Sylhet View 24 PRINT

সাংবাদিক মনসুর ও কিছু স্মৃতিকথা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১১-২০ ২০:১০:৩৫

আসিফ ইকবাল ইরন :: মনসুর চাচা। সম্পর্কে আমি তার ভাতিজা। বয়সে বড় ও বড় ভাইয়ের ক্লাসমেট বলে ‘মনসুর চাচা’ বলে সম্বোধন করতাম। স্কুল ও কলেজ লাইফে আমার ভাইয়ের সাথে তার ছিলো প্রবল বন্ধুত্ব।  সেই বন্ধুত্ব খাতিরে আমাদের বাড়িতে তার ছিল নিয়মিত আসা-যাওয়া। ব্যবহারে খুব ভদ্র অমায়িক ছিলেন। ভাইয়ের সাথে দেখা করতে বাড়িতে এলে সোজা মাথা নিচু করে ভাইয়ের রুমে চলে যেতেন। ওই সময় দেখা হলে বলতেন, ‘চাচা ভালানি?’। আজও সে ডাক কানে প্রতিধ্বনি হয়। সেই মানুষটি আজ প্রয়াত! ভাবতেই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে স্থবির হয়ে গিয়েছিলাম। এমন মেধাবী একটা মানুষের অকাল মৃত্যু মেনে নেওয়াটা সত্যি কষ্টের। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে সেই রাতটি ঘুমাতে পারিনি। বারবার তার চেহারাটা ভেসে উঠছিল।

তার চেহারায় একটা দুঃখী ভাব ছিলো। হাসলে মনে হতো জোর করে হাসার চেষ্টা করছেন। সেই দুঃখী চেহারাটা বারবার ভেসে উঠছিল দু’চোখে।

আমার স্মৃতিশক্তি প্রতারণা না করলে সম্ভবত উত্তর কুশিয়ারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২০০৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন মনসুর আলী। সম্ভবত এই ব্যাচের সবচেয়ে বেশী মার্কস পেয়ে এসএসসিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। সেই মেধার সাক্ষর রেখেছিলেন এইচএসসিতেও। এইচএসসি পরে ভার্সিটির পরীক্ষায় ও কোনো রকম কোচিং ছাড়াই দেশের অন্যতম সবোর্চ্চ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগে সুযোগ পেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হবার পরও ছুটিতে এলে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন।

২০০৭-০৮ এর দিকে আমার কবিতা লেখার ঝোক চাপলো মাথায়। প্রচুর কবিতার বই পড়তাম ও অগোছালোভাবে লিখতাম। এর আগে থেকে মনসুর চাচা কবিতা লিখতেন। তার অনেক কবিতা তখন নবীন কন্ঠ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। দারুণ সব কবিতা। চিত্র, রূপকল্প, শব্দের মাধুর্যযুক্ত ছিল সেই কবিতাগুলো। আমার কবিতা লেখার এই আগ্রহ দেখে তিনি পরামর্শ দিলেন কবি হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল হাসানের কবিতার বই পড়তে। আরো বললেন, ‘লেখক হবার আগে ভালো পাঠক হতে হবে এবং ভালো বই পড়তে হবে।’ তখন কবি হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল হাসান এই নামগুলোর সাথে পরিচিত হলাম। তার কথাতে এই কবিদের বইগুলো কিনে পড়তে শুরু করি। এই কবিদের বইগুলো আজও আমার নিত্যদিনের সঙ্গি। অথচ যে মানুষের কথায় এই কবিদের সাথে পরিচিত সেই মানুষটা আজ আমাদের কাছে নেই। জ্যোৎস্না হয়ে ঝলমল করছেন আকাশে।

গত কয়েক বছর তার সাথে দেখা হয়নি। বিশেষ করে তার বন্ধু ও আমার ভাই ২০০৯ সালে ইংল্যান্ড যাওয়ার পর খুব কম দেখা হতো। মাঝেমধ্যে এলাকার বাজারে দেখা হতো। শেষ কবে দেখেছি স্বরণ করতে পারছি না। বিশেষ করে এলাকায় তিনি খুব কম মানুষের সাথে তার চলাফেরা ছিল। তার মধ্যে একটা একাকীত্ব বা নিভৃতচারী ভাব ছিল। বাড়িতে এলেও সেই সময়টা আড্ডা মেরে নষ্ট না করে বই পড়তেন। প্রচুর বই পড়ার নেশা ছিল তার মধ্যে। স্কুল লাইফ থেকে মনে হয় পাঠ্যবইয়ের বাইরে গিয়ে বই পড়ার একটা শখ ছিল তার মধ্যে। ইন্টারমিডিয়েট লেভেলে পড়াকালীন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ পড়েছেন। এমন ঢাউস টাইপের বই দেখে আমি ভাবতাম, এত্ত বড় বই আবার কেউ পড়ে!

সেই সময় আমার ভাই তার কাছে থেকে ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসটা নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। আমিও মাঝেমধ্যে সেই বই নড়েচড়ে দেখতাম। কয়েকশ’ পৃষ্ঠা আমিও পড়েছি।  একেক খন্ড প্রায় ১৬০০ পৃষ্ঠার মতো ছিল। যখনই রাস্তাঘাটে দেখা হতো তার হাতে বই থাকতো। এই বইয়ের নেশা সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় তাকে নিয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াকালীন তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন স্থানীয় সংবাদপত্রে সংবাদ লিখতে। এতে নাকি কবিতা লেখার অভ্যাস জিইয়ে থাকে। না হলে একসময় কবিতা বা লেখালেখি নিজের কাছে থাকে হারিয়ে যাবে। তখন সেই উপদেশ পাত্তা দেয়নি। আজ তার উপদেশ না খেয়ালের বশে আমিও সংবাদ জগতে কাজ করছি।

মনসুর চাচা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিলেন অনিয়মিত। তাই তার যোগাযোগ নেই বললে চলে। হয়তো ওই প্রজন্মের অনেকে মনসুর নামের ফেঞ্চুগঞ্জের একজন উজ্জ্বল তারা  ঢাকায় সংবাদ জগতে কর্মরত ছিলেন সেটা অনেকের আজানা ছিল। তার অকাল মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সেটা আজ সমস্ত ফেঞ্চুগঞ্জবাসী জানলো। কিন্তু তিনি সেই জানানটা দিয়ে গেলেন আমাদের শূন্য করে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়ে। তাই বলতে হয়-
‘কবরে শুয়ে আছে মনসুরের নিথর দেহ
ফেঞ্চুগঞ্জে নেমেছে অদ্ভুত এক আধার’।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.