আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মুজিব শতবর্ষ ও একজন মহানায়ক

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৩-১৭ ১৬:৩৪:১৯

ফারজানা ইসলাম লিনু :: নিতান্ত প্রয়োজনে রূদ্ধশ্বাসে প্রতিবার আমাকে ঢাকা যেতে হয়। বেশিরভাগ সময় থাকা হয় ধানমন্ডিতে আমার সেজো খালার বাসায়। সে বাসা থেকে অল্পদূরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। লেক সার্কাসের পশ্চিম পাশে ধানমন্ডি লেকের পাড়ের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বত্রিশ নম্বর বাড়িকেই জাদুঘর করা হয়েছে।
সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এই জাদুঘর মহানায়কের নেতৃত্বে বাঙ্গালীর বীরত্বের স্বাধীনতার ঠিকানা।দেয়াল জুড়ে এখনো বুলেটের দাগ,রক্তের দাগ।পিতৃহত্যার বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন। সুপ্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সময় স্বল্পতায় এই বাড়িতে প্রবেশে পুত্রকন্যাদের বায়নায় সায় দেওয়া হয়না কখনো।

নিজের প্রথম বই প্রকাশ উপলক্ষে ২০২০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পুত্রকে নিয়ে আমি ঢাকায়। পাতা ঝরা ফাগুনের দুপুর। লেকের পাড়ের কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ও শিরিষ গাছে আগুন লেগেছে মাত্র। ধুলি ধুসর শহরে আমের মুকুলও কম দেখা যায় না। পুত্রের বায়না আজ যেতেই হবে বত্রিশ নম্বর বাড়িতে।
সেজো খালার বাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মা-ছেলে সোজা চলে যাই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। ভর দুপুরের কড়কড়ে রোদ উপেক্ষা করে এই বাড়িতে আজ দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়।

যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় ঢাকা শহরের গতানুগতিক কোলাহল নেই এইখানে। সুনসান দুপুরে ঝিঁ ঝিঁ ডাকে বিরামহীন। ইট পাথরের শহরে কোকিল ডাকে থেমে থেমে। ব্যস্ত শহরে ছূটির আমেজ। প্রভাত ফেরি শেষে ঘরে ফেরা মানুষের দলছুট নিরব মিছিল।
নিরাপত্তাজনিত কারণে দর্শনার্থীরা কড়া বিধিনিষেধের আওতায়। ইলেকট্রনিকস ডিভাইস সহ যাবতীয় জিনিস পত্র কাউন্টারে জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে প্রবেশ করতে হয় ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িতে।

পাখি ডাকা, ছায়ায় ঢাকা, শান্ত সুনিবিড় ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর বাড়ি আজ লোকে লোকারণ্য। এক টুকরো বাংলাদেশ ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে সম্প্রসারিত অংশের ছয়তলা জাদুঘরে। জিজ্ঞাসু পুত্রের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে গভীর মনোযোগে।

জাদুঘর দেখে ফিরে আসি মুল ভবনে। সম্পূর্ণ অচেনা এই বাড়িতে আমাদের প্রথম পদাচারনা। অথচ সবকিছুই যেন কতো চেনা। অপরাধবোধের তীব্রতায় নৈঃশব্দের হাতছানি। অব্যক্ত শ্রদ্ধা ছাপিয়ে কষ্ট আর গ্লানিতে ভরে উঠেছে শোকার্ত মানুষের হৃদয়। তাইতো দর্শনার্থীদের ভীড়েও পিনপতন নিরবতা এইখানে।
ঐতিহাসিক বাড়িটার মুল চিত্র অপরিবর্তিত রেখে স্মৃতি সংরক্ষণের যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। সবকিছু যেমন ছিলো তেমন হয়তো আছে। নেই খালি হারিয়ে যাওয়া সেই পরিচিত মানুষের কোলাহল। রান্নাঘরের লাগোয়া গাভীর গোয়াল ও মুরগীর খোপ খালি পড়ে থাকলেও খুপরি ভর্তি পায়রা। পায়রাদের বাকুম বাকুম শুনে পুত্রের মনে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধুর দুধেল গাভিটা এখন কোথায়, মুরগীগুলো কোথায়?

১৫ আগস্টের ভয়াল রাত্রির নৃশংসতা প্রাণীদের সহ্য হবার নয়। পায়রার দল হয়তো সেদিন উড়াল দিয়েছে দূরে আকাশে। বড়কষ্ট বুকে চেপে ফিরে আসেনি এই শূন্য ভিটায়। ডানা ছিলো বলে উড়ে যেতে পেরেছে। নতুন করে সংসার পেতেছে দূর দেশে। দুই জোড়া পাতি কাক বসে আছে কাঁঠাল গাছের ডালে । নিরব তারাও। এতো লোকজনের আনাগোনা দেখে হয়তো অবাক বিস্ময়ে ভাবছে, সে রাত্রে সবাই কোথায় ছিলো?

মুজি ভর্তি কাঁঠাল বৃক্ষের দিকে তাকাতেই বিস্মিত কাকেদের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় আমার। লজ্জায়, অপরাধবোধে চোখ নামিয়ে ফেলি। অবলা প্রাণীরা অকৃতজ্ঞ মানবসন্তানদের না জানি কত ধিক্কার দিচ্ছে?

বনেদি বাড়ির হেঁসেল বলে কথা। রান্না ঘরে খানা দুয়েক লোহার কড়াই, এলুমিনিয়ামের ডেক্সি মালকিনের স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে আছে হেলায়।
বড় পরিবারের সবাইকে সামলে গৃহকর্ত্রী হয়তো ক্লান্ত ছিলেন সে রাতে। খাবারের অবশিষ্ট পাতিলের তলায় লেগেছিলো। ভেবেছিলেন খুব ভোরে উঠে গুছিয়ে নিবেন সব। আর ভোরে উঠা হয় নি। রাতের শেষ প্রহরে নিস্তব্ধতা ভাঙে শত্রুর তান্ডবে। নির্বিচার গুলিতে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় সব কোলাহল। জীবনের মতো গুছানো হয়নি আর কিছুই।

খাবার ঘরে সাজিয়ে রাখা আছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। সাদা কালো শাড়িপরা কিউরেটরের একজন সহকর্মী পাশের চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছেন। কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে একটু চোখ মেলে আবার ঝিমুনি।

একে একে সবগুলো কক্ষে একবার উঁকি দেই। কোন কক্ষে প্রবেশের অনুমতি আছে, কোনটাতে নেই। নৃশংসতার নির্মম স্মৃতি বুকে ধারণ করে অনন্তকালের মতো নির্বাক প্রতিটা কক্ষ। তিন তলা, নিচ তলা, দোতলা। অতিথিশালা, লাইব্রেরি, বসার ঘর শোবার ঘর দেখতে দেখতে বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরের সামনে আসতেই থমকে যেতে হয়। দেয়ালের গায়ে লিখা বর্ণনা পড়ে অনায়াসে বিদীর্ণ হবে কোন পাষাণ হৃদয়। এক টুকরো কষ্টের দলা আমার কন্ঠের কাছে আটকে আছে। আমি বাকরুদ্ধ প্রায়। এখন আর পুত্রের প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনা। সন্তর্পনে এড়িয়ে যাই।
হিংস্র পাকিস্তানিরা তাদের আজন্ম শত্রু বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নয়মাস লুকিয়ে রেখেছিলো করাচির নির্জন কারা প্রকোষ্ঠে। মেরে ফেলার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও বন্দুকের ট্রিগার চাপতে হাত কেঁপেছিলো তাদের।

কে রোধে তার বজ্রকন্ঠ বাণী?
দেশ স্বাধীন হতে না হতেই দেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুকে অক্ষত ফিরিয়ে দিয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার।
বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরে কেউ আক্রমণ করবে না, করতে পারেনা। বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশায় জড়াজড়ি করে নারী শিশুরা সবাই এই ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলো। কেউবা ঢুকেছিলো খাটের তলায়। ঘাতকের নিষ্ঠুর হাতের নাগালের বাইরে যেতে পারে নি কেউ। বুলেটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন নারী শিশুদের দল পাখির মতো লুঠিয়ে পড়ে যেখানে সেখানে। মায়ের পেটের অনাগত শিশুও রক্ষা পায় নি এমন নারকীয় উল্লাস থেকে।
শিশু রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। রাসেলের ফিনকি দেওয়া রক্ত রঞ্জিত হয় এই বাড়ির ইট পাথরের দেয়াল। থেতলানো মগজের অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আটকে যায় শিলিংয়ের গায়ে।

কালো রক্তের ছোপ ও মগজের লেপটানো জায়গাকে অক্ষত রাখতে কাঁচ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বেগম মুজিবের লাশটাও নাকি উপুড় হয়ে পড়েছিলো রুমের সামনে।
যার তর্জনীর নির্দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিলো, যার জাদুমন্ত্রে নিঃস্ব বাঙালী শেষ সম্বল টুকু নিয়ে রুখে দিয়েছিলো পাক বাহিনীকে। সেই বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠ থেমে গেলো দেশীয় দানবরূপি বিপথগামী কিছু সৈনিকের গুলিতে। বুলেটের আঘাতে মহানায়কের নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে রইলো সিড়ির কোনায়। সাদা কাপড়, রক্তের দাগ, সিড়ির কোনায় জাতির পিতার নিথর দেহ। রক্তাক্ত এই ছবি অনেকবার দেখেছি পত্র পত্রিকায়। কি বিভৎস, কি নির্মম! শত্রুর নৃশংসতা কল্পনা করলেই গায়ে কাঁটা দেয় আমার।

আজ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে মনটা খালি ভারাক্রান্ত হয়নি দু চোখ ভরে জল আসে। এই কান্না ছোঁয়াছে নয়, এই কান্না অবধারিত। পুত্রের চোখ গড়িয়ে নামছে জলের ধারা। অশ্রু লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় দর্শনার্থীদের অনেকেই তখন চোখ মুছেন সন্তর্পনে।
নিজের মানুষের প্রতি কতটুকু গভীর মমতা আর বিশ্বাসে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি সেদিন সুরক্ষিত রাষ্ট্রীয় ভবন রেখে শুয়েছিলেন অরক্ষিত অতি সাধারণ এক বাড়িতে।

দেশের মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও পরম মমতার মুল্য দিলেন সপরিবারে জীবন দিয়ে। লাশের সৎকারও হয়নি প্রথামত।
ব্যর্থ, অকৃতজ্ঞ জাতির তালিকায় নিজেদের নাম পুনর্বার লিপিবদ্ধ করে আমরা আজ শাড়ির আঁচলে, টিস্যু বক্সে ও বাজারের থলেতে জাতির পিতার মুখচ্ছবি অংকন করে বিশ্বাসঘাতকতার দায় মেটাতে চাচ্ছি।

আজ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল ক্ষমতায়। জাতির পিতার কন্যা দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি। জীবনের মুল্যবান দিনগুলো কারাগারে কাটিয়ে নিজের ব্যক্তিসুখ বিসর্জন দিয়ে অভাগা জাতির জন্য স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা সর্বত্যাগী পিতার জন্মশতবর্ষ নিয়ে এদেশের মানুষের উত্তেজনা ও উচ্ছ্বাসের সীমা নেই।
পিতার অন্তিম মুহুর্তের কথা মনে করে গভীর বেদনায় আপনজন হারা প্রধানমন্ত্রী বললেন, "মুজিব বর্ষ নিয়ে কেউ অতি উৎসাহিত হবেন না।
এত উৎসাহী থাকলে ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর লাশ সেখানে পড়ে থাকত না। আমার মা (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) এবং পরিবারের সদস্যদের রেড ক্রিসেন্টের শাড়ি দিয়ে দাফন করা লাগতো না।

"সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়", প্রধানমন্ত্রীর সে খবর ভালো করেই জানা।
শাড়িতে, থলেতে আর টিস্যু বক্সে নয় জাতির পিতাকে ধারণ করুন অন্তরে, আত্মায়, মননে। মুজিব শতবর্ষে এই হউক আমাদের প্রত্যয়।

লেখক : শিক্ষিকা ও গল্পকার

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন