আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ইং

করোনা টক অব দ্যা কান্ট্রি নয়, একেবারে টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড

পূর্ণদৈর্ঘ্য জীবনের স্বল্পদৈর্ঘ্য রোজনামচা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৩-২০ ১১:২০:৩২

ফারজানা ইসলাম লিনু :: করোনাময় রোজনামচায় আমার একঘেয়েমি চলে এসেছে। টক অব দ্যা কান্ট্রি নয় একেবারে টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড। তামাশা নয়, এইবার করোনা নিয়ে আমি সিরিয়াসলি চিন্তিত। আমার চিন্তা অমূলক নয়। আল্লাহ প্রদত্ত এই গজবের মহামারী কোথায় গিয়ে ঠেকবে একমাত্র মাবুদই জানেন ভালো।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমি গৃহবন্দী। নিতান্ত জরুরি দরকারেও বাইরে যাইনা। স্বেচ্ছাবন্দীত্ব কেবল নিজের স্বার্থে নয়, দেশ-দশ ও তথা পুরো পৃথিবীর স্বার্থে।

বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত প্রথম লাশের সৎকার দেখে আমার নির্ঘুম রাত কেটেছে। গোসল, জানাজা ও কাফন বিহীন এমন অন্তিম যাত্রা কে চায়? পরিবার পরিজন জানের মায়ায় কাছে আসে নি মৃত্যুর পরেও। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করেছে।

এইসব খবরে গৃহকর্মে মন বসেনা। বই পাঠে আনন্দ লাগে না। টিভির সামনে দাঁড়াতেও ভয় লাগে। না জানি কোন বিভৎস আপডেট চোখে পড়ে। আজাইরা অহেতুক ক্যাচালে ভরা ফেসবুকে অনিচ্ছায় ঢু মারি। চরম বিরক্তিকর খবরের পাশে আশা জাগানিয়া কিছু খবর তো থাকে অবশ্যই।

ঢাকার গনস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল স্বল্পমূল্যের করোনা শনাক্তের কিট আবিষ্কার করেছে। অতি শীঘ্রই সেই কিট বাজারজাত করা হবে। এই কিটের কারণে কিছু মানুষ অন্তত মনের বাঘের মরণ ছোবল থেকে রক্ষা পাবে। সাধারণ সর্দি জ্বর ও গায়ের ব্যাথায় ভাববে না, এই বুঝি আমার করোনা হয়েছে।

তাবৎ দুনিয়ার এই দুর্দিনের কালে ফেসবুক কেন্দ্রিক ললনা আপুরা থেমে নেই। অতি ভোরে সেজেগুজে লাইভ আসেন রং ফর্সাকারী ক্রিম, জামা, জুতা,শাড়ি, আবায়া, হিজাব নিয়ে।

পণ্যের বাজার ধরে রাখতে করোনাকালীন সময়ে বিশেষ অফার। দুইটা কিনলে একটা ফ্রি, নয়তো ডেলিভারি ফ্রি দিচ্ছেন। কিয়ামতের জিরো পয়েন্ট পার হলে এই ডিজাইন, এই ম্যাটিরিয়েল যদি না পাওয়া যায়। তাই খাবার দাবারের পাশাপাশি কাপড় চোপড় ও প্রসাধনী মজুত চলছে ঘরে ঘরে।

আলু, তেল, চাল, পিয়াজের বাজারে আগুন লেগেছে রীতিমতো। মানুষ এফডিআর, সঞ্চয় পত্র ভেঙে কয়েক মাসের আগাম বাজার করে রাখছে। যার এফডিআর নেই সে আস্তায় পস্তায় ডায়বেটিস, প্রেসার বাড়িয়ে দুনিয়ার আয়ু তীব্র অনিচ্ছায় সংক্ষিপ্ত করছে।

এইদিকে গুণধর মন্ত্রীদের তি-বিটলামি কথাবার্তায় ব্রম্মতালু জ্বলে যাচ্ছে।

"শেখ হাসিনা থাকতে করোনা ভাইরাস আমাদের কিছু করতে পারবেনা।"

"শেখ হাসিনার মতো নেত্রী পেয়েছি বলে আমরা করোনা প্রতিরোধ করতে পেরেছি"।

"করোনা প্রতিরোধে ঢাকা বিমানবন্দরের মতো ব্যবস্থা উন্নত দেশগুলোতে নেই।"

ভয়ানক দুর্ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে যে দেশের মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেনা, উল্টো দাঁত কেলিয়ে হাসিমুখে আপদকালীন সময়ে জনগণের সামনে এসে দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলে, তাদের কাছে এর চেয়ে বেশি আশা করা যায় না।

তারপরও আমার ক্ষীণ আশা মন্ত্রীদের এমন তেলতেলা বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌছলে তিনি নিজেও বিরক্ত হবেন। আলাদীনের দৈত্যকে ডেকে বেফাঁস মন্ত্রীদের শক্ত খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতে বলবেন অন্তত করোনাকাল পর্যন্ত।

মন্ত্রীদের চেয়ে মোল্লারা আরো এক কাঠি সরেষ। আল্লাহর ঘর কাবা শরীফ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে করোনার কারণে। হাদিসে উল্লেখ আছে মহামারির বিস্তার রোধে মসজিদ যাতায়াত সীমিত ও বন্ধ করা যেতে পারে। মুসলিম দেশগুলোতে আজানের শেষে মুসল্লিদের ঘরে বসে নামাজ পড়ার আহবান জানানো হচ্ছে।

আর আমাদের দেশের মোল্লারা চড়া হাদিয়ার বিনিময়ে বিশাল মাহফিলে লাখো লোকের জমায়েতে ব্যাঘ্র কন্ঠে ঘোষণা করছেন, মসজিদ বন্ধ করার ঘোষণা আসলে আগুন ধরিয়ে দিবো।

করোনার বিস্তার রোধ ও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য গনজমায়েত নিষিদ্ধ জেনেও জায়গায় জায়গায় মাইক বাজিয়ে ওয়াজ মাহফিল, শিরনী বিতরণ হচ্ছে।

স্বগোত্রীয়দের নিয়ে অষ্টপ্রহর ব্যাপী হরিনাম সংকীর্তনেও পিছিয়ে নেই সনাতনীরা। কীর্তন শেষে সাদরে করোনাকে নিয়ে যাবেন নিজ গৃহে।

নব বিবাহিতদের পাশাপাশি বুড়ো ও আধাবুড়ারাও মধুচন্দ্রিমায় ব্যস্ত। যদি কিয়ামত হয়ে যায়,শুরু হয়ে যায় "লাইফ আফটার ডেথ"। সেই দুনিয়ায় যদি কক্সবাজার সী বিচ না থাকে, প্যালেস, গ্র‍্যান্ড সুলতান না থাকে, তাহলে কি হবে? মধুচন্দ্রিমা আটকে যাবে পরজনমে? এই আক্ষেপ নিয়ে কেউ করোনায় মরতে চাচ্ছিনা। দলবেঁধে সবাই মধুচন্দ্রিমায়, হলিডে উদযাপনে।

পুলিশ আর্মি দিয়ে ঝেঁটিয়ে পর্যটকদের বিদেয় করা ছাড়া উপায় নেই। বিভিন্ন জায়গায় প্রশাসন কঠোর অবস্থানে। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে বারুণী স্নান ও পর্যটকদের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এছাড়া পুরো বড়লেখায় যে কোন গন জমায়েত পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে। নিঃসন্দেহে মহতি ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

শিক্ষিত ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বিদেশ সফর শেষে হোম কোয়ারেন্টিন না মেনে সভা সমাবেশে অংশগ্রহণের পাশাপাশি গলাগলি, কোলাকুলি করছেন মহা আয়েশে। করোনা ছড়ানোর নৈতিক দায়িত্ব পালন শেষে বলছেন, ভুল হয়েছে আর এমন হবে না।

কিন্তু ততোদিনে যা হবার তাতো হয়ে গিয়েছে। এইদিকে হাসপাতালে কানাডা থেকে আগত রোগী ভর্তি হয়েছে। এই খবরে ডাক্তার, নার্স, রোগী সবাই কোনকিছু যাচাই না করে করোনা, করোনা চিৎকার করে পালিয়ে যায়। অসহায় রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো। অথচ মেয়েটা করোনা আক্রান্ত ছিলো না।

আবার করোনা রোগী দর্শনে হাসপাতালে হাজার হাজার মানুষের ঢল সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। পুলিশ ডেকে মাইকিং করে বলতে হচ্ছে এইখানে কোন করোনা রোগী নেই।

বিদেশ থেকে প্রত্যাগত কেউ নিজ বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টিনে আছে সেখানেও উৎসুক মানুষের ঢল। বাড়ির সদর গেইট বন্ধ পেয়ে দেয়াল টপকে, গাছ বেয়ে সেই বাড়িতে হানা দিচ্ছে কোয়ারেন্টিনে থাকা এলিয়েনকে দেখতে।

করোনা থেকে বাঁচতে ইতালি, ফ্রান্স থেকে আগতরা এখন আর বউকে মোটরবাইকের পেছনে বসিয়ে গ্রামের বাজারের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি লাড্ডু খেতে যেতে পারছেন না। গণধোলাইকারীরা খুব তৎপর।

কোয়ারেন্টিন ভেঙে কাউকে বাড়ির বাইরের হাঁটাহাঁটিতে দেখলে গনধোলাই দিয়ে তাকে কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। ধোলাই দেওয়া লোকটার যদি করোনা থাকে তাহলেতো সেরেছে। হারপিক দিয়ে হাত ধুয়েও রক্ষা নাই।

চারদিকে মৃত্যুর নিরবতা। কিন্তু আমাদের বিটলামি থেমে নেই। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো করোনা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

এই কঠিন গজব থেকে বেঁচে গেলেও দুর্ভিক্ষের ধকল কাটিয়ে উঠতে আমাদেরও হিমশিম খেতে হবে। জমিয়ে রাখা খাদ্যে আর কয়দিন যাবে?

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন