Sylhet View 24 PRINT

ইতালি বনাম বাঙালি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৩-২৭ ০০:১৮:৪১

জসিম উদ্দিন :: প্রিয় পাঠক শুভেচ্ছা নিবেন। আমার লেখার শিরোনাম দেখে অনেকে ভাবতে পারেন আমি কোনো দুই দেশের মধ্যে কোনো খেলা বা প্রতিযোগিতার কথা লিখতে যাচ্ছি। আসলে মোটেই তা নয়। বিশ্বব্যাপি এখন আলোচনার ইস্যু একটিই ‘করোনাভাইরাস।’ করোনা ইস্যুতে ইতালি এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি তূলনামূলক আলোচনা করতে যাচ্ছি।

আজ (২৬ মার্চ) সন্ধ্যা ৭ টায় এই লেখা যখন লিখছি তখন করোনাভাইরাসে ইতালিতে মৃতের সংখ্যা ৭ হাজার ৫০৩ জন আর বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা মাত্র ৫ জন। আক্রান্ত ৪৪ জন। আমেরিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। স্পেনে মারা গেছেন ৩ হাজার ৪৩৪ জন।

এবার আসি মূল আলোচনায়। অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে বাঙালি বীরের জাতি। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাঙালি বড় বড় দূর্ভিক্ষ, বড় বড় প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে। যেকোনো দূর্যোগ মোকাবেলায় বাঙালির জুড়ি নেই। যে-কোনো সংকটময় মুহুর্তকে কাটিয়ে ওঠার যে ক্ষমতা, আমাদের যে ব্রেন পাওয়ার- কারণ সবসময় দুর্যোগের মধ্যে আমরা বসবাস করে এসেছি। আমাদের পূর্ব পুরষরা এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের কোনো জুড়ি নেই। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে জয়লাভ করবে বাঙালি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ বাঙালির রয়েছে রোগ-প্রতিরোধের অসীম ক্ষমতা!

অনেকেই মনে করে থাকেন যে, ইতালির মত এত আধুনিক এবং উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকতে তারা কিছুই করতে পারছে না। আর আমরা! হ্যাঁ, আমরাই পারবো। কারণ ইতালিয়ানদের চেয়ে আমাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। ইতালিসহ ইউরোপ-অ্যামেরিকানরা মাসে ১/২ দিন গোসল করে থাকে। তাও আবার গরম পানি দিয়ে। চিকিৎসা গবেষণায় দেখা গেছে যে গরম পানির চেয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে নিয়মিত যারা গোসল করে থাকে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। তাছাড়া অনিয়মিত গোসলও রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণ। আর বাঙালিরা গোসল করে ঠান্ডা পানি দিয়ে নিয়মিত। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে তো করোনা প্রবেশই করতে পারবে না। কারণ গ্রামের মানুষের খাবারের তালিকায় বেশি থাকে প্রাকৃতিক শাকসবজি যেটাকে এখন করোনা পরিস্থিতিতে বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া গ্রামের মানুষ ঠান্ডা পানি দিয়ে নিয়মিত গোসল করার পাশাপাশি পুকুরে সাতারও কেটে থাকেন যে কারণে তাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। আমাদের দরকার শুধু সাবধানতা এবং সচেতনতা।

ইতালিতে মৃত্যু কেন এত বেশি?
দেখা যাচ্ছে ইতালিতে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ওখানে সিজনাল ফ্লু সবসময়ই বেশি। কারণ ইতালিতে বয়স্ক লোকদের সংখ্যা হচ্ছে পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এবং করোনার ঝুঁকির চেয়েও ঝুঁকি কিন্তু হচ্ছে যদি তার আগে ক্যান্সার থাকে, লিভারের সমস্যা থাকে, কিডনির সমস্যা থাকে, ডায়াবেটিস থাকে, হার্টের সমস্যা থাকে। অর্থাৎ আগে থেকে যারা রোগগ্রস্ত এবং বয়স্ক ইতালিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তারাই মারা যাচ্ছে। এজন্য ইতালিতে এত মৃত্যুর মিছিল। এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও যে ৫ জন মারা গেছেন তাদেরও সবার বয়স ৬০ এর উপরে এবং আমরা জেনেছি যে তারা ডায়াবেটিসসসহ বিভিন্ন জঠিল রোগে ভুগছিলেন।

সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনায় যত মানুষ মারা গিয়েছেন তার চেয়ে প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যান এর চেয়ে বেশি মানুষ!
আসলে আমরা যেটাকে জ্বর-সর্দি-কাশি বলি, ইউরোপ আমেরিকাতে এটাকেই ফ্লু বলা হয়, ইনফ্লুয়েঞ্জা বলা হয়। অর্থাৎ এই জিনিসটা হচ্ছে নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, শীতকালের রোগ। শীত আসা এবং শীত যাওয়ার সময়।
Center for Disease Control and Prevention (CDCP) সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ সালে মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে পাঁচ লক্ষ জনকে, মারা গেছে ৩৮ হাজার।
২০১৭-১৮-তে সিজনাল ফ্লুতে আক্রান্ত হন সাড়ে চার কোটি আমেরিকান। হাসপাতালে ভর্তি হন ৮ লক্ষ ১০ হাজার। মৃত্যু ৬১ হাজার।
২০১৮-১৯-এ আক্রান্ত হন সাড়ে তিন কোটি আমেরিকান। হাসপাতালে ভর্তি চার লক্ষ ৯০ হাজার ৬০০ জন। মৃত্যু হয়েছে ৩৪ হাজার ২০০ জন। এবং করোনায়, আমেরিকা এখনও সেই অবস্থায় পৌঁছায়নি। গত তিন বছরের তুলনায় করোনায় যদি মৃত্যুর হার আমরা দেখি, এটাতো উল্লেখ করার মতন কিছু না। আমরা তুলনা করলেই কিন্তু বুঝতে পারি যে ফ্লু-তেও করোনার চেয়ে প্রত্যেক বছর কত বেশি পরিমাণে মানুষ মারা যায়!

রোগ যেমন কয়েক বছর পর পর পাল্টায়, আতঙ্কটাও কয়েক বছর পর পর শুরু হয়!
আর বাস্তব সত্য হচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের নামে যে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে এটা ফ্লুরই একটি ভ্যারিয়েশন। যেটা কখনও সার্স নামে, কখনও সোয়াইন ফ্লু নামে, কখনও আরেক ফ্লু নামে- বিভিন্ন সময়ে নতুন নামকরণ, কারণ প্রত্যেকটা রোগের ধরণ কিছু কিছু বছর পরে পাল্টায় এবং আতঙ্কটাও এই কিছু কিছু বছর পরে শুরু হয়, যে যখন একটা নতুন নামকরণ করা যায় তখন।

বাঙালির আতঙ্কের গ্রামার
আসলে আমাদের আতঙ্কের একটা গ্রামার আছে। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে প্রথমে জিনিসটা যে কত ভয়াবহ, ওখানে কত লোক মারা গেছে, কত ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, কত ধ্বংস হয়েছে, কত অসহায় হয়ে গেছে, সরকার কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে, দেশে পর্যাপ্ত এই নাই সেই নাই, এটাকে প্রচার করা। আমরা নিজে সচেতন না হয়ে এটাকে শুধু ফোলাতে ফাঁপাতে থাকি। আমাদের সমস্যাটা এখানেই। আসলে আতংকের গ্রামারটাকে আমরা খুব সহজেই আয়ত্ব করতে পারি। অথচ বিশ্বজুড়ে একই কথা বলা হচ্ছে যে, আতংকিত না হয়ে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, পরিস্কার-পরিচ্চন্ন থাকতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
 
ভবিষ্যতে কত ভয়াবহ হতে পারে!
ওই আতংকটা ফুলতে ফুলতে একময় ফেটে যায়, আসল সত্যটা বেরিয়ে আসে, তখন আবার বলা শুরু হয় যে ভবিষ্যতে কত ভয়াবহ হতে পারে! কত ক্ষতি হতে পারে! যার দরুন বাস্তব সত্য জানার পরও আমরা আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না। বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ধরা পড়েছিল খুব সম্ভবত মার্চের ১৩ তারিখ। আতংকের গ্রামারে পারদর্শীরা বলেছিলেন ইতালিতেও এভাবে একজন দিয়ে শুরু হয়েছিল। আমাদের অবস্থা ইতালির চেয়েও খারাপ হবে! করোনা আক্রান্তে রোগীর সংখ্যা নাকি বাড়বে জ্যামিতিক হারে অর্থ্যাৎ ২, ৪, ৬, ৮, ১০ এই হারে বাড়বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। বাংলাদেশ তো দূরের কথা খোদ ইতালিতেও জ্যামিতিক হারে বাড়েনি। তাই আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। করোনাভাইরাস অন্যান্য ভাইরাস যেমন সার্স ফ্লু, সোয়াইন ফ্লুর মতই একটি ভাইরাস। আতংক না ছড়িয়ে সচেতনভাবে একে মোকাবিলা করতে হবে।
 
দরকার সচেতনতা আর পরিচ্ছন্নতা শুদ্ধাচার
পরিশেষে আবারও বলি বাঙালি সাহসী জাতি। এবং করোনাকে এই জাতির ভয় পাওয়ার কিছু নাই। তো আমরা শুধু সতর্কতামূলক যে ব্যবস্থা সেই ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব। আসলে শুধুমাত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত যে শুদ্ধাচার এই শুদ্ধাচার যদি আমরা অনুসরণ করি এবং আমরা অধিকাংশই এটা অনুসরণ করি। যে কারণে আমাদের এখানে করোনার সুযোগ করতে পারার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। যদি আমরা একটু সচেতন হই এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করি। আর যেটা ডাক্তাররা বলছেন, মানে সরকার বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছেন, আইইডিসিআর বলছেন যে হাতটাকে ভালোভাবে ধোয়া এবং হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মেনে চলা। আগামী দশদিন বাড়িতে থাকা। জরুরী প্রয়োজনে বাহিরে গেলে একজন আরেকজন থেকে দুই ফিট/তিন ফিট দূরত্ব মেইনটেইন করা। একজন আরেকজনের বডি-টাচের মধ্যে না যাওয়া। এটা একটা সুন্দর পদক্ষেপ। এই নিয়ম মেনে চললে আমরা করোনাভাইরাস থেকে খুব সহজেই দূরে থাকতে পারি।


লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, বানিয়াচং আইডিয়েল কলেজ।
তথ্যসূত্রঃ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, WHO, CDCP.

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.