আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

করোনার দিন গুলোতে উদ্বেগজনিত সমস্যা কিছু কথা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৬-২৮ ০১:৪৪:৫০

ডা. মো. শফিউল ইসলাম খালেদ :: শুয়ে বসে ঘুমিয়ে ঘরে থাকতে থাকতে একঘেয়ে হয়ে উঠছেন।মৃত্যুভয় ঝাকিয়ে বসেছে।ঘুম ভেংগে যাচ্ছে রাতে অকারনে কিংবা গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।ওয়াশ রুমে বার বার যাচ্ছেন কিন্তু তৃপ্তি পাচ্ছেন না।বুকে ধড়ফড়ানি অশান্তির জন্যে ভাবছেন না; ই সি জি টা করিয়েই ফেলি! আসলে আমি কিংবা আপনি চরম উতকন্ঠার ভেতর যাচ্ছি।আস্তে আস্তে এক্সাইটি ডিসঅর্ডার পেয়ে বসছে আমাদের।আমাদের উচিত এ নিয়ে একটু জানা।

উদ্বেগমূলক ব্যাধি হল এক শ্রেণীর মানসিক ব্যাধি যার বৈশিষ্ট্য হল উদ্বেগ ও ভয়ের গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি। উদ্বেগ হল ভবিষ্যতের ঘটনাগুলির বিষয়ে দুশ্চিন্তা আর ভয় হল বর্তমান ঘটনাগুলির ওপরে প্রতিক্রিয়া। এই অনুভূতিগুলি শারীরিক লক্ষণ ঘটাতে পারে, যেমন দ্রুত হৃদস্পন্দন ও অস্থিরতা।সাধারণ উদ্বেগমূলক ব্যাধি, সুনির্দিষ্ট ভীতি, সামাজিক উদ্বেগমূলক ব্যাধি, আলাদা হওয়ার উদ্বেগমূলক ব্যাধি, খোলা জায়গার প্রবল ভীতি, আতঙ্কজনিত ব্যাধি, ও সিলেক্টিভ মিউটিজম সহ অনেকগুলি উদ্বেগমূলক ব্যাধি আছে।কিসের ফলস্বরূপ লক্ষণগুলি দেখা দেয় সেই অনুযায়ী ব্যাধিটির পার্থক্য হয়।মানুষের প্রায়ই একাধিক উদ্বেগমূলক ব্যাধি হয়।
মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন বা ভীত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার, যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আপনজনদের স্বাস্থ্যহানি হলে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে, পরীক্ষার পূর্বে, নতুন সম্পর্ক করতে, কর্মস্থলে সমস্যা হলে কমবেশি উদ্বিগ্ন সবাই হয়; যা সাময়িক, সহনীয়, গ্রহণযোগ্য, অনেকক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত।

কিন্তু এই উদ্বেগ যখন সাময়িক না হয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়, দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত) কাজে ব্যাঘাত ঘটায়, সম্পর্কে টানা-পোড়নের সৃষ্টি করে এবং তা ক্রমাগত বাড়তে থাকে তখন তা রোগের পর্যায়ে পড়ে।
প্রকারভেদ

সাধারণ উদ্বেগ রোগ (Generalised Anxiety Disorder)
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সর্বক্ষণ নানাবিধ বিষয় যেমন, স্বাস্থ্য, অর্থ-সম্পদ, পড়াশোনা, পরিবার ইত্যাদি নিয়ে অতিরিক্ত, অতিরঞ্জিত, অযৌক্তিক চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে এবং সর্বক্ষেত্রে বিপর্যয়ের আশংকা করে। যে কারণে জীবন দুঃখ, ভয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। ক্রমান্বয়ে এই উদ্বেগ ব্যক্তির চিন্তার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে যা ব্যক্তির দৈনন্দিন কার্যকলাপ এবং সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটায়।

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কিছু শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়। শারীরিক উপসর্গের মাঝে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, বমি ভাব, চোখে ঝাপসা দেখা, মাংসপেশিতে চাপ অনুভব করা, জিভ-গলা শুকিয়ে যাওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, অতিরিক্ত ঘামা, ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া, ক্লান্ত বোধ করা ইত্যাদি লক্ষণীয়। আর মানসিক উপসর্গ হচ্ছে অস্থিরতা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মনোযোগে সমস্যা, ভুলে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি।

সমাজ ভীতি রোগ (Social Phobia / Social Anxiety Disorder)
এ ধরণের রোগী সামাজিক পরিস্থিতিতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়। কারো সাথে মেশা বা কথা বলার সময় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকে। এরা লোকসন্মুখে খুব আত্ম সচেতন থাকে এবং কারো দ্বারা অপমানিত, বিব্রত, বিতাড়িত, আপত্তিকর ভাবে মূল্যায়িত হওয়া এবং কাউকে আঘাত করে ফেলার আশংকায় ভোগে। কোন অনুষ্ঠান বা সমাবেশে যোগদান করতে হলে কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকে। যেখানে লোকজন থাকলে সেসব জায়গা এড়িয়ে চলে। বন্ধুত্ব করা বা বন্ধুত্ব রক্ষা করতে এদের খুব বেগ পেতে হয়। লোক সমাবেশ লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া, ঘামা, শরীর কাঁপা, বমিভাব হওয়া, পেটের পীড়ায় ভোগা ইত্যাদি লক্ষণ এদের মাঝে বিদ্যমান।

প্যানিক ডিজঅর্ডার (Panic Disorder)/ আতঙ্ক রোগ
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বারবার অপ্রত্যাশিত প্যানিক অ্যাটাক (আতঙ্কের হামলা) এর ভয়ে থাকে; যা হঠাৎ শুরু হয়ে তীব্র ভয়ের সৃষ্টি করে যার ফলে দ্রুত হৃৎস্পন্দন, বুক ধড়ফড় করা, ঘাম, শরীর কাঁপা, শ্বাস আটকে যাওয়া, অবশ ভাব ইত্যাদি অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সাধারণত ৫ থেকে ১০ মিনিটে এই লক্ষণ তীব্র আকার ধারণ করে এবং তা ২০ থেকে ৩০ মিনিট অথবা কখনও ১ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় স্থায়ী হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে রোগী ভাবতে থাকে তার হয়তোবা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এ সময় রোগী মৃত্যুভয় এবং নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ভয়েও থাকে। তাছাড়া পরবর্তী আক্রমণ কখন হবে তা ভেবেও গবীর উদ্বেগে থাকে। অতীতে যেসব স্থানে প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে সেসব স্থানে যেতে ভয় পায় এবং তা এড়িয়ে চলে।

সুনির্দিষ্ট ভীতি রোগ (Specific phobia)
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কোন নির্দিষ্ট বস্তু, প্রাণী বা স্থানের প্রতি তীব্র ভয় কাজ করে যা অযৌক্তিক এবং সে তার ভয়ের কারণগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। অনেক সময় ব্যক্তি নিজেও বোঝেন যে তার এই ভয় অহেতুক কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এই ভয় নির্দিষ্ট উদ্দীপকের উপস্থিতিতেও হতে পারে আবার কল্পনাপ্রসূতও হতে পারে।

এই ভীতি এতটাই প্রকট যে, তা আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন কাজ, কর্মদক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়, সম্পর্কে ফাটল ধরায়।

সাধারণ কীটপতঙ্গ, জীবজন্তু, উচ্চতা, রোগজীবাণু, বজ্রপাত, উড্ডয়ন ইত্যাদির প্রতি ভীতি দেখা যায়। কারও ক্ষেত্রে শৈশবেই এই ভীতি দেখা দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, কৈশোর এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর শুরু হয়। এই সমস্যা হঠাৎ করেই শুরু হয় এবং যেসব ক্ষেত্রে পূর্বে অস্বস্তিকর উদ্বেগের অভিজ্ঞতা ছিলোনা সেক্ষেত্রে নতুন করে শুরু হতে পারে।

অ্যাগারোফোবিয়া/ খোলা জায়গা ভীতি (Agoraphobia)
Agoraphobia শব্দটির আভিধানিক অর্থ খোলা জায়গায় ভীতি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি একটু জটিল। কারণ এদের মাঝে কেউ কেউ লিফটে চড়তে ভয় পায় (claustrophobia), অনেকে একা বাড়ির বাইরে বা দূরে কোথাও যেতে ভয় পায় (monophobia), কেউ শপিং মলে যেতে ভয় পায়, কেউ পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়তে ভয় পায় আবার কেউ খোলা মাঠে যেতে ভয় পায়। আসলে রোগী যেসব স্থানে নিজেকে নিরাপদ বোধ করে না, ভাবে বিপদ হলে ঐ স্থান থেকে সহজে মুক্ত হতে পারবে না, সেসব স্থানে গেলে তীব্র ভয় (প্যানিক অ্যাটাক) এর সৃষ্টি হয়। যে কারণে রোগী ঐসব স্থানে যাওয়া এড়িয়ে চলে। কোন স্থানে প্যানিক অ্যাটাকের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ঐ স্থানের প্রতি ভীতি তৈরি হতে পারে অথবা নতুন করে কোথাও গেলে তীব্র ভয়ের সৃষ্টি (প্যানিক অ্যাটাক) হতে পারে। শিশুদের মাঝে ইহা বিরল, মহিলাদের এই রোগ বেশি হয়।

রোগের কারণ
বংশগত কারণ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, মানসিক চাপ, শারীরিক অসুস্থতা, শৈশবে নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাস, উদ্বেগ প্রবণ ব্যক্তিত্ব, মস্তিষ্কের জৈবরাসায়নিক গঠন, অ্যালকোহলে আসক্তি ইত্যাদির মিথস্ক্রিয়ায় অথবা যে কোন একটির কারণে উদ্বেগ রোগ হতে পারে।

চিকিৎসা
সাধারণত ঔষধ এবং সাইকোথেরাপি (সমন্বিত ভাবে অথবা পৃথকভাবে)- এর মাধ্যমে উদ্বেগ জনিত রোগের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে।

ঔষধ হচ্ছে এন্টিডিপ্রেসেন্টস্- যা স্বল্পমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। এন্টিডিপ্রেসেন্টস্ এর মাঝে সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর (SSRI) অধিক কার্যকর। কখনও কখনও স্বল্পমেয়াদী ঘুমের ঔষধ বেনজোডায়াযেপিন (short-acting Benzodiazepine) এবং বিটা ব্লকার (প্রোপানলল, এটিনলল) ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়।

সাইকোথেরাপির মাঝে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT), বিহেভিয়ার থেরাপি (Exposure and response prevention), কগনিটিভ থেরাপি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ব্রিদিং রিলাক্সেশন, প্রগ্রেসিভ মাসকুলার রিলাক্সেশন, স্লিপ হাইজিন মেনে।

লেখক: এসোসিয়েট প্রফেসর, সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন