আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

গুজবের শক্তি, গুজব থেকে মুক্তি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৩-২৭ ২২:৩৪:৩০




|| জসিম উদ্দিন ||

বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান। তিনি ‘পণ্ডশ্রম’ নামে লিখেছিলেন একটি বিখ্যাত কবিতা। কবিতাটি এরকম-
এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।
যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে,
পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে।
সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।
মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?
নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।
ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।

কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতার মত বাংলাদেশে এভাবেই মাঝে মধ্যে অসংখ্য গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তেই এই গুজব পাড়া থেকে মহল্লায়, মহল্লা থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে সারাদেশ ব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে। ইদানিং সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এই গুজব আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে। ফলে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা, অসন্তোষ। 

গুজব কী?

আসুন প্রথমেই জেনে নেই গুজব কি।  মনোবিজ্ঞানীদের মতে, 'গুজব হলো একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে কমিউনিটির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া একটি বিবৃতি বা গল্প, যা সত্য-মিথ্যার মাপকাঠিতে যাচাইকৃত নয়।' 

বাংলাদেশে কিছুদিন পরপর হরেক রকম  গুজব ছড়িয়ে পড়ে। যেমন সাঈদিকে চাঁদে দেখা গেছে, পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে-তাই সারাদেশে ছেলেধরা চলছে, বাজারে লবণের দাম বেড়ে যাবে, পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাবে। তাছাড়া ধর্ম অবমাননার অসংখ্য  গুজব তো আছেই। 

গুজবের শক্তি
গুজবের সমাজতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন রবার্ট এইচ নাপ। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত তার “সাইকোলজি অব রিউমার’ বইয়ে গবেষক রবার্ট এইচ ন্যাপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বকালীন গুজবকে বিশ্লেষণ করে একে তিনভাগে ভাগ করেছেনঃ-
১. পাইপ ড্রিম রিউমার: এটি সাধারণত জনগণের মনের দৃঢমূল ধারণাকে পূজি করে হয়। (যেমন: পেয়াজের সংকট হয়েছে, তাই লবণ নিয়ে গুজব ছড়ানো।

২. ভগি বা ফিয়ার রিউমার: এটি সাধারণত জনগণের ভয়কে কাজে লাগিয়ে করা হয়ে থাকে। (যেমন: আল্লাহ্ ভীতিকে কাজে লাগিয়ে সাঈদীকে চাঁদে দেখানো। কারণ সাঈদী ধর্ম এবং আল্লাহর গুনকির্ত্তন করে ভালো ওয়াজ করেন। করোনায় যখন বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মানুষ ভীত, ঠিক তখনই বাংলাদেশের কোনো একটা অঞ্চলে হঠাৎ গুজব উঠল যে রাত দুইটায় ভূমিকম্প হবে!)
   
৩. রিউমার অন বিলিভ: বিশ্বাসকে ভিত্তি করে গুজব ছড়ানো। (যেমন: এক শিশু মৃত্যুর আগে তার মা বাবাকে বলে গেছে চিনি ছাড়া লাল চা পান করলে করোনাভাইরাস আক্রমণ করতে পারবে না।) 

তো বাংলাদেশে রবার্ট নাপের এই তিন ধরণের রিউমার বা গুজব খুব বেশিই লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত প্রচণ্ড বিশ্বাসপ্রবণ। ধারণাপ্রসুত কথা বলার প্রবণতা শক্তিশালী। যেকোন বড় মানুষ সম্পর্কে হরহামেশা শোনা কথা ছড়িয়ে দেয়া হয়। যদিও এখানে প্রবাদ আছে,‘শোনা কথায় কান দিতে নেই।’

গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বাসপ্রবণ এবং ধারণাপ্রসুত কথা বলার প্রবণতা যে অঞ্চলে যত বেশি গুজব কার্যকর সেখানে তত বেশি হয়। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার হারের কারণে কোন গুজব হলেই তারা অস্থির না হয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তারা তথ্য নিশ্চিত করতে চান। বাংলাদেশেও ইদানিং গুজবের বিরুদ্ধে সোস্যাল মিডিয়া সোচ্চার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এই গুজবের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছেন।

গুজব থেকে মুক্তি: 
গুজব থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমেই শিক্ষাটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ গুজবের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, শিক্ষার আলো যেসব অঞ্চলে তূলনামূলকভাবে কম সেখানে গুজব ছড়ানো হয় বেশি। দ্বিতীয়ত, গুজবের বিরুদ্ধে যে বিদ্যমান আইন রয়েছে এর যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।

আসুন জেনে নেয়া যাক গুজবের শাস্তি সম্পর্কে কোন দেশের আইন কি বলে:

আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতের গুজবের বিরুদ্ধে যে আইন রয়েছে তা হল গুজব ছড়ানো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩ বছরের কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। চীনেও ৩ বছরেরে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক জনপ্রিয় পত্রিকা খালীজ টাইমস এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, আরব-আমিরাতে অনলাইন আইন অনুযায়ী অনলাইনে গুজব ছড়ানো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের ধরন অনুযায়ী ৩ বছর থেকে যাবজ্জীবন জেলসহ ৩ মিলিয়ন দিরহাম জরিমানার কথা বলা হয়েছে। সৌদি আরবেও এই অপরাধে ৫ বছরের জেলসহ ১ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল জরিমানার কথা বলা হয়েছে।
গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী গুজব রটনাকারী অপরাধীর শাস্তি ২ বছরের কারাদন্ডসহ জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার আইন আছে। যদিও আইনের প্রয়োগ আমাদের দেশে খুব একটা হয় না। দেশে যথাযথ আইনের শাসন থাকলে গুজব থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া যেত।

গুজব সম্পর্কে ইসলাম ধর্ম যা বলে:
গুজব ছড়ানোর পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মানুষকে বিভ্রান্ত করা। তাদের আতঙ্কিত করা। মানুষের ভেতর বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করাকে কোরআনে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তারা তোমাদের সঙ্গে বের হতো, তবে শুধু বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি পেত। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তারা তোমাদের ভেতর ছোটাছুটি করত। তোমাদের ভেতর তাদের কথা শোনার (বিশ্বাস করার) লোক রয়েছে। আল্লাহ অত্যাচারীদের সম্পর্কে অবগত আছেন।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত: ৪৭)

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত অনেক সংবাদের সঙ্গে সামাজিক স্বার্থ জড়িত থাকে। এমন সংবাদের প্রচার মানুষকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে রক্ষা করে এবং কখনো কখনো বড় ধরনের বিপর্যয় থেকেও আত্মরক্ষার উপলক্ষ হয়। এমন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারেও ইসলামের নির্দেশনা হলো, সংবাদ প্রচারের আগে অবশ্যই তা যাচাই করে নিতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের কাছে যদি কোনো ফাসেক ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করো। অজ্ঞতাবশত কোনো গোষ্ঠীকে আক্রান্ত করার আগেই, (না হলে) তোমরা কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৬) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তরের প্রতিটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে।’   (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৬)

কোন খবর দেখলেই যাচাই বাছাই করা ছাড়া তা বিশ্বাস করা অনুচিত। কোরআনে ভুল তথ্য অনুসরণ করা নিষেধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন-‘মানুষের মধ্যে গুজব প্রচারই হল ভয়ংকরতম মিথ্যা।’ (মুসলিম শরীফ)। মূলত গুজব হল, যার কোন ভিত্তি নেই। মিথ্যা খবর অপ-প্রচার করে মানুষের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে খুব সহজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে যা সত্যিই হতাশাজনক।

গুজবের কারণে সমাজে প্রতিনিয়তই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। কখনও কখনও জীবন বিপন্ন হচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে যে, ইদানিং যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব প্রচার করা হচ্ছে সেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই অনেক সচেতন ব্যক্তি গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন। গুজব রটনাকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির দাবী জানাচ্ছেন। সমাজে এসব বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে শাস্তি নিশ্চিত করলেই সমাজ থেকে এ অভিষাপ দূর হতে পারে।

লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, বানিয়াচং আইডিয়েল কলেজ।

তথ্যসূত্রঃ চ্যানেল আই, উইকিপিডিয়া, ইত্তেফাক, ইনকিলাব, খালীজ টাইমস, আল-কোরান বাংলা মর্মবানী

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন