষিত ডাক্তার উত্তম কুমার এগিয়ে এসে চরণামৃত দেবার ব্যবস্থা করে। তারপর কাহিনী জটিল হয়ে চরমে উত্তীর্ণ হয়। জীবনের অপার আনন্দের মহিমা কীর্তণ করে কাহিনীটি নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে এগুতে থাকে।
''তিনটি মন্ত্র নিয়ে যাদের জীবন,
সত্যম শিবম সুন্দরম;
দুঃখের পৃথিবীটা তাদের কাছে
এক আনন্দ আশ্রম।"

এটিই 'আনন্দ আশ্রম' সিনেমার মূল উপজীব্য।

কাহিনীটির উল্লেখ করলাম মূলত 'মাস্টার' শব্দের গাম্ভীর্য বুঝাতে। শব্দটি বৃটিশরা আসার পরে প্রচলিত হয়। এর আগে পণ্ডিত, গুরু, ওস্তাদজি, আচার্য, ঠাকুর, হুজুর, হযরত ইত্যাদি শব্দ দিয়েই শিক্ষককে নির্দেশ করা হতো। টোল কিংবা গুরুগৃহে ছাত্রকে পরিচর্যা করার ধরন দেখে ইংরেজরা এটাকে মাস্টারের কাজ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। এবং বাংলায় আগমণ ঘটলো মাস্টার শব্দটির। সর্দারি, মস্তানি, খবরদারি, তদারকি ইত্যাদি শব্দের মত 'মাস্টার' শব্দের সাথে 'ই' প্রত্যয় যোগ করে শিক্ষকতার কাজকেও মাস্টারি বলে সংজ্ঞায়িত করা হলো। বাংলায় এভাবে প্রচুর বিদেশী শব্দের আগমণ ঘটেছে। ফার্সি ভাষা থেকেও প্রচুর শব্দ ঢুকেছে বাংলায়। সবচেয়ে বেশি এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে।

শিক্ষক শব্দের প্রচলন হয়েছে বহু পরে। শিক্ষা দেন যিনি বা দীক্ষা দেন যিনি। দীক্ষা দেন গুরু, শিক্ষা দেন শিক্ষক। সে অর্থে দীক্ষাদানকারী হবেন দীক্ষক। গুরু বা মাস্টার শিষ্য তথা ছাত্রকে শিক্ষা দেন। ভারতীয় সমাজে খাড়ার উপর খুচরা দরে শিক্ষা দেবার প্রথা চালু হয় নি ইংরেজরা আসার পূর্বে। ইংরেজরা এসে এখানকার শিক্ষাদানকে মাস্টারের মত দেখেছে। তাই প্রভু বা মালিক অর্থে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়, সেটিই তারা গুরুর অর্থে ব্যবহার করলো। পরবর্তীতে আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে শিক্ষাদান কাজটি গুরুর বদলে বেতনভুক্ত পেশাদারিত্বে রূপ নেয়। একটা নির্দিষ্ট বেতনের চাকরি করেন শিক্ষক। তিনি শুধু শিক্ষা দেন, বাকি সব দায়িত্ব শিক্ষার্থীর অভিভাবকের। অর্থাৎ গুরুর অভিভাবকত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে শুধু শিক্ষকে রূপান্তর করা হলো। ফলে শিক্ষকতা একটি পেশায় পরিণত হলো। ব্রত বা অধ্যাত্ম বা আচার্য মাহাত্ম্য থেকে বিযুক্ত হয়ে একটি উন্মুক্ত পেশায় পরিণত হলো।

এ পর্যন্ত আলোচনায় মাস্টার শব্দটি যে শিক্ষক শব্দের চেয়ে অধিক মর্যাদার সেটি স্পষ্ট। কিন্তু মাস্টার শব্দের একটি অন্তর্গত নেতিবাচকতা রয়েছে যেটি আলোচনার দাবী রাখে। এই ব্যাপারটি কেউ বোঝে না। তথাপি একজন শিক্ষক মাস্টার অভিধা পেলে ক্ষুব্ধ হয়। এই ক্ষুব্ধ হবার কারন সে জানে না। অথচ না জেনেই ক্ষুব্ধ হয়। মাস্টার বলে তো তাকে বরং সম্মানই দেখানো হচ্ছে। তো? মাস্টার সম্বোধন শুনে নিজেকে অসহায় মনে করে কেন? নিজেকে গুরু ভাবতে পারা কি সম্মানের নয়? কিংবা গুরু হতে পারাটা কি লজ্জার? তাহলে গুরুর সমার্থক মাস্টার হয়ে শিক্ষক লজ্জিত হয় কেন? কাউকে হজরত বললেও তো এমন হয় না।

একটা কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মাস্টার শব্দের সাথে প্রভু বা মালিক শব্দের যোগ বেশি। ভারতবর্ষের গুরুর কাজটি প্রভু বা অধিপতির মত প্রায়। বাড়ির মালিকও মাস্টার, গুরুও মাস্টার। এখান থেকেই মাস্টার আর গুরুর অভিধাটি আলাদা হতে শুরু করে। পণ্ডিত থেকে শিক্ষক হতে বহু সময় লেগেছে। তবে শিক্ষকতা ব্যপকভাবে চাকুরি হিসেবে চালু হলে পণ্ডিতের স্থলে শিক্ষক শব্দটির প্রচলন হয়। বৃটিশরা প্রভু। তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ থেকে 'মাস্টার' শব্দটিও ঘৃণিত হতে শুরু করে। পণ্ডিত শব্দটি তিরষ্কারার্থে ব্যবহার শুরু হয় সম্ভবত মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে আসতে শুরু হবার পর। কেউ একটু বেশি বুঝলেই 'কি পণ্ডিতি করো?' এবং শিক্ষককের চাকরি করা লোকজনকে ব্যঙ্গার্থে 'কি মাস্টার কেমন আছো?', 'কই যাও?' ধরনের প্রশ্ন করা হতে থাকে।

দেখা যাচ্ছে, 'মাস্টার' শব্দকে তুচ্ছার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে কলোনিয়াল শাসনকে অপছন্দ করা থেকে। অর্থাৎ স্বাধীন হতে চাওয়ার আকাঙ্খা থেকে 'গুরু'র প্রতিশব্দ 'মাস্টার' বিষর্জন দিয়ে নিরেট চাকরিজীবি পরিচায়ক 'শিক্ষক' হওয়াতেই স্বস্তি। আমরা 'শিক্ষক' শব্দটিকে আমাদের গুরুমুখী শিক্ষা বিস্তারের পদ্ধতির সাথে অন্তর্লীন করে দেখতে পারি। অর্থাৎ একালের গুরুর নাম শিক্ষক। সেদিক থেকে 'শিক্ষকতা পেশা নয়, ব্রত' এমন কথাকেও তাৎপর্যপূর্ণ করে দেখা যেতে পারে। ঔপনিবেশিকতাকে হটিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের জ্বলন্ত রাজপথ থেকে 'মাস্টার' শব্দটিকে বিষর্জন দেয়া হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের চর্চা-অভ্যাসের ফলে আমাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থেকে শব্দটি ব্যবহারের প্রবণতা নিঃশেষ হয়ে যায় নি।

এখনো শহরে ও গ্রামে অবচেতনে শিক্ষিতজন এই শব্দটি ব্যবহার করে। এটি বড় কোনো ত্রুটি নয় অবশ্যই। তবে শিক্ষকতা পেশাকে যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের আকর বানানো হচ্ছে আজকাল, অচিরেই হয়তো এই শব্দটিও ব্যঙ্গ-তিরষ্কারের সমার্থক হয়ে উঠবে। সেদিন 'শিক্ষকতা' শব্দের জায়গায় নতুন কোন্ শব্দের প্রচলন হবে, সেটি এক কৌতূহলের বিষয়। কারন সমাজ যখনি কোনো শব্দে বিব্রত বোধ করে, তখনি সেই শব্দটিকে ব্যঙ্গ করা শুরু করে। আর তখন নতুন শব্দের আমদানি হতে থাকে। এটি সভ্যতার নিরব প্রতিবাদ।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন