আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

নিউজ ইন দ্য টাইম অব করোনা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৩-২৪ ০০:২৩:০৮

জসিম উদ্দিন :: সাহিত্যে নোবেলজয়ী কলম্বিয়ান লেখক ও ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত প্রেমের উপন্যাস ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা।’ মার্কেসের দৃষ্টিতে দুর্যোগ বা মহামারিতে প্রেম করা যতটা কঠিন তার চেয়ে আমার কাছে বেশি কঠিন মনে হচ্ছে ‘করোনার সময়ে সংবাদ পরিবেশন।’ এই লেখা লিখতে গিয়ে বিশ্বে কী ঘটছে খুঁজতেই দেখলাম ভুয়া নিউজ আর অপপ্রচারের বন্যায় ভাসছে পৃথিবী৷

প্রথমেই আসি ফেসবুক প্রসঙ্গে। সারাবিশ্বে ফেসবুক এখন সবচেয়ে বড় যোগাযোগ মাধ্যম, প্রচারমাধ্যম বা গণমাধ্যমও বলা যায়। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ইদানিং করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী এক মহামারী আকার ধারণ করেছে। যার প্রভাব ব্যাপকভাবে বাংলাদেশেও পড়েছে। করোনাভাইরাস সম্পর্কে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি গুজব, অপপ্রচার বা ‘ভূয়া নিউজ’ ছড়ানো হচ্ছে। আজ কয়েকদিন ধরে দেখছি আমার ফেসবুক ইনবক্সে একটি ‘অডিও ক্লিপ’ আসছে এবং সেখানে এক ডাক্তার বলছেন চট্টগ্রামে নাকি অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। সরকার এইগুলি প্রকাশ করছে না। এই ‘অডিও ক্লিপ’ ছড়ানোর পর সরকার কিছু একটা ‘লুকাতে চাচ্ছে' বলেও মনে করছেন কেউ কেউ৷ আশার কথা হল এই গুজব ছড়ানো লোকটিকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি নাকি গুজব ছড়ানোর কথা স্বীকারও করেছেন।

ফেসবুকে কেউ কেউ আবার বলছেন, ‘করোনা আল্লাহর গজব।’ চীন, ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ নাকি পাপী তাই তাদের ওপর ‘আল্লাহর গজব’ পড়েছে। কিন্তু এই ‘গজব’ যে বাংলাদেশের ওপরও ব্যাপকহারে পড়ছে তা কি ভেবে দেখেছি আমরা? বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের হার দিনদিন বাড়ছে। ইতিমধ্যে দেশের তিনজন মারাও গেছেন। আসলে প্রত্যেকটা মহামারিই ‘আল্লাহর গজব।’ এই ‘গজব’ যেকোনো দেশের ওপর, যেকোনো ব্যক্তির ওপর যেকোনো সময় পড়তে পারে। এই তো কিছুদিন আগে আমাদের দেশে ডেঙ্গুজ্বরে অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছেন। তবে এই ‘গজব’ কেবল বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও পড়েনি!

ফেসবুকে আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে ইদানিং। এক হুজুর বলছেন, করোনাভাইরাসের সাথে স্বপ্নে মামুন নামের এক যুবকের কথোপকথন হয়েছে। চীনে নাকি কয়েকজন সৈনিক মিলে আয়েশা নামের এক মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করেছে। তাই আল্লাহ্‌ গজব হিসেবে করোনাভাইরাস পাঠিয়ে দিয়েছেন! বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের আক্রমণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে করোনাভাইরাস নাকি বলেছে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে বাংলাদেশে যারা ইসলামবিদ্বেষী তাদেরকে ছাড়বে না করোনাভাইরাস। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হল যে, এই ‘ইসলামফোবিয়ায়’ আক্রান্ত হয়ে আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত যুবক এই ভিডিওগুলো প্রচার করছে!

ফেসবুকে আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাঁর দেশের সাধারণ নাগরিকদের সাথে ছবি তুলছেন। করমর্দন করছেন। তবে ভিডিওটি যে অনেক আগের সেটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তা না হলে যেখানে তিনি একমাসের জন্য সারাদেশ ‘লকডাউন’ করে দিয়েছেন সেখানে এত মানুষের সমাগম হতে পারে না। তিনিও এই পরিস্থিতিতে এভাবে জনসমক্ষে আসতে পারেন না। প্রকৃতপক্ষে ভিডিওটি তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তখনকার। এই ভিডিওটিকে বাংলাদেশের কিছু অতি আবেগী মানুষ আমাদের দেশের সরকারের সাথে তুলনা করছেন, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কানাডা এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে বেকার ভাতা থেকে শুরু করে সবধরনের ভাতা দিয়ে থাকে সরকার। অর্থাৎ ওইসব দেশে কেউ চাকরি বা কাজ না করলেও তাকে না খেয়ে মরতে হয় না। সরকার তার ভরণপোষণ করবে। আর এটা নাগরিকদের প্রাপ্যও। কারণ কানাডার মত উন্নত দেশের সকল নাগরিকই তাদের আয়ের একটা বিরাট অংশ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বাধ্য থাকে। আমাদের দেশে নিয়মিত কয়জন আয়কর দেন সেটা আমরা নিজেদের দিয়েই বিচার করতে পারি!

এবার আসি আমাদের তথাকথিত নিউজপোর্টাল প্রসঙ্গে। চীন থেকে শুরু করোনা মহামারিতে বিশ্বপরিস্থিতি যখন খুবই নাজুক, সাংবাদিক ভাইয়েরা তখন পেয়ে গেলেন সংবাদের খনি! যারা শুধু মার্কেটে ‘খাবে ভালো' বিবেচনায় সংবাদ প্রকাশ করেন, তাদের সঙ্গে মাস্ক বিক্রেতাদের তেমন কোনো ফারাক দেখি না৷ ফলে ‘কী খায় চীনারা', ‘চীন থেকেই কেনো ভাইরাস ছড়ায়' ‘সবই কী ষড়যন্ত্র?' ‘করোনা চীনের বা আমেরিকার পারমাণবিক ভাইরাস’ ‘করোনা আক্রান্ত হলেই মৃত্যু’ ‘করোনা ঠেকাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাস্তায় ৮০০ বাঘ-সিংহ ছেড়ে দিয়েছেন’ ইত্যাদি শিরোনামের খবর নাম না জানা অসংখ্য পোর্টালে শোভা পাচ্ছে। মাঝে-মধ্যে ফাঁকফোঁকর পেড়িয়ে ঢুকে পড়ছে মূলধারার এবং জনপ্রিয় গণমাধ্যমেও৷ এটা সত্যিই হতাশাজনক।

কোনো কিছু ঘটলেই সেটা থেকে নিজেরা কিভাবে ফায়দা লোটা যায়, সে ধান্দায় ব্যস্ত আমাদের ব্যবসায়ী ভাইয়েরা৷ বাংলাদেশে হঠাৎ মাস্কের দাম বেড়ে গেছে, কিন্তু এই মাস্ক দিয়ে ভাইরাস কতটা প্রতিরোধ করা যায় সেটা আমার বোধগম্য নয়। যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেক্ষেত্রে মাস্ক কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে সেটা বোধগম্য নয়। শুধু মাস্ক নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিচ্ছেন গুজব ছড়িয়ে।

করোনায় সারাবিশ্ব যখন থমথমে পরিস্থিতি তখন আমাদের সাধুবাবারা বসে থাকবেন কেনো? তারাও ‘কারিশমা’ দেখাতে উঠেপড়ে লাগলেন। তাইতো করোনার প্রতিষেধক হিসেবে ভারতের এক রাজ্যে সাধুবাবা গোমূত্র পান করছেন! গোমূত্র পান করে ‘কারিশমা’ দেখাতে গিয়ে তিনি নিজেই ভর্তি হলেন হাসপাতালে।

যাই হোক, করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হলেই মারা যাবেন, এমন কথা চিকিৎসকরাও বলছেন না৷ বরং অনেক আক্রান্তই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন৷ গুজব না ছড়িয়ে, ভয় না ছড়িয়ে, আসুন চিকিৎসকদের কথা শুনি৷ কী কী সাবধানতা অবলম্বন করলে শুধু করোনা নয়, যেকোনো রোগের সঙ্গে লড়াই করে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করা যাবে, সেদিকে লক্ষ্য দেই৷

২০১৭ সালে প্রকাশ করা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, ১৫ বছর ধরে পৃথিবীতে মানবমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হৃদরোগ৷ ২০১৭ সালে বিশ্বে বিভিন্ন রোগে মানুষ মারা গেছেন প্রায় ৫৬ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫ কোটি ৬০ লাখ। এদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন হৃদরোগে। তাই হৃদরোগ যে এক নিরব মহামারি সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জানা যায়, ইদানিং করোনাভাইরাসে যারা মারা গেছেন তাদের ৪৮ শতাংশই নাকি স্ট্রোক করে মারা গেছেন।

আশার কথা হল সারাবিশ্বে করোনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৪ হাজার, আক্রান্ত ৩ লাখের বেশি এবং সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১ লাখেরও বেশি। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে করোনায় আক্রান্ত হলেই মৃত্যু অনিবার্য নয়। সচেতন থাকলে করোনা আক্রমণ করতে পারবে না। চিকিৎসায় করোনা থেকে মুক্তি পাওয়ায় যায়। করোনা নিয়ে এত আতংকিত না হয়ে সচেতন হোন, শান্ত থাকুন৷ গুজবে কান দিয়ে, বিদ্বেষ ছড়িয়ে আসুন কোমল হৃদয়ে আর চাপ না বাড়াই। সবাই সুস্থ থাকুন। নিরাপদে থাকুন। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সচেতন থাকুন।

লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, বানিয়াচং আইডিয়েল কলেজ।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন