আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

একজন মানবিক ডায়নামিক সাংবাদিক জুয়েল সাদত’র কথা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৬-২৬ ১৪:১৭:১৪

একজন মানবিক ডায়নামিক সাংবাদিক জুয়েল সাদত’র কথা

II রোকসানা পারভীন II
সময় এখন দুঃ সময়

হোম কোয়েরাইন্টেনে টিনএজ মনটা হাঁপাচ্ছে।
অক্সিজেনের ব্যাগের শেষটায় যতটুকু তরল থাকে,
তা পাইপের মধ্যে প্রবাহিত না হবার কষ্টে পুড়ায় মন

২৪ ঘন্টায় দিন, মনে হচ্ছে ৩৬ ঘন্টায় আটকানো;
জীবনের সব ভুলগুলো, স্পাম ফ্লোল্ডার থেকে দৃশ্যমান,
মাপ করে দিও তিথি তানহা, অনিতা, প্রমা আমায়।
আমি কিন্তু সব সময় সিরিয়াসই ছিলাম,
তোমরাই লিপিয়ারের মত দৃশ্যমান হলে অসময়ে।

হোম কোয়ারান্টাইনে আজ আমি একজন সশ্রম কারাবন্দী
আমি কিন্তু, বাসন ক্লিন,বিছানা করা, ফ্রিজ ক্লিন  করতে শিখেছি।
জান কল্পনা, এই কাজগুলো একটি বোর্ড মিটিং থেকেও কঠিন
যখন লেবার স্ট্রাইকে যায়, তা হ্যান্ডল করা যতটা সহজ,
এর চেয়ে কঠিন বাসার তিনটা বিছানা করা,
আমি হোম কোয়ারান্টাইনে জীবনের হিসাবের খাতায় ঘষামাজা করছি, হাল খাতার মত।

আমি আবার ত্রিশ সেকেন্ড নয়, পুরো  তিন মিনিট হাত ধুচ্ছি।
কিন্তু ভেবে পাচ্চি না, ময়লা বা ভাইরাস তো আমার হাতে নয়, সেটা আমার মনেই।
আমি গুনে গুনে চৌদ্দ  দিনেই শুধরে নেব, আগাছায় ভরা আমার জীবন।
আমি দুঃসময়টাকেই সুসময়ে রুপান্তরের পথে হাঁটছি,

জান কল্পনা, করোনা যাদের মেরেছে, আমিও তাদের দলে।
আমি আমার ভাইরাসে পুরো জীবনটাই পাল্টে দিলাম।



কবিতাটা জুয়েল সাদতের। নাম ‘সময় যখন দু:সময়’। একজন আপাদমস্তক সাংবাদিক, কমিউনিটি একটিভিস্ট। টক শো’র হোস্ট। বহুমাত্রিক পরিচয়ে পরিচিতি থাকলেও তিনি  একজন বড় মাপের কবি। হ্যাঁ বলছিলাম জুয়েল সাদতের কথা। অনেকেই দেশ বিদেশে এই নামের সাথে সুপরিচিত। এই করোনাকালীন যে সময়টা আমরা পার করছি সেই সময়টায় আমেরিকায় বসে যে হাতেগোনা ক’জন সংবাদকর্মী জোরালো ভুমিকা রেখেছেন, রেখে যাচ্ছেন তাদের অন্যতম একজন জুয়েল সাদত ।

জুয়েল সাদতের সাথে আমার পরিচয়টা খুব বেশি দিনের নয়। পড়েছি একই ক্লাসে ভিন্ন জেলায় ভিন্ন স্কুলে। সারা বাংলা ৯০ (এসএসসি) এই গ্রুপ পেইজটার বদৌলতে দেশে বিদেশে পেয়েছি ভাল কিছু বন্ধুর সন্ধান। সেই ভাল বন্ধুদের একজন জুয়েল সাদত। গত সাড়ে তিন মাস যখন সারা বিশ্ব আটকে পড়েছে ঘরে। ঠিক তখনই ঘরে বসে আবিষ্কার করলাম একজন মুক্ত মনের মানবতাবাদী কবি, অকুতোভয় সাংবাদিক, সঞ্চালক জুয়েল সাদতকে। এই করোনাকালীন সময়ে সবাই যখন ঝিমিয়ে পড়েছেন নিজ ঘরে। ভেবে পাচ্ছেন না, কি করে সময় কাটাবেন! তখন জুয়েল সাদত ব্যস্ত তাঁর প্রবাস বাংলা টিভি চ্যানেল থেকে আমেরিকার পঞ্চাশটা প্রদেশের প্রতিদিনের করোনাকালীন সময়ের লাইভ আপডেট দিতে শুরু করেন। যুক্ত হোন অন্যান্য সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে সাম্প্রতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে লাইভ আলাপচারিতায়, কখনো বিতর্কে। কথা বলেন তার টিভি চ্যানেল ছাড়াও অন্যান্য টিভি চ্যানেলে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সিলেটের প্রথম করোনাযুদ্ধে শহীদ ডা. মঈন উদ্দিনকে নিয়ে। তিনি আমন্ত্রন জানান এই সময়ে অর্থাৎ করোনাকালীন সময়ে ফ্রন্ট লাইনে কাজ করতে থাকা ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানী, কন্ঠশিল্পী , নাট্যশিল্পী, আবৃত্তিশিল্পী, ডাক্তার  ও  করোনা বিশেষজ্ঞদের। তার সবগুলো আয়োজনই লাইভ থাকায় হাজার হাজার দর্শক সুযোগ পায় তাদের জিজ্ঞাসা, ভাল লাগা বা গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রকাশ করার। তার অনেক অনেক লাইভ প্রোগ্রামের মধ্যে একটা লাইভ ইন্টারভিউর কথা উল্লেখ না করে পারছি না। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষুদে করোনা বিশেষজ্ঞ সিজদার সঙ্গে করা একঘন্টার একটা ইন্টারভিউ। এই ইন্টারভিউটা সাথে সাথেই ভাইরাল হয় এবং ৩০ লক্ষ দর্শক সেই ইন্টারভিউ উপভোগ করেন এবং তাদের ভাললাগা, মন্দলাগা, সিজদার জন্য ভালোবাসা, দোয়া করেন। চমৎকার এক ঘন্টার ইন্টারভিউটাই সিজদাকে আজ সুপার স্টার বানিয়েছে। সাত বছরের সিজদার জন্য সৌভাগ্যের দরজা খুলে দেন জুয়েল সাদত। জুয়েল সাদত করোনাকালীন সময়ে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখেছেন, তার মধ্যে কয়েকটি গান হিসাবে প্রকাশের অপেক্ষায়। তার প্যারিস কাঁদে কবিতাটি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে। কবিতাটি পড়লে আপনাদেরও ভাল লাগবে ।

প্যারিস কাঁদে, মোনালিসা কাঁদে
আমরা লাশের মাতম দেখি
বুক ফেটে যায়, স্বজনদের আর্তনাদে  ।

প্যারিস কাঁদে, মোনালিসা কাঁদে ক্যানভাসে
রঙহীন আইফেল টাওয়ারটা ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে
মানুষদের চিহ্ন খুঁজে  ।

মুত্যুর আলিঙ্গন থেকে বেঁচে যাওয়া আমরা,
মোনালিসা ও আইফেল টাওয়ারে কাছে বড্ড বেমানান,
প্যারিস কাঁদে, জনমানবহীন ইউরো স্টার কাঁদে

ফরাসী সভ্যতার দুয়ারে আজ লাশের মিছিল
প্রিয়াহীন শহরটাতে প্রিন্সেস ডায়না ট্যানেলে আটকা পড়ে,
প্যারিস কাঁদে, রংহীন আইফেল টাওয়ার কাঁদে
মোনালিসা'র মুচকি হাসিতে কান্নার অশ্রুবরণ।
 
প্যারিস ভাল নেই, তাই আমিও ভাল নেই
আমি ভাল নেই, তাই প্যারিস ও ভাল নেই।
প্যারিস কাঁদে। তাই আমিও কাঁদি।
আমি কাঁদি, তাই পুরো প্যারিসটাই কেঁদেকেটে একাকার।


জুয়েল সাদত একজন নির্ভীক সাংবাদিক। এই করোনাকালীন সময়ে আমেরিকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ভাইরাসটির দ্বারা। তার মধ্যে তিনি আমাদের ঘুরিয়ে আনেন এবং দেখানোর চেষ্টা করেন ফ্লোরিডার বিভিন্ন রাস্তা, সাবওয়ে, বিচ, রেল স্টেশন, এয়ারপোর্টের বর্তমান চালচিত্র। দেখানোর চেষ্টা করেন আমেরিকার জনজীবন, প্রাণীর প্রতি মানুষের সচেতনতা।

তিনি তার লাইভগুলোতে দেখান আমেরিকার বিভিন্ন স্থান। বিষয় নির্বচান ও লোকেশনগুলো আমাদের আনন্দ দেয়। বিশেষ করে ফ্লোরিডা রেলস্টেশন ও এয়ারপোর্টের ভিতরের সচল লাইভ, পাশাপাশি ঈদের নামাজ ও ফ্লোরিডার বিচ থেকে করা তার লাইভগুলো দেখে মনে হয়েছে, জুয়েল কোন সাধারনমানের সাংবাদিক নন। অনেক উঁচু তার চিন্তাভাবনা। তিনি ২৩ দিনের মধ্যে দু’বার সংরক্ষিত ওরলান্ডো ইন্টান্যাশনাল এয়ারপোর্ট দেখিয়েছেন তার অগনিত ভিউয়ারদের। তার আউট সাইটের লাইভগুলো দেশ বিদেশের অনেকের জানার সুযোগ করে  দিয়েছিল। তিনি সাধারনমানের কোন সাংবাদিক নন। তিনি প্রায় পঞ্চাশটির মতো নানান অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে ছিলেন। করোনা, বর্তমান বিশ্ব, আমেরিকার সাদাকালোর দাঙ্গা, বাংলাদেশের নানা বিষয়ে তার সুচিন্তিত মতামতে ছিল জানার নতুনমাত্রা।

তিনি লন্ডনের জনপ্রিয় প্রবাস বাংলা টিভির পরিচালক ও ‘হ্যালো আমেরিকা’র হোস্ট । তিনি প্রবাস  বাংলা টিভির মাধ্যমে নানান অনুষ্ঠানে তুলে এনেছিলেন করোনাকালীন সময়ে সারা বিশ্বের সংবাদ। তিনি লিখেন করোনাকালীন সময়ের জীবন ঘনিষ্ঠ কবিতা। এর মধ্যেই সময় বের করে তিনি চেষ্টা করেন পরিবারের সঙ্গে। তার বাচ্চাদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর। তার বাচ্চাদেরকে যুক্ত করেন তার কাজে সাহায্যকারী হিসাবে। তাই অনেক সময় তার কথায় লেখায় করোনাকালীন সময়কে উল্লেখ করেন আর্শীবাদ রূপে। তিনি তার প্রবাস বাংলা টিভিতে আয়োজন করেন আন্তর্জাতিক আড্ডা ‘ঈদের সেকাল একাল’। এখানে পাঁচটি দেশের বর্তমান সময়ের সাত জন কবি ও লেখিকাকে আমন্ত্রণ জানান সেই আড্ডায়। সৌভাগ্যবশত আমার সুযোগ হয়েছিল সেই লাইভ আনন্দ আড্ডায় শরীক হওয়ার। জুয়েল সাদতের লেখা, লাইভ অনুষ্ঠান বা তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠানের শেষে যে কথাগুলো খুব আলোড়িত করে সেগুলো হচ্ছে এই দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদটি। তিনি সবাইকে আহ্বান জানান যাদের সামর্থ্য আছে তাদের সদকা, যাকাত, ফিতরার টাকাগুলো অসহায় মানুষদের সাহায্যার্থে দান করতে। তিনি করোনাকালীন দু'বার ফেসবুক ফান্ড রাইজিং করেছিলেন, হতাশ হয়েছেন। তবে থেমে যাননি। সিলেট বিভাগসহ আরও তিনটি জেলাতে তিনি চ্যারিটি করেছেন ব্যাক্তি উদ্যাগে। জুয়েল সাদত মানবিক বহুমাত্রিকগুনের পরিচয় আমার নিকট দৃশ্যমান হয়েছে এই গত তিন মাসে। মাত্র তিন মাসের পরিচয়ে আমার নিকট মনে হয়েছে আরও আগে পরিচয় থাকলে ভাল হত। আমার লেখালেখি, গল্প,কবিতা নিয়ে সবসময় পরামর্শ করেন। অসম্ভব পিপল পারসন, বিনয়ী একজন মোটিভেটর। আমি ব্যাক্তিগতভাবে তার কাছ থেকে অনেক অনুপ্রেরণা পাই। শত ব্যস্ততায় থাকলেও রেসপন্স করেন। তিনি তিনটি টিভির এ্যাংকরের সাথে অনেকগুলো ফেসবুক পেজের এডমিন। সব চালিয়ে যাচ্ছেন। কভিড-১৯ কালীন সময়টাতে যদি কেউ জুয়েল সাদতের ফেসবুকে একটু ঢুকেন তাহলে দেখতে পারবেন তার কাজের সরব উপস্থাপনা। আমি কম লিখছি, কম জানি তাই। তিনি অনেক কাজ করেছেন, করে যাচ্ছেন। গেস্ট হিসাবে দেশ বিদেশের নানান টিভিতে ছিল তার সরব উপিস্থিতি। ঘন্টার পর ঘন্টা হোস্ট নানা প্রশ্ন করলেও তিনি সব কিছুর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মানুষকে নানানভাবে  সচেতন করেছেন। রাত দিন ছিলেন, আছেন একটিভ। করোনা নিয়ে তার কবিতা, লেখালেখি ইতিহাসে স্থান পাবে। করোনা নিয়ে  জুয়েলের কবিতা দেশের সেরা আবৃত্তিশিল্পীরা আবৃত্তি করেছেন এবং ভুয়সী প্রশংসা করেছেন।

 তিনি মনে করেন এবারের ঈদ না হয় একটু কম জাঁকজমকপূর্ণহীনই হলো। কোরবানীর ঈদে যেন আমরা সাশ্রয়ী হই। আমাদের একটু সচেতন হলে দেশের কিছু অসহায় মানুষের মুখে একটু হাসি ফুটবে। আমি আমার বন্ধু জুয়েলের মধ্যে যে গুনটি খুব বেশি পরিমান দেখি, সেটি হচ্ছে মানুষের সমালোচনাগুলোকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিতে পারা। কোন প্রতিকূলতায় সহজে হাল না ছাড়া। আমি বিশ্বাস করি একজন কলমযোদ্ধা, কবি, নির্ভীক সাংবাদিক জুয়েল সাদত তাঁর নিজ মানবিক গুণাবলী, সহনশীলতা আর পরিশ্রম দিয়ে এগিয়ে যাবেন বহুদূর। তাঁর জন্য শুভ কামনা নিরন্তর। জুয়েল আমার বন্ধু, আমার এই তিন মাসের চেনাজানা বন্ধুটাকে নিয়ে গর্ব অহংকারের শেষ নেই আমার। আমকে যে এতো সুন্দর করে উপদেশ দেয় সে কোন সাধারন কেউ নয়। সে চারটি  শিক্ষাপ্রতিষ্টান চালায়। অসহায় এলাকার জন্য তার আবেগ থেকে আমি নিজেও অনেক কিছুতে জড়ালাম। প্রায় প্রতিদিনই তার নতুন নতুন কাজের সাথে পরিচিত হচ্ছি আর অপলক চোখে দেখি পঞ্চাশের আগেই সে অনেক কাজ করে ফেলেছে। হিংসা করি না, প্রতিযোগিতা করি। তার সবচেয়ে বড় একটি গুণ বলে লেখাটা শেষ করবো। তা হল মানুষকে মুল্যায়ন করা। যারা তার টিভি শো’তে যান তারা ভাল বলতে পারবেন। অতিথিদের সে এমনভাবে উপস্থাপন করে যা অনন্য। আর অনেক ষ্টাডি করে টিভি অনুষ্টান করে। যা সচরাচর দেখা যায় না। এই অনন্য মানুষটাকে  নিয়ে  আরও লিখব। আমি বহুমাত্রিক জুয়েল সাদতের সুস্বাস্থ্য কামনা করি ।

লেখাটি শেষ করবো তার আরেকটি কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে-

এখন করোনাকাল
ভালোবাসাটাকে আগলে রাখার সীমাবদ্ধতা পোড়া দে
এখন হাত ধুতে ধুতে কালো হাতটাই সাদা ।

এখন করোনাকাল,
প্রিয়ার লিপস্টিকের খরচটা দিয়েই চ্যারিটি করি,
এখন গৃহবন্দি জীবনটাকে উল্টে পাল্টে সেদ্ধ করি
মেল্টেড যে জীবনটা দৃশ্যমান,
তাতে স্ত্রীর সব খুনটুসি বড্ড বে-হিসাবী।

এখন করোনাকাল,
মরে গেছে নরম সকাল,
সামান্য তাপমাত্রায় ভাষ্প নিতে হয় মধ্যদুপুরে,
২৪ ঘন্টার পোড়া মনটার রোমান্টিকতায় শুভ রাত্রি।

লেখিকা : কবি ও শিক্ষিকা। ওনটারিও, কানাডা

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন