Sylhet View 24 PRINT

ক্ষণজন্মা এক ব্যক্তিত্ব আল্লামা ফুলতলি (রাহ.)

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০১-১২ ১৪:১৫:২২

আল্লামা ফুলতলি (বামে), লেখক সাদিক (ডানে)

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক :: এ দেশে যুগে যুগে, কালে কালে অনেক মহামানবের আগমন-আর্বিভাব ঘটেছে। যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে সৃষ্টিকর্তার মনোনীত ধর্মকে পৃথিবীর বুকে প্রচার-প্রসার করেছেন, উম্মতে মুহাম্মদিকে সত্য-সঠিক পথে পরিচালিত করতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে হযরত শাহজালাল, খানজাহান আলী, শাহ মখদুম (রহ:) অন্যতম। তাঁদের বদৌলতে এ অঞ্চলের মানুষ ঈমানের নুর নুরান্বিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। যারা রাসুল (সা:)-এর অনুপম আদর্শ নিজেদের মধ্যে লালন করতেন। মানুষের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করতেন। সমাজ ও মানবতার কল্যাণে নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিতেন। এসব বুযুর্গের আধ্যাত্মিক শক্তির বলেই জাহেলিয়্যাত পরাজিত হয়। স্বর্ণযুগের এসব মনীষীদের মধ্যে উজ্জ্বল নিদর্শন পাওয়া যায় বিশিষ্ট সংগঠক, সমাজসেবক, কবি, পির ও বীর, ভারতীয় উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক সম্রাট শামসুল উলামা আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রাহ.)। যিনি বাল্যকালেই দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। কেবল গতানুগতিক আলেম বা পিরের মতো কাজ করেননি। তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ইবাদত বন্দেগী, তসবিহ তাহলিল, জিকির মুরাকাবার পাশাপাশি সৃষ্টির সেবা ইবাদতের ন্যায় বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এ জন্য তাঁর অবদান তাঁর চলে যাওয়ার পরও পত্রপল্লবে বিকশিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাঁর ক্বিরাত পদ্ধতির ফলে সৃষ্ট লাখো ছাত্র, দ্বিনি উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে তৈরি শতসহস্র শিষ্য ও আধ্যাত্মিক দীক্ষাপ্রাপ্ত অসংখ্য মুরিদ ছাড়াও তাঁর রয়েছে ঔরসজাত নেক সন্তান। যা একজন মানুষের পরকালীন অব্যাহত মর্যাদা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে থাকে। এদিক দিয়ে আল্লামা ফুলতলী (রহ:) অনন্য।

আল্লামা ফুলতলী (রহ:) ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থে সময়ে সময়ে গড়ে তুলেছেন জাগরণী আন্দোলন, ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ দেখলেই ফেটে পড়েছেন বিক্ষোভে। শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে বীর-বিক্রমে গড়ে তুলেছেন সংগ্রামী দুর্গ।  দেশ, জাতি ও ধর্মের দুর্যোগময় মুহূর্তে তিনি কখনো নীরব থাকেননি। আল্লামা ফুলতলি (রাহ.)-এ দেশের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে নানাবিধ সংস্কার সাধন, তাদের আত্মিক পরিশুদ্ধি, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ, সর্বোপরি ইসলামের সঠিক আক্বিদা-বিশ্বাস অনুযায়ী জীবন গঠনে তাঁর জীবনী উত্তম দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী কোনো আক্রমণ আসলে তিনি ঘরে বসে থাকতেন না।  জান-মাল দিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
ইতিহাস সাক্ষী- বুশ-ব্লেয়াররা ইরাক আক্রমণ করলে যুদ্ধবিরোধী এক মহাসমাবেশে আল্লামা ফুলতলী (রহ:) বলেছিলেন- ‘মানুষের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে একমাত্র ধন ও সম্মান নিয়ে। ইরাক আমেরিকার সম্পদ আত্মসাৎ করেনি কিংবা তার সম্মানে আঘাতও হানেনি। কারণ ছাড়া একমাত্র পশুই যুদ্ধ করতে পারে। কোনো মানুষ কারণ ছাড়া যুদ্ধ করতে পারে না। তিনি প্রশ্ন রাখেন- ইরাকে হামলা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আসলে পশু না মানুষের পরিচয় দিতে চান’। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইনকিলাব- ১৬/৩/২০০৩)।

হযরত শাহজালাল (রাহ.)-এর মাজারে বোমা হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত মহাসমাবেশে আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) বলেন- ‘বিচারবিভাগীয় তদন্তপূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অন্যথায় আল্লাহর ওলির পবিত্র প্রাঙ্গণকে কলঙ্কিত করার প্রচেষ্টা মোকাবেলায় আমি আমার জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত রয়েছি। তিনি বলেন, সরকারের কোনো মন্ত্রী কিংবা উচ্চপদস্থ কোনো সরকারি কর্মকর্তার বাসায় এ ধরনের হামলা হলে সরকারের তোড়জোড়ের শেষ থাকতো না। অথচ যার প্রচেষ্টায় সিলেট তথা ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা বীরদর্পে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছে সেই আধ্যাত্মিক সম্রাট শাহজালাল (রহ:)-এর দরগাহ প্রাঙ্গণে বোমা হামলায় সরকারের ভূমিকা হতাশাজনক।  ’ (তথ্যসূত্র: দৈনিক সিলেটের ডাক ও দৈনিক জালালাবাদ : ২৪/১/২০০৪)।

বিগত জোট সরকার মাদরাসার ফাজিল-কামিলকে ডিগ্রি ও মাস্টার্সের মান দেয়ার নামে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদরাসার ফাজিল-কামিলকে ন্যস্ত করে মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা বিনষ্ট করার চক্রান্ত করেছিল। তখন আল্লামা ফুলতলি (রাহ.)-এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তারই অধীনে ফাজিল-কামিলকে ডিগ্রি ও মাস্টার্সের সমমান দেয়ার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানান। আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) বিগত ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে পাঁচ শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে সিলেট থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করেন। এ ঘটনাটি দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে, জোট সরকারের ভিত নড়ে যায়। ফলে তৎকালীন সরকার মাদরাসার ফাজিল-কামিলকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করতে বাধ্য হয়। পরবর্তী সরকার ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে মাদরাসার ছাত্ররা ফাজিল-কামিল পাশ করে ডিগ্রি ও মাস্টার্সের যে মান পাচ্ছেন তা আল্লামা ফুলতলি (রাহ.)-এর আন্দোলনের ফসল।

আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) জীবনে তাঁর ধন-সম্পদ গরিব-দুঃখির মধ্যে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। শত শত সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তিনি কোনো দিনই কারো কাছে বিনিময় চাননি এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দেয়ারও চেষ্টা করেননি। বরং তিনি অতিসাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন। আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) নিজেই বলেছেন- ‘আমি কোনো সময়ই কোনো সরকারের সঙ্গে যাইনি। পাকিস্তান আমলে দেওয়ান বাছিত সাহেব আমাকে মন্ত্রী করারও চেষ্টা করেন। কিন্তু ‘আমি বলেছি- সিটে বসলে দেবতা আর সিট থেকে নামলে ডোড়াসাপ। আমাকে দিয়ে এমনটি হবে না।’ আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। বৃটিশ বেনিয়া বিতাড়ন এবং মুসলমানদের অধিকার রক্ষার জন্য ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ প্রতিষ্ঠিত হলে আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) জমিয়তের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনসহ বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। জমিয়তের গায়ে কংগ্রেসের ছোয়া অনুভূত হলে বিশেষ করে জমিয়ত নেতা দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি (রাহ.) দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিপক্ষে অবস্থান করলে  আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) তখনই ঘোষণা দিয়ে জমিয়ত ত্যাগ করেন।

১৯৫০ সালে ভারতের আসাম প্রাদেশিক সরকার ‘মুসলিম এডুকেশন বোর্ড’ বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারি করলে আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) প্রতিবাদ জানিয়ে আমরণ সংগ্রামের ডাক দেন। তাঁর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সহ্য করতে না পেরে তৎকালীন আসাম সরকার আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) উপর গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করে। এমনকি পরবর্তীতে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান আমলে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নেজামে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে আল্লামা ফুলতলি (রাহ.)-এর অবদান অত্যন্ত প্রশংসিত। পাকিস্তানি সেনারা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের উপর যখন অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার চালাচ্ছিল তখন এসব অসহায় জনগণের মধ্যে অবিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আল্লামা ফুলতলী (রাহ.)। নির্যাতন-নিপীড়ন, গণহত্যা বন্ধ করার জন্য আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) পাকসেনাদের প্রতি বারবার ‘খবরদার’ বলে তাদেরকে ধমক দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আল্লামা ফুলতলি (রাহ.)-এর অবদান সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম.এ.জি ওসমানী বলেছেন- ‘উনি যদি সে সময় সিলেটে না থাকতেন তাহলে হাজার হাজার মা বোনের লাশ নদীতে ভাসত।  '

মানুষ দুনিয়ার জীবনে ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু কিছু মানুষ দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেও তাঁরা মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকেন যুগ থেকে যুগান্তর, কাল থেকে কালান্তরে। তাঁদের স্মৃতি-মহিমা কখনো ক্ষয় হয় না, লয় হয় না। আল্লামা ফুলতলি (রাহ.) ছিলেন এক আদর্শ মহাপুরুষ। ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি রাত ২টার দিকে বিদায় নেন নশ্বর পৃথিবী থেকে এই ক্ষণজন্মা মনীষী। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর এ ওলির দরজাকে বুলন্দ করে দিন এবং তাঁর সকল খিদমতগুলোকে সমৃদ্ধ করে দিন। আমিন।


লেখক: প্রাবন্ধিক

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.