আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বাংলাদেশ: বিশ্বের বিস্ময়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১২-১৬ ১২:৪৩:৩৬

প্রফেসর ড. জহিরুল হক শাকিল :: বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তি বা অর্ধশতক থেকে আমরা মাত্র ১ বছর দূরে। দু’শ বছরের বৃটিশ শাসন-শোষন, ২৫ বছরের পাকিস্তনী শোষন ও নির্যাতন, ১৯৭০ এ পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও ১৯৭১ সালের ৯ মাসের যুদ্ধ ও ব্যাপক সহিংসতার পর একটি পঙ্গু অর্থনীতি ও টালমাটাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে স্বাধীনতা যে এখানে মিরাকল কিছু দিতে পারে তা কেউই প্রত্যাশা করেননা।

বঙ্গবন্ধু’র ৬ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে এ অঞ্চলটি স্বাধীনতার দিকে যে অগ্রসর হচ্ছিল তা সকলের কাছে ছিল পরিস্কার। ১৯৭০ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ভূমিধ্বস বিজয় সংকেত দিচ্ছিল যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য উদিত হতে আর বেশী বাকি নেই। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই ছিল মূলতঃ স্বাধীনতার ঘোষনা। এর পরই কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। গাজীপুরের শ্রমিকজনতার পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিরোধ তথা সম্মুখ সমর বলে দেয় বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধ থেকে দূরে নয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত রক্তক্ষয়ি যুদ্ধ করে আমরা বিশ্বে একটি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলাম। যা আজ বিশ্বের বিশ্ময়।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ যেমন বেশি সময় নয় আবার ৯ মাস যুদ্ধে পৃথিবীর অন্যতম সামরিক শক্তিধর দেশকে পরাজিত করাও কম বীরত্ব না। এছাড়া এত কম সময়ে এত প্রাণহানি ও ধ্বংসও পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম যুদ্ধেই ঘটেছে। আমার ছাত্র সুমন দেবনাথ তার ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেছেঃ ত্রিশ লক্ষ মানুষকে যদি একের উপর এক শোয়ানো হয় তবে তার উচ্চতা হবে ৭শ’২০ কিমি। ত্রিশ লক্ষ মানুষ যদি হাতে হাত ধরে দাঁড়ায় তবে তার দৈর্ঘ হবে ১১শ’ কিমি। ত্রিশ লক্ষ মানুষের শরীরে মোট রক্তের পরিমাণ ১কোটি ৫০লক্ষ লিটার। বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থশূন্য ব্যাংক, আন্তর্জাতিক সহায়তার অনুপস্থিতি, অতি নগন্য শিল্প, পশ্চাৎপদ কৃষিব্যবস্থা, চলমান দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র মধ্যে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন ও দিল্লী হয়ে ঢাকা ফিরেই দেশ গড়ার কাজে হাত দেন। তখন চারিদিকে শুধু নেই আর নেই। নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের নাগরিকদের বঙ্গবন্ধুর প্রতি অতি প্রত্যাশা, আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাব, মুসলিম বিশ্বের অসহযোগিতা, পরাজিত শক্তি পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর আল শামসের বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র এবং তাদের স্বদেশ ও বিদেশে প্রোপাগান্ডায় একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ কতটুকুই বা এগুতে পারে? আর এরই মাঝে মাত্র ৪ বছরের মাথায় জাতির জনক, তার পরিবারের সদস্য, স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী বেশীর ভাগ নেতাকে হত্যা, ক্যু পাল্টা ক্যু’র মধ্যে একটি দেশ কতদূরই বা এগুতে পারে?
যাই হোক, এতকিছুর পরও বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে কেবল মাথা উচু করে নয়; দূর্দান্ত প্রতাপে এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। যেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিল সেই দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মেড ইন বাংলাদেশ স্যুট, প্যান্ট শার্ট পড়েন। জনসংখ্যার ভারে ন্যুজ্ব ও অতি জনসংখ্যাকে বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের জন্য বোঝা বলছিলেন সেই দেশ তার জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিনত করে আজ মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করছে।

এছাড়া যে পাকিস্তান ২৫ বছর অন্যায্যভাবে আমাদের সম্পদ তাদের দেশে স্থানান্তর করেছে, আমাদের সকল অবকাঠামোকে ধ্বংস করেছে, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, আমাদের দেশের অভ্যন্তরে তাদের গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে চাঙ্গা করেছে, আমাদের দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক টানাপোড়নে ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে, সর্বোপরি যারা কখনই চায়নি বিশ্বের দরবারে আমরা একটি উন্নত জাতি হিসেবে মাথা উচু করে দাড়াই আজ তারা কোথায় আর আমরা কোথায়? এতদসংক্রান্ত কিছু তথ্য দেয়া যেতে পারে।

যে পাকিস্তান ৯ বছর সময় নিয়েছিল তাদের সংবিধান রচনা করতে আমরা তা ১ বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করেছি। পাকিস্তান ৭২ বছরেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজনীতিকে সামরিক হস্তক্ষেপ মুক্ত করতে পারেনি আমরা তা ৪৯ বছরে করতে পেরেছি। পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১৬শ’৪১ ডলার আর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৯শ ৯ডলার। পাকিস্তানের ঋন ২হাজার ১শ’৭৬কোটি ডলারের (জিডিপির ৭৪.৯৪%) বেশি হলেও বাংলাদেশের ঋন হলো ১ হাজার ৭শ’ ৮৩কোটি (জিডিপির ২৭.১%)। পাকিস্তানের রপ্তানী আয় ২৪.৭৭২ বিলিয়ন ডলার আর বাংলাদেশের রপ্তানী আয় ৪০.৫৩ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানে ২৯.৫% জনগন চরম দরিদ্র হলেও বাংলাদেশে মাত্র ১২.৯%জনগন চরম দরিদ্র বা দৈনিক ৩ ডলার দিয়ে জীবনযাপন করে। পাকিস্তানের বিদেশী রিজার্ভ ১৬.০৭ ডলার হলেও বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার। যা পাকিস্তানের দ্বিগুনেরও বেশি। পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ বছর আর বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। এছাড়া বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১২ লক্ষ মানুষের চাকুরী ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে। জেট্রো বলছে বাংলাদেশ হলো এশিয়ার মধ্যে কম বিনিয়োগ করে বেশি মুনাফা অর্জনে সেরা। গোল্ডম্যান সাচ বলেছে বাংলাদেশ হলো পরবর্তী ১১ টি উচ্চ সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশের একটি। ইউবিএস বলছে ২০৫০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ১২টি শক্তিশালী অর্থনীতির একটি। এডিবি বলছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ হলো সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারমান অর্থনীতির দেশ। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার হলো ৫.২৩ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলো ৮ এর উপর। গত দশ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬-৭%। যা বিশ্বে বিরল। এছাড়া ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানের জন্য বাংলাদেশ হতে চলেছে অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক গমন-বর্হিগমনের আঞ্চলিক হাব। যেখানে আগামী ১৫ বছরে ১শ’ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করা হবে।

সবশেষে বলতে চাই, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সকল ইতিবাচক ক্ষেত্রে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবো এই হলো আমাদের ৪৯তম বিজয় দিবসের প্রত্যাশা।

লেখকঃ প্রফেসর, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন