আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

শিক্ষার প্রকারভেদে শিক্ষার্থী, পরিবার ও শিক্ষকের দায়িত্ববোধ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১১-১৪ ১২:২৬:১৫



সুজয় চৌধুরী :: শিক্ষা এমন একটি শব্দ যার কোন আদি অন্ত নেই। শিক্ষা শব্দটি জীবনব্যাপী পন্থা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তাই শিক্ষা লাভের ধরণকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমন : আনুষ্ঠানিক, যা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে দেয়া হয়। অনানুষ্ঠানিক, যা সমাজ, পরিবার পরিজন, গুরুজন, শিক্ষক, বিশিষ্ট ব্যক্তি বা অন্য যেকোন ভাবে শিখছে। উপানুষ্ঠানিক, যা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা দেয়া হয়ে থাকে। এই জগতের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা।

তাইতো কবি সুনির্মল বসু লিখছেন,

“বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর
আমি সবার ছাত্র,
নানানভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র”

এই চার পঙ্কক্তিতেই শিক্ষার ব্যাপকতা নিহিত আছে। শিক্ষা হলো এমন একটি অনুশীলন যা সমূহ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। শিক্ষা শব্দটি সংস্কৃত “শাস” ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ উপদেশ দান করা। অন্যদিকে Education শব্দটি ল্যাটিন Educare বা Educatum থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ To lead out অর্থাৎ, অন্তরের সুপ্ত বাসনাকে প্রকাশ করা বা বিকশিত করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “শিক্ষা হলো তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তুলে”। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, শিক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা অন্তর্নিহিত গুনের এমনই এক বিকাশ যা সমাজের জন্য শুভকর্মী গড়ে তুলে। এই শুভকর্মী গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম।

শিক্ষকই একমাত্র ব্যাক্তি যিনি শিক্ষার্থীর সুপ্ত বাসনাকে জাগিয়ে তুলতে পারেন এবং সূক্ষ্মভাবে দেখিয়ে দিতে পারেন শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত শক্তির। তাইতো Alexendra K Tranfor “The best teacher are those who show you where to look, but don’t tell you where to see.” এর মর্মার্থ হলো, শিক্ষার্থীকে তার শক্তি দেখিয়ে দেয়া। এর জন্যই বিদ্যালয়কে সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা হয়। একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষকই নন পাশাপাশি তিনি একজন প্রশিক্ষকও কারণ পাঠ্যবইয়ের বিষয় শিখানোর সময় তিনি একজন শিক্ষক পাশাপাশি যখন মননশীলতা, বিনয়, ভদ্রতা, সততা, দক্ষতা, নৈতিকতা, ন্যায়, শৃঙ্খলা, সময়জ্ঞান, শিষ্টাচার, মূল্যবোধ, ধৈর্য্য, কষ্টসহিষ্ণুতা, পরমতসহিষ্ণুতা, দেশপ্রেম অপরাপর মানুষ হওয়ার শিক্ষা এইসব বিষয়ে জ্ঞানদান করেন, তখন তিনি প্রশিক্ষক। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পাঠ্য বইয়ের বাইরেও একজন শিক্ষকের অনেক কিছু দেয়ার আছে।

এজন্যই শিক্ষকে বলা হয় সবল শক্তিশালী জাতি গঠনের কারিগর। সুস্থ সবল জাতি গঠনের আরেক সূতিকাগার হলো পরিবার কারণ পরিবার হলো একজন শিক্ষার্থীর প্রথম পাঠশালা। এই পাঠশালাতেই প্রথম পাঠ শুরু হয় কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই পরিবারের পিতা-মাতা বা অন্যান্য অভিভাবকরা পড়াশুনার ক্ষেত্রে শিশুদের মনে এক ধরণের প্রতিযোগী ভাব গড়ে তুলেন, যেমন- অমুক সাহেবের ছেলে এ+ পেয়েছে, তুমি পাওনা কেনো, তুমার জন্য কি কম খরচ করি” এইসব আজেবাজে কথা, যা বাচ্চাদেরকে খুবই হীনমন্যতায় ভোগায়, পরবর্তীতে এই হীনমন্যতা তার বন্ধুদের প্রতি হিংসায় রূপান্তর হয় এবং পড়াশুনার ক্ষেত্রে একটি যুদ্ধং দেহী ভাবের উদ্রেক হয়, যা সমাজ বা রাষ্ট্র অপরাপর শিক্ষার্থীর জন্যও মঙ্গলজনক নয়। এই বিষয়ে জাপানের শিক্ষাপদ্ধতি প্রণিধানযোগ্য। আলফি কন’ এই ধরণের শিক্ষা পদ্ধতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। তার মতে “ছাত্রদের যোগ্যতা নির্ধারণে প্রতিযোগিতা

প্রকৃতপক্ষে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং প্রায়শই পরাজয়ের দিকে ধাবিত করে।” বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রিচার্ড লেয়ার্ড বলেন, ” প্রতিযোগিতার ফলে ছাত্ররা একধরণের চাপ অনুভব করে। তারা মনে করে যে, তাদের জীবনের মুল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অন্যদের তুলনায় সেরা হওয়া। আমাদের দেশে হয়তো এই সিস্টেম চালু হতে আরও কয়েক দশক লাগতে পারে তবুও শিক্ষক ও পরিবার পরিজনদের উচিৎ হবে শিক্ষার্থীকে শ্রেষ্ঠ হওয়া থেকে বিরত রেখে, উত্তম হওয়ার চেষ্টা করানো কারণ উত্তম হতে হলে নিজের সাথে নিজের প্রতিযোগিতা করতে হয়, আর শ্রেষ্ঠ হতে হলে অন্যের প্রতিযোগী মনোভাব নিয়ে অন্যকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হয়। তাই অন্যকে না ডিঙ্গিয়ে নিজেকে নিজে ডিঙ্গিয়ে যাওয়াটাই শ্রেয়।

পরিশেষে বলতে হয়, শিক্ষক ও পরিবার যেরূপ মূল্যবোধ সম্পন্ন যোগ্য নাগরিক গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থাও একজন সুনাগরিক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। রাষ্ট্রের উচিৎ হবে শিক্ষার অধিকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির স্থলে সংশোধনের মাধ্যমে মৌলিক অধিকারে স্থানান্তর করা কারণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে দ্বিতীয় ভাগ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’র ১৭ নং অনুচ্ছেদে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে কিন্তু সংবিধানের তৃতীয় ভাগ মৌলিক অধিকারে শিক্ষার অধিকারকে যুক্ত করা হয়নি বিধায় সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা শিক্ষার অধিকার ক্রমেই দুরে সরে যাচ্ছে, যদিও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সংবিধানের ৮৬ তম সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে যুক্ত করেছে।

এছাড়াও ২১(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১৩৫ তম রাষ্ট্র হিসাবে ভারত ভারত শিশু শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে যা ৪-১৪ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা। এছাড়াও আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি অনুযায়ী শিক্ষা একটি অধিকার। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু সনদেও শিক্ষা অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। এছাড়াও ১৯৯০ সালে শিক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক অধিবেশনে সর্বশিক্ষা অভিযানের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

পরিশেষে একটি কথাই বলবো, শিক্ষার্থীদেরকে তাদের অন্তর্নিহিত শক্তির কথা জানিয়ে দিন। একতরফা ভাবে আগামি প্রজন্মকে দোষলেই হবে না কারণ আমাদেরকে মনে রাখতে হবে আমাদের পরিচালিত পথেই আগামি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, আমাদের প্রদর্শিত পথেই তারা হাঁটছে তাই শিক্ষক, পরিবার পরিজন, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর বহুলাংশে নির্ভর করে আগামী প্রজন্ম কিভাবে আমাদের এই দেশকে পরিচালিত করবে।

লেখক : স্বর্ণকান্তি দাস চৌধুরী (সুজয়), অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, প্রধান নির্বাহী আইনসেবা : লিগ্যাল সাপোর্ট সেন্টার সোসাইটি

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন