আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং
শাকির আহমদ :: পৃথিবীর সর্বত্র এখন করোনাভাইরাসের বিধ্বংশী কালো থাবায় কুপোকাত। ব্রিটেনের রাণী, প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ কেউ রেহাই পাচ্ছে না এর ছোঁবল থেকে। সারাবিশ্ব যেখানে আতঙ্কিত ঠিক তখন আমরা অনেকটা উদাস। কয়েকটি দেশের চিকিৎসকরা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভেকসিন তৈরির জন্য দিনরাত গবেষণা করছেন। হয়তো আমরা ভেকসিন পাবো তবে দেখার বিষয় এর আগে পৃথিবী থেকে কত মানুষকে কেড়ে নেয় করোনা।
পৃথিবীব্যাপী করোনা আতঙ্কে যখন দেশে দেশে ফ্লাইট বন্ধ, সড়ক রুট বন্ধ, অফিস আদালত বন্ধ তখন ২৪ ঘণ্টা খোলা চিকিৎসকের দরজা। কথায় আছে, যে আদর করতে জানে, সে শাসনও করতে পারে। আমাদের দেশে চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের আবেগ ও বিশ্বাসের মাত্রা বেশী তাই তাঁদের কপালে গালিটাও বেশী তবুও তাঁরা রাগ করে সরে যান না। মানুষকে বিপদে ফেলে তাঁরা পালিয়ে যায় না। কিছুটা আক্ষেপ, কিছুটা কষ্ট বুকে ধারণ করেও তাঁরা বুঝতে দেন না। তাঁদের প্রতি মানুষ যেমনই আচরণ করুক তাঁরা বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামান না। শুধু পীড়া দেয় কর্তাব্যক্তিদের বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য। বিশ্বজুড়ে করোনা প্রতিরোধে চিকিৎসকদের যখন বিকল্প নেই তখন আমাদের দেশে সময়মতো পান না তাঁরা সুরক্ষা সামগ্রী। হাত পেতে বসে থাকতে হয় ওপরমহলের দিকে। নিজেদের সুরক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্রস্তুতি থাকুক বা না থাকুক তাঁরা ব্রত আছেন মানবসেবায়। তবুও যেন তাঁদের প্রতি মানুষের বিরূপ মন্তব্য কমে আসে। অনেকের ধারণা নেই, এদেশে ক্যাটাগরিতে বিসিএস পাশ করে চিকিৎসকরা কিন্তু গাড়িসহ বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত কিন্তু বিসিএস পাশ ছাড়াও তাঁদের অধিনস্ত অনেকেই গাড়ি দৌঁড়ায়, চায় খবরদারি করতে। এতে তাঁরা অপমানবোধ করলেও বুঝতে দেন না। রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি তো সম্মান প্রদর্শণ করতেই হবে।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত, উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত মর্যাদা ও প্রয়োজনীয় সহযোগীতা করা রাষ্ট্র ও আমাদের নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করি।
দেশের সব সরকারী অফিস আদালত ছুটি ঘোষণা হয়েছে। নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থানের কথা থাকলেও সবাই স্বজনের সন্নিকটে যেতে হুমড়ি খেয়ে লঞ্চ, ট্রেন, বাসে চড়ে বসেন। কিন্তু কর্মস্থল থেকে যান নি বা যেতে পারেন নি দেশের সরকারী-বেসরকারী চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সাংবাদিকরা।
যদিও শ্রেণীভেদে প্রত্যেকের কাজ ভিন্ন তবে চিকিৎসকদের বেলায় সম্পূর্ণ আলাদা। নিজের জীবনের প্রতি মায়া ত্যাগ করে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে মানবসেবায় ব্রত। অন্য সময় থেকে এসময়টা ভিন্ন। কখন যে করোনাভাইরাস তাঁকে আক্রান্ত করে ঠিক নাই। তবে তিনি প্রস্তুত। প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করবেন তবুও মানবসেবা থেকে সরে যাওয়া যাবে না।
করোনায় আক্রান্ত রোগী আর তার স্বজনরা বুঝবে চিকিৎসকের কদর। ওইসময় তারা সৃষ্টিকর্তার পর যদি কারও ওপর ভরসা করে সে একজন চিকিৎসক। কারণ, স্বজনদের বিশ্বাস থাকে রোগীর প্রতি চিকিৎসকের আন্তরিকতা ও সেবাই পারে করোনা থেকে মুক্তি দিতে।
কিন্তু আমাদের দেশে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও ঝুঁকি কাটাতে পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম কি দেয়া হচ্ছে? যেখানে তাবৎ দুনিয়া চিকিৎসকদের সবার আগে অগ্রাধিকার দিয়ে করোনা মোকাবেলায় করণীয় ঠিক করছে ঠিক তখন আমাদের দেশের চিকিৎসকরা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। যেখানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশ করোনা মোকাবেলায় অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্ময়ে কমিটি গঠন করছে সেখানে আমরা উল্টো ব্যবস্থাপনায় সময় কাটাচ্ছি। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজেই চিকিৎসক নন। জেনেছি তিনি ইংরেজীতে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন মেধাবী।
স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে নিয়ে মন্তব্য করাটা ঝুঁকির তবুও বলতে হচ্ছে সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষকে দায়িত্ব দেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক্ষেত্রে 'সুপাত্রে কন্যা দান' প্রবাদটা অনুসরণ করার প্রয়োজন ছিলো। নিজে যখন দেশবাসীকে সামাজিক দূরুত্ব বজায় রাখার কথা বলছিলেন তখন উনার আশপাশ, পিছনে সাঁয়ত্রিশ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। স্ববিরোধী বক্তব্য অবশ্য শুধু তিনি একা দিচ্ছেন যে তা না। আরও অনেক মন্ত্রী, এমপিরা এরকম দায়সারা বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন।
এমন স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন আমাদের কপালে তখন চিকিৎসকরা অসহায়ত্ব প্রকাশ ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না। এরমধ্যে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীদেরও বেঁফাস মন্তব্যে চিকিৎসকদের বেলায় শুধু অবজ্ঞা প্রকাশ হয়েছে।
গত ২৪ মার্চ রেশান জুনাইদ খালেদিন নামে এক চিকিৎসক নিজের করোনাভাইরাস রিপোর্ট পজেটিভ উল্লেখ করে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেন। তিনি রিপোর্ট জেনে প্রথমেই নিজের মাকে কল করে বলেন, 'মা, ছোটবেলা থেকে যদি কোন ভুল করে দিও, মাফ করে দিও'। ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় মা বললেন, 'বাবা, কি হয়েছে বাবা? কেন এমনটা বলছিস?' জুনাইদের মতো আরও দুইজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন আমরা জেনেছি।
চিকিৎসকদেরও একটা পরিবার আছে। তাঁদেরও স্বাদ আহ্লাদ আছে। পরিবার, পরিজন রেখে তাঁরা আমাদের সেবায় ব্যস্ত। আজ দেশ তথা বিশ্বের এই সঙ্কটকালীন সময় চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। তাঁদের সুরক্ষা সামগ্রী দিয়ে, যথাযথ সম্মান প্রদর্শণ করা এখন সময়ের দাবি। তাঁদেরকে মন থেকে ভালোবাসুন। দোয়া করুন তাঁদের জন্য। একটিবার ভেবে দেখুন, চিকিৎসক ছাড়া আমরা কেমন অসহায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণে রণাঙ্গণে যুদ্ধ দেখিনি, বই পুস্তক পড়েছি আর গল্পে শোনেছি। ২০২০ সালে শুধু দেশ না বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ চলছে। এযুদ্ধ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়। এযুদ্ধ অদৃশ্য এক অপশক্তির বিরুদ্ধে যার নাম করোনাভাইরাস। দেশে দেশে যুদ্ধ চলছে। আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে। এযুদ্ধের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশ থেকে দেশ দেশান্তরের সকল চিকিৎসক, এযুগের মানবযোদ্ধা। উনারা স্বাস্থ্যযোদ্ধা, আমাদের ভালোবাসা।
যদি পারতাম বর্তমানে আমাদের দেশের প্রত্যেক নিষ্ঠাবান চিকিৎসককে বুকে জড়িয়ে ধরে আকাশ সমান ভালোবাসা দিতাম।
লেখক: নিজস্ব প্রতিবেদক, কুলাউড়া, সিলেটভিউ২৪ডটকম।