আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

শুভ জন্মদিন প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৬-২৭ ১১:১৯:১২

আশরাফ আহমেদ :: সিলেটের  সবুজ ক্যাম্পাস বলে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ কলেজের  জন্মদিন আজ।  এখন থেকে প্রায় ১১ যুগ আগে ১৮৯২ সালে রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় তার পিতামহ মুরারিচাঁদের নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

সূর্য ডুবেছে, সূর্য উঠেছে তারপর মাস পেরিয়ে বছর, পেরিয়ে যাচ্ছে যুগের পর যুগ  আর এদিকে মুরারিচাঁদ  কলেজের সুনাম আর পথচলাও ধাবিত হচ্ছে  সামনের দিকে।

 এমসি কলেজ নামে পরিচিত কলেজটি পূর্বে সিলেটের বন্দর বাজারের নিকট রাজা জি. সি. উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত ছিল। পরে জায়গা সংকুলান না হওয়ার ধরুন পরবর্তীতে শহরের  টিলাগড় ( পূর্ব নাম থ্যেকারে টিলা) নামক জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়। যার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, তৎকালীন আসাম প্রদেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী  খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ সিআইই। যিনি কাপ্তান মিয়া নামে পরিচিত ছিলেন। সেই থেকে  শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দুরে নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে চলছে এখানকার পাঠক্রম।১৮৯১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটিতে এফ. এ. ক্লাস খোলার অনুমতি দিলে ১৮৯২ সালের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে মুরারিচাঁদ কলেজের যাত্রা শুরু হয়।   সেই থেকে হাটিহাটি পা পা করে কলেজটি আজ পূর্ণ করলো ঐতিহ্য আর গৌরবের ১২৮ বছর।
 
 প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত  থেকে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলেজটি প্রথমে ঢাকা ও পরে  চট্টগ্রাম  বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে আসে। পরে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলে চা'য়ের দেশের এই প্রতিষ্ঠানটি তার অধিভুক্ত  থেকে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

তৎকালীন আসাম প্রদেশের একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ১৬ টি বিষয়ে অনার্স, ডিগ্রি ( ডিগ্রি পাস) ও কয়েকটি বিষয়ে মাস্টার্স সহ উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান শাখা চালু রয়েছে।

 গুটিকয়েক  শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করা বিদ্যাপীঠটাতে বর্তমানে ১৪ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এসব শিক্ষার্থীকে ঘিরে  জ্ঞ্যানদানে ব্রত আছেন ১৩২ জন শিক্ষক শিক্ষিকা। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণীর শতাধিক  কর্মকর্তা-কর্মচারী এখানকার শিক্ষা-কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে আছেন। মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়ার ফলস্বরূপ প্রতিষ্ঠানটিকে একনাগাড়ে তিনবার অঞ্চল সেরা কলেজের স্বীকৃতি দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটি বরাবরই কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে চলছে। এখানে থাকা রোভার স্কাউটস ও বিএনসিসির ইউনিটটি সিলেট বিভাগের সেরা ইউনিট হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। সাথে জাতীয় পর্যায়েও বিভিন্ন পদক অর্জন করে  কলেজের সুনাম অক্ষুন্ন রেখে চলছে। শুদ্ধসুরে জাতীয় সংগীত প্রতিযোগীতায় এখানকার শিক্ষার্থীরা বরাবরই জয়েরমুকুট চিনিয়ে নিয়ে এসেছে।

কলেজটিকে এই অঞ্চলের  সুস্থ সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের চারণভূমি বলে মনে করা হয়।  বর্তমানে এখানে ১২ টি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।এখানকার  একমাত্র  থিয়েটার  "থিয়েটার  মুরারিচাঁদ " মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার স্বীকৃতি হিসেবে  ২০১৭ সালে জয় "বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড" অর্জন করে। কলেজের মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠনটি এই অঞ্চলের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠনের খ্যাতি অর্জনের সাথে নিজেদের সেরাটা দেখিয়ে চ্যালেন আই ক্লোজআপ ১, আরটিভি ডাবর বাটিকা, মাছরাঙা, টেলিভিশন সহ জাতীয় পর্যায়েও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলছে। এখানে থাকা সাহিত্যিক সংগঠন মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদটি সৃজনশীল কাজের ধারা সিলেট বিভাগের শীর্ষ সাহিত্য সংগঠনগুলোর একটি হিসেবে ইতিমধ্যেই নিজেদের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

২০১৮ সালে দেশের তৃতীয় কোন কলেজ হিসেবে ছায়া জাতিসংঘ নামে আন্তর্জাতিক মানের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে এখানকার কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী। মুরারিচাঁদ  ডিবেট ফেডারেশনটি বিভাগের সেরা দলের তালিকার সাথে জাতীয় পর্যায়েও নিজেদের সুনাম ধরে রেখে চলছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন " বিটিভির জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ও দলটি নিজেদের সেরাটা দিয়ে কলেজের মুখ উজ্জ্বল করেছে।  এছাড়াও ব্যান্ড দল, রক্তদান সংগঠন সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রমের মাধ্যমে  ক্যাম্পাসটিকে নতুনরুপে সকলের সামনে তুলে ধরে চলছে । এক্ষেত্রে কলেজ প্রশাসনের বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতা ও ইতিবাচক মানসিকতা আর আন্তরিকতা চোখে পড়ার মতোই।

২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর  কলেজটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় এখানে থাকা সংবাদ কর্মীদের একমাত্র সংগঠন এমসি কলেজ প্রেসক্লাব। পরবর্তীতে এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি নামে পরিবর্তিত হওয়া সংগঠনটি সাহসী ও ব্যতিক্রমী সংবাদ পরিবেশনের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই  জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের জানান দিতে সক্ষম হয়।

দেশের সুপ্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটি একবিংশ শতাব্দির প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকেও ডিজিটাল করে নিয়েছে ।জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই সবুজ এই ক্যাম্পাসটি। ১৪৪ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত বিশাল ক্যাম্পাসটিতে, আবাসিক  ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্য অত্যাধুনিক আলাদা দুটি  ছাত্রাবাস, ও ছাত্রীবাস রয়েছে।  খেলাধুলা করার জন্য আছে বিশাল মাঠ। চারদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মাঠটিতে একই সঙ্গে কয়েকটি দল খেলা করতে সক্ষম। সিলেট বিভাগের সেরা এই কলেজটিতে একটি সুপ্রাচীন লাইব্রেরী রয়েছে। মুঘল স্থাপত্যের ধাঁচে নির্মিতব্য গ্রন্থাগারটিতে পাঠ্যবই ছাড়াও, কবিতা,  গল্প, উপন্যাস,  বিভিন্ন ধরনের জার্নালসহ প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি বই রয়েছে। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধীনে থাকা  কলেজের বোটানিক্যাল গার্ডেনটি সিলেট বিভাগের সর্বপ্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন।

 তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এখানকার   শিক্ষার্থীদের এগিয়ে রাখতে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের একটি শাখার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের  বিভিন্ন মেয়াদি  কোর্স পরিচালনা করা হয়।

দেশের সপ্তম  প্রাচীন  এই কলেজটি সুস্থ ছাত্র রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে ও বরাবরই সুপরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল আবু তাহের,সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান,   আবুল মাল আব্দুল মুহিত,  সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সাংবাদিক আলতাফ হোসেন, ঐতিহাসিক নীহার রঞ্জন রায়,  শহীদ আসাদ, শহীদ শ্রীকান্ত, প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নাসির উদ্দীন চৌধুরী,  অভিনেতা খলিল উল্লাহ খাঁন , অভিনেত্রী শানারেই দেবী শানু,  কথাসাহিত্যিক মনজুরুল ইসলাম, পদার্থ বিজ্ঞানী মোহাম্মদ আতাউল করিম, বাউল শিল্পী কামাল পাশা সহ অসংখ্য গুণীজন এখানকার সবুজ আঙ্গিনা থেকে শিক্ষার স্বাদ গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও বিভিন্নসময়ে দেশ কিংবা বিশ্ববরেণ্য গুণীজনের পদচারণ ঘটেছে সিলেটের এই প্রাচীন কলেজটিতে। ১৯১৯ সালে বিশ্ব  কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট আসলে  এমসি কলেজেও আসেন।

বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম কিংবা অধিকার আদায়েও সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে  আসে  আধ্যাত্মিক নগরীর  এই প্রতিষ্ঠানটি। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন হতে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা উত্তর আন্দোলন-সংগ্রামে মুরারিচাঁদ কলেজ ইতিহাস এবং জ্ঞান বিকাশের বাতিঘর হিসেবে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। ইতিহাসের বাঁকে ইতিহাসের পথকে এবং জ্ঞান বিকাশের ধারাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অজ্ঞনে পেশা ভিত্তিক মেধা বিকাশে প্রাচীন এই টেকসই বিদ্যাপিঠের অবদান অপরিসীম।

সিলেটের টিলাগড় এলাকায় অবস্থিত কলেজটি দেশের সবচেয়ে সৌন্দর্য্যমন্ডিত ক্যাম্পাস হওয়ার ধরুন , বরাবরই  লেখাপড়ার জন্য এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের প্রথম সাড়িতেই থাকে মুরারিচাঁদের নাম ।  এখানে  পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের এমসিয়ান কিংবা মুরারিয়ান নামে ডাকা হয়।

 বিখ্যাত  তামাবিল সড়কের পাশে নান্দনিক ফটক, পাশেই সদ্যনির্মিত দৃষ্টিনন্দন   বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, সারিবাঁধা বৃক্ষরাজি, কবিগুরুর  ম্যুরাল ,  মধ্যখানে সুবিশাল জলরাশির শ্বেতপদ্মময় পুকুর, চমৎকার শহীদ মিনার, সুপ্রাচীন লাইব্রেরী,  সাথে টিলার উপর দাঁড়িয়ে থাকা একাডেমিক ভবনগুলো সবুজ এই ক্যাম্পাসটির রুপ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্যাম্পাসের এই বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের জন্য অনেকেই এর নাম দিয়েছেন  প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ। বিকেল হলে ক্যাম্পাসটিতে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের আগমন চোখে পড়ে। ইট - পাথরের ব্যস্ত শহরের মাঝে এমসি কলেজ যেন, শান্তির এক স্নিগ্ধ পরশ।   সিলেটের মানুষের কাছে আশির্বাদ হয়ে আছে মুরারিচাঁদ কলেজটি।

দেশের সপ্তম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ হলেও গত বছর প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক ভাবে  এর প্রতিষ্ঠা বার্ষীকি পালন করে এমসি প্রশাসন। তারই ধারাবাহিকতায়  এবারও জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই প্রতিষ্ঠা বার্ষীকি পালনের প্রস্তুতি ছিল এমসি পরিবারের। কিন্তু অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের কারণে  দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে এমসি কলেজও বন্ধ থাকার ফলে সেই শুভক্ষণটি উদযাপন করতে পারবে না এমসিয়ানরা।   আজ (২৭) জুন শনিবার  ১২৮ বছরে পদার্পন করল গিরিশ চন্দ্র রায়ের এমসি। শুভ জন্মদিন আলোর বাতিঘর।

লেখক : আশরাফ আহমেদ

যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন