আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং
মুনজের আহমদ চৌধুরী :: যে সমাজে একজন সংবাদকর্মীর রাজনৈতিক দলীয় ট্যাগ না থাকাটা এখন পাপ, সে পাপের বোঝা কাঁধে নিয়ে সাংবাদিকতা করি। জানি না কত দিন করতে পারব, তবে যতদিন করব, কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী-ভৃত্য না হয়েই করব।
যখন লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের মালিকের নানা রাজনৈতিক অনায্যতা নিয়ে লিখি, তখন তারা বলে ও তো ছাত্রলীগ করত, চারদলীয় জোট সরকার আমলে রাজপথে লড়েছে , মামলা খেয়েছে। আবার যখন কোন যৌক্তিক নিউজ বা লেখা যখন সরকারদলীয় কোন নেতার বিরুদ্ধে যায়, তখন বলা হয় তার এক নিকটাত্বীয় জোট সরকার আমলে বিএনপির মন্ত্রী ছিলেন। আমাদের রাজনীতি এমনি সর্বগ্রাসী এক বাইপুলার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আওয়ামীলীগ বিএনপি জামায়াত সব দল মিলেই। সৃষ্টি করেছে সুবিধার দামে কিনে ফেলা ক্রীতদাস শ্রেনী। সেখানে দল নিরপেক্ষতা মানে রীতিমত অপরাধ।
অন্ধ ডান নয়তো ভ্রষ্ট বামের নষ্ট গলিতে দুদিকে দুইদল চেতনার মলম ব্যবসায়ী। সেখানে আপনি পেশাকে, পেশার দায়বদ্ধতা কমিটমেন্টকে ভালবেসে দল নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করলে সুবিধাভোগী দালাল পক্ষগুলোর তাতে গায়ে লাগে। সেই বাস্তবতার সাথে ষোল বছরে সংগ্রাম করে পেশাদার সাংবাদিকতা করে এসেছি, করে যাব।
আবার যদি কোনদিন রাজনীতি করতে ইচ্ছে করে তবে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়েই রাজনীতি করব। সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে দলীয় রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারকে আমি ঘৃনা করি, ঘৃনা করতাম, ঘৃনা করবও।
দুই.
ক্ষমতাশীন বা ধনবানদের কাছে গিয়ে জীবনে কখনো ছবি বা সেলফি কোনটাই তুলিনি। ক্ষমতাশীন কেউ কোন কালে আমার আত্বীয় থাকেন না। কোনদিন কোন ভাই, মামা, চাচার পরিচয় দিইনি কোথাও। ক্ষমতা আর ক্ষমতাশীনদের দাসত্ব করতে যতটা নির্লজ্জতার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, সে যোগ্যতাটা অর্জন করতে পারিনি
আমি একজন সংঘহীন মানুষ, যদিও সঙ্গীহীন নই। দিনশেষে পরাজিত, হেরে যাওয়া, বিপদগ্রস্থ মানুষের পাশে দাড়াতে আমার ভাল লাগে। এমন অনেক অসহায় মানুষের দোয়া ভালবাসাকে সঙ্গী করেই পথ চলি। বলতে পারেন, এটাই আমার ক্ষমতা।
উপরে এক আল্লাহ ছাড়া কোন মানুষের করুনার প্রার্থী হতে হয় নি। এভাবেই বাকী দিনগুলি পার করে যেতে চাই।
তিন.
কোন একজনকে সাধনার মতো করে ভালবাসতে যে ধৈর্য্য আর সাধনা লাগে; সেসবের অনেক কম খরচেও পৃথিবীতে অনেক কিছু করে করে ফেলা যায়।
তার থেকেও বড় সত্যিটা হলো সেই সাধনার ধৈর্য্য ও সময় কোনটাই আমার নেই। এখনো আগ্রহ অনুভব করি না।
রোজকার কাজগুলি দিনে দিনে যে শেষ করি সেটাও না। শেষ না হলে কি আর করা? নিজের পড়বার সময়টা চুরি করি। অবসরে গান শোনার, মুভি দেখা অথবা কিছু পড়ার অবসরের মত ভালবাসারও অবসর থাকে। তখন তখন নিজেকে লিখে রাখি, সেলফোনের কিবোর্ডে। এই এখন যেমন লিখছি।
অবসরে নিরালায় নিজের নিয়ে ভাববার সময় এলে রবীন্দ্রনাথের একটা মাত্র গানই ইদানিং মনে বাজে-'আমি চঞ্চলো হে, আমি সুদুরেরও পিয়াসী'।
যে কাজগুলি আমাকে আনন্দ দিতে পারে, আত্মায় প্রশান্তির পরশ এখনো জোগাতে পারছে, সেকাজগুলি ইচ্ছেগুলি পুরন করে যেতে চাই। আর জীবন যদি কখনো শুধু ভালবাসবার অবসর দেয়, বাসব।
চার
যে দেশটায় থাকি, তার আবহাওয়াটাই বিষন্ন। চারিদিকে খুব সুন্দর, ছবির মতোন ফুল। কিন্তু, কী আশ্চর্য, ফুলগুলিতে গন্ধ বা দুর্গন্ধ কোনটাই নেই।
লন্ডনে যে কোনাটায় থাকি, তার চারপাশে সবুজের সমারোহ। ফ্রেমে বাধাঁ ছবির মতোন সবুজ। সেখানে বসন্তে খুব ফুল ফুটে। কিন্তু, কী আশ্চর্য ব্রিটেন বা ইউরোপ অথবা আমেরিকা কোন দেশেই ফুলের গন্ধ নেই।
যে নগরে ফুলেরা গন্ধহীন, মমতার আদরবিহীন, সে শহরটা আমার সন্তানের শহর। এটাই স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেছে, ভাগ্যের ফেরে। খুশবুহীন এবং খুশবুময় দুই ফুলের সৌন্দর্য জীবন আমাকে চিনিয়েছে। আমার নিজের দুটো শহর আছে। লন্ডন আর মৌলভীবাজার। লন্ডনের মাঝরাতে রাশেক অথবা আরমিনের মতোন বন্ধুর ঘরে আমার জন্য ভাত এবং ভালবাসা দুটোই রাখা থাকে। বিপ্লব দা, তরীকত, সাইদুল, রশীদ, বাহার, শরীফরা কখন যে আমার ভাই হয়ে গেছেন গত দশ বছরে, ঠিক বুঝতে পারিনি। সারওয়াত, আমার মমতাময়ী বোন। আসলে, অনেক মানুষের আত্বিক ভালবাসার মাঝখানে বাস করে আসলে কোন একজন নারীকে আলাদা করে ভালবাসার তাড়না অনুভব করা কঠিন। পুত্রের দুধমাখা বুকের গন্ধ , আমার মায়ের পুন্য স্পর্শ আর বাংলাদেশের বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ আমাকে যতটা আনন্দ তৃপ্তি দিতে পারে, আর কোন কিছুই আমাকে সেভাবে তৃপ্ত করতে পারে না।
বাইরে তার পুরোদস্তুর সংসার, ভেতরে মানুষগুলি তার একাকীত্বে পুড়ে একাকার। খারাপ লাগে খুব, আর এটুকু বুঝি তখন, ভালো আছি। করুনাময়ীর কাছে এই জীবনটাই চেয়েছিলাম। বহু ভাগ্যে এরকম ভালবাসাময়, নিজের ভেতরের আয়নার সামনে সবসময় দাড়াতে পারা একটা জীবন মেলে। মানুষ কখন যে তার পুরোদস্তুর কাংখিত সময়ে থাকে, সেটা অনুভব করবার জন্য যাত্রাবিরতী দরকার। নিজের দিকে এবং নিচের দিকে তাকাবার সময় দরকার।
ভাটির, গড্ডালিকার স্রোত প্রায়ই নাম ধরে ডাকে। কিন্তু, স্রোতের প্রতিকূলে উজানের নৌকা হাল ধরা যে পুরনো অভ্যাস...। ঝড়ের রাতে মাঝনদীতে নৌকার হাল ধরে থাকাতেই মাঝি-জীবনের গভীরতম সুন্দর। সে সুন্দরে জীবনটা যাপন নয়, উদযাপন করি।
শুভ শুক্রবার।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক