আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ভবন নির্মাণে চাই বাড়তি সতর্কতা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০২-১১ ১৪:০১:২১

ফেরদৌস আব্বাস চৌধুরী :: প্রাচীন সমাজ থেকে আজকের আধুনিক মানব সভ্যতার বিবর্তন সম্ভব হয়েছে প্রকৌশল বিদ্যার আশির্বাদে। আদিম সমাজ থেকেই মানুষ তার নিজের বাসস্থান হিসেবে নিরাপদ আশ্রয়স্থলগুলোকে হিসেবে বেছে নিয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশ বা গভীর গুহা, নদী বা জলাভূমির পাড়ে কাঠ বা বেতের ঘর কিংবা বরফে ইগলু তৈরি করে মানুষ প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিস্ত্ব, টিকে রেখেছে যুগের পর যুগ। আদিম এই বাসস্থানগুলো সময়ের সাথে সাথে আধুনিক রুপ পেয়েছে বহু পূর্বেই। দিনকে দিন বাড়ি নিমার্ণে ও নির্মাণশৈলীতে যে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, তার সাথে সাথে ভবন নির্মাণে বাড়তি ভাবনা ও সতর্কতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে প্রতিটা অঞ্চলেই বহুতল ভবন নির্মাণের হিড়িক পড়ে গেছে। বাড়ি-অফিস, কমার্শিয়াল স্পেস কিংবা ইন্ড্রাষ্ট্রি প্রকারভেদে এইসব ভবন কতটা নিরাপদ এবং বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হচ্ছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। পুকুর-ডোবা, খাল-বিল কিংবা কৃষিজ ও অকৃষিজ ভূমি ভরাট করে যত্রতত্র ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এসব ভবন নির্মাণে অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

আমাদের দেশের বেশকিছু অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ। তিনটি ভূতাত্ত্বিক ফাটলের (ফল্ট) কাছাকাছি বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে এই অঞ্চলে যেকোন মুহূর্তে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া গত দুই বছরে প্রায় সাত-আটবার দেশের নানা অঞ্চলে মৃদু ভূকম্পন অনূভূত হয়েছে। ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে বহুতল ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণের গুরুত্ব অপরিসীম।

রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার প্রেক্ষিতে দ্রুত গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। বাংলাদেশে নিরাপদ ভবন বা কাঠামো নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) রয়েছে যা অনুসরণ করে যেকোন নির্মাণ কাজ সম্পাদন করতে হবে। উক্ত বিল্ডিং কোডে ভবনের নকশা তৈরি থেকে নির্মাণ কাজ পর্যন্ত সকল প্রকার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ প্রকৌশলী অবশ্যই বিল্ডিং কোড মোতাবেক ভবনের নকশা তৈরি এবং নির্মাণ কাজ সম্পাদনা করে থাকেন বা করবেন। যেহেতু বিল্ডিং কোড একটি বিস্তৃত এবং টেকনিক্যাল বিষয় সেহেতু প্রকৌশলী ব্যতীত ভবন মালিক কিংবা ঠিকাদারের ক্ষেত্রে সেটি অনুসরণ সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে নির্মাণ কাজে ভূমিকম্পের ঝুঁকি এড়াতে ভবন মালিকদের উচিত একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী নিয়োগ বা পরামর্শ মোতাবেক কাজ করা।

বর্তমানে বাংলাদেশে ভূমিকম্প-সহনশীল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাগুলো:

১. বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে অনুসরণ না করা এবং ভবন নির্মাণে দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী নিয়োগ প্রদান না করা।

২. সয়েল টেস্ট বা মাটি পরীক্ষা করতে না চাওয়া এবং পাঁচ তলার জায়গায় আট তলা কিংবা আট তলার জায়গায় এগারো-বারো তলা ভবন তৈরি করা।

৩. প্রকৌশলী প্রদত্ত নকশা মোতাবেক কাজ না করা এবং ভবন নির্মাণে মানহীন নির্মাণ সামগ্রী যেমন ইট, পাথর, সিমেন্ট এবং রড ব্যবহার করা।

৪. জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করে ভবন তৈরি করা।

৫. ভবনের কলামের ধারণক্ষমতা অনু্যায়ী কলাম ও বিমে পর্যাপ্ত রড ও স্টিরাপ প্রদান না করা ও পাশাপাশি দুটি ভবনের মধ্যে ফাঁকা জায়গা না রাখা বা কম জায়গা রাখা।

৬. বহুতল ভবনে অগ্নিব্যবস্থা, ফায়ার এক্সিট ও এলার্ম না রাখা।

একজন প্রকৌশলী তার প্রকৌশল বিদ্যার ও জ্ঞান ব্যবহার করে ভবন নির্মাণের পূর্বে সয়েল টেস্ট বা মাটি পরীক্ষা করে মাটির বেয়ারিং ক্যাপাসিটি বা ভারবহন ক্ষমতা হিসাব করে ভবনটির ফাউন্ডেশন এবং তা কত তলা পর্যন্ত সেটি নিরাপদ তা ভেবে ডিজাইন করে থাকেন। ভবন নির্মাণে মাটির প্রকৃতি ও ধরণ নির্ণয় বড় একটা "ফ্যাক্টর"। ভবনের তলদেশে ওপরে শক্ত মাটির স্তর থাকলেও নিচের মাটির স্তর ভালো না হলে সে স্থানে সাধারণভাবে বহুতল ভবন করা উচিত নয়। বরং বিল্ডিং কোড মোতাবেক এবং আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি মাথায় রেখে ডীপ ফাউন্ডেশন যেমন সেন্ড পাইলিং, প্রি-কাস্ট পাইল বা কাস্ট-ইন-সিটু পাইল বা র‍্যাফট ফাউন্ডেশন প্রদান করে ভবন নির্মাণ করতে হবে।

ভূমিকম্প সহনশীল ভবন তৈরিতে ফাউন্ডেশনের প্রকারভেদ, বিভিন্ন সাইজ ও ভালো গ্রেডের রডের ব্যবহার, স্টিরাপের স্পেসিং, লেপিং, ব্রেসিং, কনক্রিটের ডিজাইন রেশিও নিশ্চিত সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিদ্যমান নানা সমস্যা ও ত্রুটি চিহ্নিত করে একজন প্রকৌশলী সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন ফলে ভবন হয় মজবুত ও দৃঢ়। কিন্তু ভবন নির্মানের সময় আমাদের দেশে কোন প্রকার নিয়মের তোয়াক্কা করা হয় না। ফলে ভূমিকম্পে ভবনে ফাটল বা হেলে পড়া বা দেবে যাওয়া বিষয়টি খুবই মারাত্মক। ভবন মালিকদের উচিত উক্ত বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করা এবং তার স্বপ্নের বাড়িটিকে টেকসই করে গড়ে তোলা।

বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বর্তমানে মাথায় রাখতে হবে সেটি হচ্ছে ভবনের সামনে এবং চারপাশে অবশ্যই পর্যাপ্ত জায়গা ছেড়ে ভবন নির্মাণ করতে হবে। তাই নতুন বহুতল ভবন তৈরির ক্ষেত্রে রাজউক বা সিটি করপোরেশনের বিদ্যমান বিধিমালা মোতাবেক নকশা প্রণয়নের সময় ভবনের "ফার" হিসাব করে চারপাশে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। এখানে বলাবাহুল্য যে, বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ৯৬ এর ১২ নং ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী ৮ তলা উচ্চতার বিল্ডিং নির্মাণের ক্ষেত্রে ইমারতের সামনে কমপক্ষে ২৫ ফুট এবং ৬ তলা উচ্চতার বিল্ডিং নিমার্ণের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৫ ফুট প্রশস্ত রাস্তা থাকা বাধ্যতামূলক। এ বিধিমালার ৮ নং বিধির ৫ উপবিধি অনুযায়ী উল্লেখিত ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিকটাবর্তী সড়কের সেন্টার বা কেন্দ্র হতে কমপক্ষে ৪.৫ মিটার অথবা সড়ক সংলগ্ন ইটের সীমানা থেকে ১.৫ মিটার দূরে ইমারত নির্মাণ করতে হবে।

রাজধানী ঢাকা বা বিভাগীয় শহরের যেকোনো জায়গায় যদি ভূমিকম্পের দরুণ কিংবা অন্য কোনো কারণে আগুন লাগে তা নেভানোর জন্যে যে পর্যাপ্ত রাস্তার প্রয়োজন বাস্তবে তা নেই ফলে গলির ভেতর পানি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না দমকল বাহিনীর পক্ষে এবং এতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। চারিদিকে জায়গা না রেখে পাশাপাশি গা ঘেষে ভবন নির্মাণের ফলে একদিকে যেমন ভূমিকম্পে ক্ষতির ঝুঁকি থাকে অন্যদিকে এক ভবনে আগুন লাগলে অন্য ভবনে তা ছড়িয়ে পড়ার আশংকাও থাকে। তার বাস্তব উদাহরণস্বরুপ পুরান ঢাকায় অবস্থিত ভবনগুলোর কথাই ধরা যাক, অলিগলির ভেতর ভবনগুলো গা ঘেষে তৈরি করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ২০১০ সালে নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউন থেকে সূত্রপাত হওয়া আগুন নেভাতে হিমসিম খেতে হয় দমকল বাহিনীকে, যাতে প্রাণ হারায় ১২৪ জন মানুষ। সেইসাথে ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ৬৯ জন নিহত হন ও একই বছরে বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লেগে মারা যান ২৪ জন।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সর্বোচ্চ ৭ তলা ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, গ্যাস, ওয়াসা ও বিদ্যুৎ বিভাগের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। পাশাপশি বহুতল ভবনে ফায়ার ডিটেক্টের, স্মোক ডিটেক্টের, উচ্চগতির পানি স্প্রে সিস্টেম ও কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গমণ সিস্টেম থাকাও বাধ্যতামূলক হিসেবে উল্লেখ আছে। তাই ভবন নির্মাণে ভবন মালিকদের এসব বিষয়ে আরো বেশী গুরুত্ব আরোপ করা উচিত।

রাজউক বা সিটি কর্পোরেশনের মত প্রতিষ্ঠানের উচিত ভবন নির্মাণকারী বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কিনা তদারকি করা এবং প্রয়োজনে বিল্ডিং কোড অগ্রাহ্যকারী ভবনগুলোর অনুমোদন প্রদান না করে আইনের আওতায় আনা এবং তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।

পরিশেষে, একজন প্রকৌশলী হিসেবে ভবন মালিকদের প্রতি এটুকু বলতে চাই, আপনার ভবনকে আরো নিরাপদ ও ভূমিকম্প সহনশীল হিসেবে গড়ে তুলতে "কৌশলী" না হয়ে প্রকৌশলী নিয়োগ করে বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ করুণ যাতে আপনার স্বপ্নের এবং কষ্টের বাড়ি যেন কোনো প্রকার প্রাণহানির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।

লেখক :
বি.এস.সি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
ডিজাইন এন্ড প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার
কারিগর কনস্ট্রাকশন এ্যান্ড ইন্টোরিয়র বিডি।
মোবাইলঃ ০১৭১০৯৩৩৮৯৪

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন