Sylhet View 24 PRINT

এ যুগের অগ্নিকন্যা ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০১-১৭ ০০:৪২:৪৫

সুজাত মনসুর :: বাপ্পি, পুরো নাম ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি, যাকে আমি সম্মোধন করতাম 'এ যুগের অগ্নিকন্যা' বলে। বাপ্পি নামের মুজিবাদর্শের স্ফুলিঙ্গটি অতি তাড়াতাড়ি এক ধমকা হাওয়ায় নিভে যাবে তা কল্পনারও অতীত। অথচ তাই হয়েছে। বাপ্পি অকালেই ঝরে গেলো মাত্র চারদিন জীবনের সাথে লড়াই করে। অথচ এই বাপ্পিই রাজপথ বলুন, সংসদ বা টকশো বলুন কোন জায়গা থেকেই কখনোই পরাজিত হয়ে ঘরে ফিরেনি। সকল সময় প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী হয়ে বিজয়ের বেশেই ফিরেছে। কিন্তু মৃত্যু এমনই প্রতিপক্ষ যাকে, প্রতিহত কিংবা পরাজিত করা যায় না। আর যায়না বলেই প্রিয়জনেরা হারিয়ে যায়। চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। তবে সবাই বেঁচে থাকে স্মৃতিতে। কেউ বা হয় অমর সৃষ্টি ও কর্মে। ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পিও তেমনি একজন,, যে বেঁচে থাকবে তাঁর সৃষ্টি ও কর্মে অবিনশ্বর হয়ে।

বাপ্পির হঠাৎ অসুস্থ হয়ে একেবারে লাইফসাপোর্টে চলে যাওয়ার বিষয়টি প্রথম জানতে পারি তাঁর স্বামী শেখ রফিকের স্ট্যাটাস থেকে। তারপরই ম্যাসেঞ্জারে কথা বলি। কিন্তু রফিক কথা বলতে পারছিলেন না। ক্ষণে ক্ষণেই তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন। কোন রকমে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অত্যন্ত সংক্ষেপে সংকটাপন্ন অবস্থার কথা বলে, দোয়া করতে বললেন। আল্লাহ মহান এবং তিনি দয়া করবেন বলে রেখে দিলাম। কোন ধরনের সান্তনার কথা বলতে পারলাম না। বুকে আশা বেঁধে রইলাম এবারো প্রিয়বোন বাপ্পি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। আবারও টকশোতে প্রতিপক্ষকে যুক্তির বেড়াজালে ধরাশায়ী করবে। সেই বিজয়ের কাহিনী ইনবক্সে দিয়ে বলবে, “'ভাই শুনে কমেন্ট করবেন। ভালো লাগলে শেয়ার করবেন।” শুনতাম তো অবশ্যই।কমেন্টও করতাম। তবে সবার আগে শেয়ার করতাম। শুধু ভিডিও নয়, পত্রিকায় কোন লেখা প্রকাশিত হলেই তা ইনবক্সে পাঠাতো। বাগ্মিতা, লেখক সত্তা, অত্যন্ত বলিষ্ঠ যুক্তিবাদী বিতার্কিত, আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা, আস্থা, আনুগত্য মিলিয়ে বহুমাত্রিক গুণ ও বিরল প্রতিভার সমন্বয় খুব কমই দেখা যায়। ক্ষণজন্মা বাপ্পির মধ্যে এই বিরল গুনের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন বিধাতা। তাই ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পির অকাল প্রয়াণ বাংলা ও বাঙালির জন্য অবশ্যই অপূরণীয় ক্ষতি, যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।

সম্ভবত ২০১৬ সালের শেষের দিকে বাপ্পি অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। সে-সময়ও সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে আল্লাহর দয়ায় সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু এবার আর মরণব্যাধি তাঁকে রেহাই দিলো না। সেবার সংকটাবস্থা থেকে বেঁচে যাওয়ায় এবারো প্রত্যাশা ছিল হয়তো সংকটাবস্থা কাটিয়ে সবার প্রিয় বাপ্প্ িআবার সবার মাঝে ফিরে আসবে সুস্থ হয়ে। না এবার আর আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। নিয়তির নিকট আমাদের পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে। অশ্রæসিক্ত নয়নে বিদায় জানাতে হয়েছে প্রিয় মানষটিকে। ২০১৬ সালে অসুস্থতাবস্থায় বাপ্পির জীবনের একটি ঐতিহাসিক ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো সংসদে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব উত্থাপন ও পাশ। সেদিন সংসদে দেয়া ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পির হৃদষ্পর্শী বক্তৃতা এখনো কানে বাজে। এখনো মাঝে মাঝেই সেভ করে রাখা সেদিনের বক্তৃতা শুনি। সেই বক্তৃতায় বাপ্প্ িযে সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি উত্থাাপন করেছিলেন তা ছিল লক্ষ-কোটি মুজিবপ্রেমিদের প্রধানতম প্রাণের দাবি। অথচ আওয়ামী লীগের এতো অভিজ্ঞ বাঘা বাঘা সাংসদ থাকা সত্বেও বাপ্পির আগে কেউ এই বিষয়টি সংসদে তোলা দূরে থাক, চিন্তাও করেছেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। সেজন্য বাপ্প্ িঅবশ্যই লক্ষ-কোটি মুজিবপ্রেমিদের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছিল। শুধু সেদিনের বক্তৃতাই নয়, তাঁর প্রতিটি বক্তব্যই রক্তে দোলা দেয়। হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মিছিলে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীকে ঘিরে তাঁর ছিল ব্যাপক উচ্ছ¦াস। কথা ছিল আমরা বিলেতে মুজিব শতবর্ষ উদযাপনের যে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবো তার যেকোন একটাতে সে উপস্থিত থাকবে। বাপ্পির অকাল মৃত্যু আমাদের সে স্বপ্নসাধ পুরণ হতে দিলো না। বাপ্পির আর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের সৌভাগ্য হলো না।

ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পিকে দেখি সম্ভবত ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সুনামগঞ্জ জেলার(তখনকার মহকুমা) দিরাইতে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। তাঁর বয়স ছিল তখন একবছর। বাপ্পির আব্বা সুনামগঞ্জে চাকরি করতেন। সুনামগঞ্জ শহরে বাবার কর্মস্থলেই বাপ্পির জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাঁদের পরিবার কয়েক মাসের জন্য দিরাইতে অবস্থান করেন। বাপ্পির চাচা দিরাইতে যতটুকু মনে পরে প্রকৌশলী পদে কর্মরত ছিলেন। আমার তখন কৈশোর চলছে। আমার থেকে বছরখানেক বড় তাঁর এক ভাই, নাম আজাদ। আমার বড় ভাইয়ের নামও আজাদ। বাপ্পির বড় ভাইয়ের সাথে খুব সহজেই আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমাদের বাসা থেকে ওদের চাচার বাসা ২/৩ মিনিটের হাঁটার পথ। প্রায় প্রতিদিনই ওদের ওখানে যেতাম। কখনো আজাদ চলে আসতো। ঐ সময় অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমরা ছোটরা মিলে কাঠের বন্দুক দিয়ে ট্রেনিং দিতাম। আজাদও আমাদের সাথে যোগ দিতো। সম্ভবত ঐ বছর (১৯৭১) এপ্রিল মাসের শেষের দিকে অথবা মাঝামাঝি সময়ে আমরা গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। বাপ্পিরাও কোন এক সময় দিরাই থেকে চলে যায়। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। এভাবে দীর্ঘ চার দশকেরও অধিক সময় অতিবাহিত হয়। স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে সংসার জীবন। তারপর বিলেত প্রবাসী। বাপ্পিদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আবারও যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে।

বছর চারেক আগে ফেইসবুকে একাউন্ট খোলার পর বন্ধুদের তালিকায় ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি ও তাঁর বড়ভাইয়ের সাথে যুক্ত হবার সুযোগ হয়। তখনও জানিনা এই আজাদ আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধু আর বাপ্পি ওর বোন। এটা জানি বাপ্পি সাংসদ আর আজাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমাদের মতাদর্শ একই। বাপ্পির বাগ্মিতায় আমি এতোই মুগ্ধ হই যে এক পোস্টে ওকে আমি 'এ যুগের অগ্নিকন্যা' বলে আখ্যায়িত করি। যারা ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পির বক্তব্য শুনেছেন আমি নিশ্চিত, তারা আমার সাথে সহমত পোষণ না করে পারবেন না। ইতোমধ্যে আবুল আজাদ আমাকে ইনবক্সে ম্যাসেজ দিয়ে জানায় যে, সাংসদ ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি হলো তার ছোটবোন। আজাদের এই ম্যাসেজের মধ্যে এরকম একজন বোনের জন্য একজন গর্বিত ভাইয়ের আত্মতৃপ্তির স্বাদ অনুভব করি। এরপর থেকে আমিও কারো সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে অত্যন্ত গর্বের সাথেই বলতাম, ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি আমার ছোটবোন। আমাদের সেই গর্বিত ছোটবোনটি আজ হারিয়ে গেলো চিরতরে। আর কোনদিন তাঁর বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়ে বলবো না ঐ শোন মুজিবাদর্শের লড়াকু সৈনিক আমাদের এ যুগের অগ্নিকন্যার যৌক্তিক জ্বালাময়ী ভাষণ বা তর্কযুদ্ধ।

বাপ্পির সাথে ১৯৭১ সালের পর আবারও প্রায় ৪৭ বছর দেখা হয়েছিল ২০১৮ সালের মার্চ মাসে লন্ডনে ‘বঙ্গবন্ধু বইমেলায়’। সেদিন আমাকে দেখে এতোই আবেগ আপ্লুত হয়েছিল যে, জড়িয়ে ধরে বলেছিল, 'ভাই শেষ পর্যন্ত আপনার সাথে দেখা হলো।' কেননা, এর আগে বাপ্পি লন্ডন এলেও প্রিয় বোনটিকে দেখার আমার একটা তীব্র আকাংখার সেদিন অবসান হয়েছিল। সাথে সেদিন আমার ছেলে সুপ্রতও সাথে ছিল। বইমেলা শেষে আমরা কয়েকজন মিলে ব্রিকলেনে খেতে যাই। সাথে অন্যান্যদের মধ্যে আরো ছিল সাজিয়া স্নিগ্ধা ও খালেদ আহমেদ জয়। আজ বাপ্পি নেই। সবকিছু এখন স্মৃতি হয়ে থাকবে। বাপ্পি অমর হয়ে াকবে বাঙালি জাতির স্মৃতির মনিকোঠায়, আলোকবর্তিকা হয়ে তরুণ প্রজন্মের। ভালো থেকো পরপারে আমাদের প্রিয় ফজিলাতুনেচ্ছা বাপ্পি।

হোয়াইটচ্যাপেল, যুক্তরাজ্য
suzatmansur@yahoo.com

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.