আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

আমরা ইতালি হতে চাই না

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৩-২৪ ১১:৩২:৩৭

প্রফেসর ড. জহিরুল হক শাকিল :: আমি যখন লেখাটি লিখছি তখন রাত ১১টা ৩০ মিনিট। করোনায় বিশ্বব্যাপি আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯ শ ৪৬ জন। মারা গিয়েছেন ১৬ হাজার ১ শ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ১ হাজার ৬৫ জন। পাঠকের কাছে যখন পত্রিকাটি যাবে তখন হয়তোবা মৃতের সংখ্যা ১৭ হাজারে পৌছাবে। চীনে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন শুরু হলেও এর জন্য করুণ পরিণতির শিকার হতে হয়েছে ইতালির মানুষজনকে। সেখানে ইতোমধ্যে ৬ হাজার ৭৭  জন মারা গেছেন। আরো ৪ হাজারের  অবস্থা সংকটাপন্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে এটাকে সারা বিশ্বের জন্য মারাত্মক মহামারি হিসেবে ঘোষনা দিয়েছে। যা দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। 
ইতালিতে ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম করোনা আক্রান্ত হয়ে একজন মারা যান। সংবাদপত্রে লেখা হয়ঃ "ইতালির পদুয়া শহরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এই প্রথম একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর পরপরই দেশটির ১০টি শহর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে জনসমাগমস্থলে যাওয়া। দেশটিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১৭-তে পৌঁছেছে।" আর আজ ২৪ মার্চ অর্থাৎ ১ মাসের ব্যবধানে  মৃতের সংখা ৬ হাজার অতিক্রম করেছে। সেটা কতোতে গিয়ে ঠেকবে কে জানে? ইতালির অসহায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা প্রাণপন চেষ্ঠা করেছি। এখন আমাদের আকাশের দিকে থাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কী করার আছে? 
কী ঘটেছিল ইতালিতে? তারা শুরুতে বলা শুরু করলো এটা কেবল বিদেশ ফেরত বিশেষতঃ চীন ফেরতরা আক্রান্ত হবেন। কারণ ৩১ জানুয়ারি ইতালিতে প্রথম কোভিড-১৯ রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় রোমে; তারা হলেন দুইজন চাইনিজ পর্যটক। এর এক সপ্তাহের মাথায় একজন ইতালিয়ান আক্রান্ত হন যিনি চীনের উহান শহর থেকে ফিরেছেন। কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তাদের এ ভুল ভাঙলো। এর পরদিনই লোম্বার্ডিতে ১৬ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যাক্তিকে শনাক্ত করা হয়। যাদের বেশির ভাগই ইতালিয়ান। শুরুতে ইতালি সরকার কিছুটা ধীর চলা নীতি অনুস্মরন করে। প্রথমে শহর, পরে প্রদেশ, পরে সারা দেশ লকডাউন করে। এছাড়া লোকজনের কথা বার্তাও ছিল মিশ্র ধরণের। তাদের শিল্পকারখানাও শুরুতে বন্ধ ঘোষণা করেননি।  যা করোনাভাইরাসকে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রির মতো ইতালির লোম্বার্ডি প্রদেশের গভর্নর আত্তিলো ফন্টানা ২৫ ফেব্রুয়ারী সংসদে মন্তব্য করেন “এটা সাধারণ জ্বর থেকে সামান্য একটু বেশি। আর এ মন্তব্যের পরদিনই শহরে লোকজনের আনাগুনা বেড়ে যায়। অথচ এই প্রদেশেই করোনা পরিস্তিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। অপরদিকে যখন একের পর এক শহর ও প্রদেশগুলো লক ডাওন হওয়া শুরু হয় তখন মিলানের গভর্নর ‘মিলান বন্ধ হবে না’স্লোগান নিয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেন। যার ফলে নাগরিকরা হয়ে পড়েন বিভ্রান্ত। এর খেসারত মিলান আজ সহস্র জীবন দিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া শুরুতে করোনা সনাক্ত করতেও তাদের প্রচুর সময় লাগে। 
আশা করি পাঠকরা বুঝে উঠতে পেড়েছেন ইতালি থেকে আমাদের দুরত্ব কতদূর। আমরা শেষ পর্যন্ত অফিস আদালত বন্ধ করলাম। কিন্তু বেশ দেরী হয়ে গেল। আবার আমাদের সবচেয়ে বড় সেক্টর গার্মেন্টস কিন্তু বন্ধ করা হলো না। সেটা প্রধানমন্ত্রী গার্মেন্টস মালিকদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের মানুষের চরিত্র আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানার কথা না। যেখানে গার্মেন্টস সেক্টরের নূন্যতম বেতন আপনাকে ধার্য্য করে দিতে হয় সেখানে কীভাবে আপনি আশ্বস্থ হলেন যে তারা বিবেকের দ্বারা তাদের উৎপাদন বন্ধ করবে? 
এখন আসা যাক, আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে। করোনা করোনা কিন্তু আমরা ৩ মাস ধরে শুনে আসছি। আমাদের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রিরা বার বার বলেছেন আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু এখন কী দেখলাম? যারা করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সামনের কাতারের যোদ্ধা আমাদের সেই চিকিৎসক ও সেই খাতের কর্মীরাই নিরাপদ না। তাদের গ্লাভস নেই, মাস্ক নেই, পিপিই নেই। সলিমুল্লাহ মেডিক্যালতো বলেই দিয়েছে যে তাঁরা এসব সরবরাহ করতে পারবে না। এছাড়া নেই কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল। করোনার আক্রান্তের সন্দেহ রয়েছে এমন রোগীরা কোথায় যাবেন? এরকম দিক নির্দেশনা কি জনগন এখন পর্যন্ত পেয়েছেন? কিছুক্ষণ পূর্বে দেখলাম ঢাকার কয়েকটি হাসপাতাল প্রস্তুতের। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রি কীভাবে বলেন যে আমরা চীনের মতো একটি হাসপাতাল বানিয়ে ফেলবো। দেশের একজন মন্ত্রী কোন দায়িত্বে বলেন কেউ কেউ দেশে আতংক ছড়াচ্ছে, আসলে করোনা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ না। যাই হোক, আমরা অসহায়। আমাদেরকে সরকারী আপডেট বিশ্বাস করতে হয়। সরকার আমাদের যে আপডেট দিচ্ছেন তাতে সারাদেশে ২৭ জন আক্রান্ত। ৩ জন মারা গেছেন। প্রতিদিন ৩/৪ জন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার ৩/৪ জন সুস্থ হচ্ছেন। এগুলো কি করোনার গ্রামারের সাথে যায়? আমাদের এটা বিশ্বাস করেই থাকতে হবে। 
সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, করোনা আতংকের মাঝে অনেক সাধারন রোগী যথাযথ চিকিৎসার অভাবে মারা যাবেন। আবার অনেক করোনা আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে না গিয়ে নিজ বাসায় আরো অনেককে সংক্রমিত করে মারা যেতে পারেন। এগুলো একটু বিবেচনায় এনে আমাদের সামনের দিকে এগুতে হবে।এবার আসা যাক, আমরা আম জনতা কী করছি। আমরা দল বেধে সেনিটাইজার, মাস্ক, প্রচারপত্র ইত্যাদি বিলি করছি। করোনা সচেতনতায় সভা করছি। অথচ এর সবকটিই করোনা সংক্রমনের জন্য ঝুকিপূর্ণ। আমি তো মাইকে প্রচারেরও পক্ষপাতি না। মাইক প্রস্তুত করা, মাইকিং এর যানবাহন প্রস্তুত করা, লোকজনকে মাইকিং এ পাঠানো। এগুলোও কি ঝুকির মধ্যে না? অথচ আমরা পাড়ার মসজিদের মাইকে মোয়াজ্জিন বা ইমামের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে পারি। 
যাই হোক, আমাদের আরো অনেক দ্বায়িত্বহীনতা রয়েছে। স্কুল অফিস বন্ধ হলো আর আমরা সবাই গ্রামে ছুটলাম। সে কী আড্ডা। মনে হচ্ছে এটা কোনো ঈদের ছুটি। আমার অনেক ছাত্ররা আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে, স্যার গ্রামের মানুষ এগুলা নিয়ে হাসাহাসি করে। সবাই দোকানে, বাজারে বসে আড্ডা দেয়। খেলাধুলা করে। একজন আরেক জনের বাসায় বেড়াতে যায়। দাওয়াত খায়। একজন আরেক জনের বাসায় আড্ডা দিতে আসে। আড্ডার বিষয় অবশ্য করোনা। যাই হোক, আমার তাদের জন্য করুনা হচ্ছে। দেখা যাক সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আমাদের পরিস্থিতির উন্নতি হয় কি না। 
লেখক : প্রফেসর- শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।  

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন