আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

জনমঙ্গল থেকে জনহৃদয়ে

আলহাজ্ব সিরাজ উদ্দিন আহমেদ’র সাক্ষাতকার

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৭-২৪ ২০:৪৯:১৩

ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা। পাঞ্জাবিদের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরোধিতা করতে যেয়ে চাকুরি হারান, জেল খাটেন। দীর্ঘদিন শ্রম দপ্তরেও চাকুরি করেন । কিন্তু টিকতে পারলেন না। দুর্নীতির বিরোধীতা করে চাকুরী ছাড়তে বাধ্য হন। ফিরে আসেন এলাকায়। মানুষের ভাগ্যবদলের জন্য গড়ে তুলেন ’পল্লী মঙ্গল’ নামের প্রতিষ্ঠান। ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম আর অসমাজিক কাজের বিরুদ্ধে গড়ে তুলে শক্ত প্রতিরোধ। পরিচিত হয়ে উঠেন ’পল্লী মঙ্গল সিরাজ’। স্থান করে নেন মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। মানুষের ভালোবাসায় একসময় উপজেলা চেয়াম্যান নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্টা ও আন্তরিকতার সাথে। হয়ে উঠেন ’সিরাজ চেয়ারম্যান’। পরবর্তিতে সংসদ সদস্য পদেও একাধিকবার নির্বাচন করেন। ছিশট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণ-অভ্যুল্ঞান থেকে এলাকার স্বার্থঘনিষ্ট প্রতিটি আন্দোলনে পালন করেছেন সাহসী ভূমিকা। ’জনসেবারোগ’ রক্ত মেশানো সর্বজনশ্রদ্ধেয় এ মানুষটির পরিবারের প্রত্যেকেই বিদেশের মাটিতে সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত এবং তাকেও জীবনভর সেখানে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মাটি আর মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ থেকে তিনি পড়ে আছেন নিজ জন্মভিটেয়।একাধিকবার গিয়েছিলেন কিন্তু অর্ধমাসের বেশি সেখানে থাকতে পারেননি। ৭৭ বছর বয়সী মানুষটি বর্তমানে বিভিন্ন রোগে শষ্যাশায়ী। অক্রিজেন নিতে হয় ১৫ মিনিট পরপর। এ অবস্থায়ও তিনি সময় দিয়েছেন, ফেলে আসা দিনের কথা বলেছেন অকপটে। সর্বস্তরের শ্রদ্ধেয় প্রচারবিমুখ আলহাজ্ব সিরাজ উদ্দিন আহমেদ নামের সে মানুষটির সাক্ষাতকার সবার সাথে ভাগাভাগি করা হলো। সাক্ষাতকার নিয়েছেন আব্দুল হাই আল-হাদী।    

প্রশ্ন: আপনি তো ছিশট্টির শিক্ষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। যুক্ত হলেন কিভাবে?

উত্তর: ১৯৬২ সালে জৈন্তপুর সরকারি জুনিয়র বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেনী শেষ করার পর ১৯৬৩ সালে হরিপুর বহিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেনীতে ভর্তি হই। এ সময় একদিন সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মামুন মনসুর (পরবর্তিতে উপসচিব) আমাদের বিদ্যালয়ে আগমণ করেন। তিনি আমাদের স্কুলে গিয়ে ভুইয়া স্যারের (যিনি আইএসসি স্যার নামে পরিচিত) দেখা করে বলেন, আমার দু’একজন সাহসী ছাত্রের প্রয়োজন। আইএসসি স্যার ক্লাসে গিয়ে বললেন যে, তোমাদের মধ্যে কে আছো যে পারবে মিছিল-মিটিং আর শ্লেগান করতে। যার সাহস আছে সে দাঁড়াও। বলার সাথে সাথে আমি দাঁড়িয়ে যাই। আমার সাথে আরও দু’জনকে নিই। পরবর্তিতে আমাদেরকে ব্রিফ করা হয় এবং পুরো ব্যাপারটি বুঝানো হয়। আমরা উৎসাহিত হই এবং যেকোন কাজ করতে রাজি হয়ে যাই। আমি ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হই। এরমধ্যে প্রথম দিন আমরা হরিপুর থেকে মিছিল নিয়ে পায়ে হেঁটে দরবস্থ বাজার যাই এবং সেখান থেকে আরও কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে জৈন্তাপুর সদর তথা নিজপাট যাই। সবই পায়ে হেটে করতে হয়েছিল কারণ সে সময় এত যানবাহণ ছিলনা এবং যানবাহণে চড়ার মতো পয়সা কড়িও আমাদের ছিলনা। একাধিক দিন এরকম মিছিল করেছি। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্ভর মাসে এ আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৬৪ পর্যন্ত চলতে থাকে। পরবর্তীতে মামুন স্যারের উৎসাহে দশম শ্রেণীতে আমি সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সে সময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন হাকিম মনসুর। অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে হোসেন আহমদ স্যার, আব্দুল হক স্যার, ইব্রাহিম আলী স্যার প্রমূখের নাম মনে আছে। মামুন মনসুর স্যারের দিকনির্দেশনায় আমাদের আন্দোলন চলতে থাকে। এ সময় মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বর্গের মধ্যে ছিলেন কুড়গ্রামের হুজুর, দরবস্থ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাজী ইব্রাহিম আলী, বর্তমান এমপি জনাব ইমরান আহমদের বাবা ক্যাপ্টেন রশিদ, আব্দুর রশিদ মেম্বার, শুকুর চেয়ারম্যান। আমাদের মিছিলের দিন মামুন স্যার দুপুরে চিড়া দিয়ে নাস্তা করাতেন। জৈন্তাপুর বটতালায় মেগালিক পাথরের উপর আমাদের সভা হতো। প্রায় সব সভাতেই সভাপতিত্ব করতেন মরহুম সিরাজ উদ্দিন (বড়ল সিরাজ) এবং অনুষ্ঠান নিজেই পরিচালনা করতাম।
প্রশ্ন: তারপর শিক্ষাজীবন..........

উত্তর: এসএসসি পাশ করার পর ১৯৬৫ সালে এম.সি. কলেজে ভর্তি হই। এ সময় দেখলাম পাকিস্তান এয়ারফোর্স কলেজে এসে লোক নিয়োগ করছে। যারা এইচএসটি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে, তারা জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার পদে আবেদন করছে। বন্ধুদের দেখাদেখি আমিও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম। আমি এমনিতেই পরিবারকে না জানিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। শারীরিক ফিটনেস-এ টিকে গেলাম। লিখিত পরীক্ষায়ও পাশ করে ফেললাম। দেখতে দেখতে চুড়ান্তভাবে মনোনিত হয়ে গেলাম। অর্থাৎ ১৯৬৫ সালেই আমি পাকিস্তান এয়ারফোর্সে যোগদান করি এবং আমাকে কোয়েটায় প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে যেতে না যেতেই ১৯৬৬ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলো। আমাদেরকে শুধু রাইফেল ট্রেনিং দিয়েই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আফগান বর্ডারের কিহাতে মোতায়েন করা হয়। যুদ্ধ শেষ হলে পুনরায় নিয়মিত ট্রেনিং শুরু হয়। ট্রেনিংয়ে এসে দেখলাম, আমিসহ সব বাঙালিদের সাথে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। আমরা একসাথে ৩০/৩৫ জন বাঙালি ছিলাম। দেখলাম, পাঞ্জাবিরা চরম মানসিক ও শারিরীক টর্চার করছে সব বাঙালিদের সাথে। আমাদের পাঞ্জাবি কলিগরা আমাদের দিয়ে বুট পলিশ, কাপড় ধোয়া, রুম ঝাড়ু দেওয়া ইত্যাদি কাজ করাতে থাকে। এক সময় আমরা কয়েকজন অধৈর্য হয়ে পড়লাম। আমরা তীব্র প্রতিবাদ করলাম, বিদ্রোহ করলাম। তখন আমাদেরকে জেলে পাঠানো হয়। আমি সাজা ভোগের পর সিলেটে ফিরে আসি।
সিলেটে এসে ছাতক সিমেন্ট কারখানায় একটি চাকুরি হলো। সেখানে কিছুদিন চাকুরির পর বড় ভাই আমাকে ধরে এনে সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-এ ভর্তি করে দেন। সেখানে ভর্তির কারণ ছিল- তখনো সেখানে ছাত্ররাজনীতি ছিল না। বড় ভাই দেখলেন, এর রক্তে যেহেতু একবার রাজনীতি ঢুকেছে, তাই এটা থেকে বের করতে হবে। ১৯৬৭ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হই। ফার্স্ট ইয়ার শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় বর্ষে উঠার সাথে সাথে সেখানে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবিতে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। দেওয়ান আব্দুল বাছিত সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং সাথে সাথেই ছাত্রসংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। আমি ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে জিএস প্রার্থী হয়েছিলাম। পরবর্তীতে মুসলিম লীগ বিরোধী সবগুলো সংগঠন একজোট হয়ে নতুন প্যানেল দেয় এবং পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে আমি ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হই। ১৯৬৯ সালে সিলেটে সরকার বিরোধী সর্বদলীয় যে কমিটি করা হয় সে কমিটির পক্ষ থেকে জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট-এ আন্দোলন করার জন্য ছাত্রদের মধ্য থেকে একটি কমিটি করা হয়। আমাদের ছাত্রসংসদকে এ অঞ্চলে গণ-সংযোগসহ অন্যান্য কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেহেতু আমি এ এলাকার মানুষ, তাই আমাকে আহবায়ক করা হয়। সংসদের ভিপি, জিএস সহ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একদিন জৈন্তাপুরে মিটিং করি। ঐদিনই বিকেলে কানাইঘাটে যাই মিটিং করতে। জৈন্তাপুর থেকেই মাইকসহ সবকিছু নিয়ে গিয়েছিলাম। কানাইঘাট বাজারে সভা শুরুর কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম শত শত লোক লাটিসহ আমাদের দিকে আক্রমণ করতে আসছে। আমরা সবাই সবকিছু ফেলে সুরমা নদীতে ঝাপ দেই। কোন রকমে ওপারে উঠে শাহবাগ হয়ে অনেক রাতে সিলেট শহরে ফিরি। এ সময় মুসলিম লীগের কন্টু মিয়ার নেতৃত্বে কয়েকজন আমার বাবাকে শাসিয়ে যান যে, আপনার ছেলে যদি আন্দোলন থেকে নিস্ক্রিয় না হয় তবে আপনাদের পুরো পরিবারকে একঘরে করা হবে। এর মধ্যেই আমার ডিপ্লোমা কোর্স শেষ হয়ে যায়। প্রচন্ড পারিবারিক চাপে পড়ি। এ সময় শ্রম দপ্তরে আমার চাকুরি হই। বাবা, বড় ভাইসহ সবাই সেখানে যোগদানের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। আমার পোস্টিং হয় রংপুরে ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে। আমি সেখানে যোগদান করি। সেখানে লুকিয়ে লুকিয়ে রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকেছি। ১৯৭০ সালে গাইবান্ধায় বিয়ে করি। বিয়ের ছ’ মাসের মাথায় আমার ওয়াইফ কনসিভ করেন। এভাবে মোটামুটি চলছিল।    
  
প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধের সময় কিভাবে কাটালেন?

উত্তর: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ঐতিহাসিক সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। রংপুর থেকে আগের দিনই একটি পারিবারিক কারণ দেখিয়ে ঢাকায় চলে আসি। পরদিন নিজ এলাকায় চলে এসে যুবকদের সংগঠিত করতে থাকি । আমরা প্রায় প্রতিদিনই জৈন্তাপুর বাসস্ট্যান্ডে মিছিল-মিটিং করতাম। মুসলিম লীগ নেতারা আমার পরিবারকে প্রচন্ড চাপ করেন যেন আমি নিস্ক্রিয় হই। তারা পুরো পরিবারকে একঘরে করারও হুমকি দেন। এসময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমার মা আমাকে বললেন, হয় তুই বাড়ি ছেড়ে কর্মস্থলে ফিরে যা না হয় আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তাছাড়া আমার স্ত্রীর গর্ভধারণের ব্যাপারটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বকাঝকা করেন। এপ্রিলের প্রথম দিকে পাক সেনারা জৈন্তাপুরে আসে। সব মিলিয়ে, পরিবারের চাপে পুনরায় কর্মস্থলে ফিরে যেতে বাধ্য হই। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গোপন যোগাযোগ গড়ে উঠে। আমাদের একটি সরকারি ডিসপেনসারী ছিল। সেখান থেকে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের ঔষধ সরবরাহ করতাম। গোপন খবরাখবর পৌছাতাম মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। সত্যি বলতে কী, শিক্ষা আন্দোলন, গণঅভ্যুল্থান আর এপ্রিলের পূর্ব পর্যন্ত মাঠের একজন সক্রিয় সংগঠক হয়েও পরিবারের চাপে সম্মুখ সমরে যুদ্ধা হতে না পারাটা আমার জীবনের একটা বড় আফসোস। তারপরও পরোক্ষভাবে যতটুকু সহায়তা করেছি সেটাতেই সান্তনা খুঁজি।
প্রশ্ন: তারপর চাকুরির কী হলো?

উত্তর: স্বাধীনতার ১ বছর পর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসে আমাকে বদলি করা হয় । সেখানে যোগদানপত্র দিয়ে আবার বাড়িতে চলে আসি। কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। পদত্যাগপত্র না দিলেও মনে মনে আমি আর চাকুরি করবনা-এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এলাকায় এসে সমবয়সী যুবকদের নিয়ে ’পল্লীমঙ্গল’ নামের সংগঠন করলাম। ’পল্লীমঙ্গল’ সংগঠনটি মানুষের মাঝে এতে সাড়া ফেললো যে, তা নিজপাট ছাড়িয়ে পুরো জৈন্তাপুরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। এ সংগঠনের মাধ্যমে আমরা দুর্নীতি ও অসামাজিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করলাম । স্মাগলিং বা বোঙ্গাড়ীদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযান পরিচালনা করি। এ সময় সাধারণ মানুষ আমাদেরকে দারুণভাবে এপ্রিশিয়েট করে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ ও প্রশাসনের অনেকের চক্ষুশীল হয়ে গেলাম। বিভিন্ন দিক থেকে হুমকি-ধুমকি আসতে থাকলো। আমরা অনঢ়ভাবে আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। একটি অফিসেরও ব্যবস্থা হয়ে গেল। সন্ধ্যার পর সবাই সেখানে আড্ডা দিতেন। এ সময় ব্যক্তিভাবে চরম অর্থকষ্টে পড়লাম । ভাবলাম, কিছু একটা করতে হবে। না হলে পরিবার চলবে না। এজন্য সামাজিক কাজের পাশাপাশি একটি ব্যবসায় হাত দিলাম। সেটিতে মার খেলাম। পরবর্তিতে আরেকটি ব্যবসায় হাত দিয়ে সেটিতেও দেউলিয়া হয়ে গেলাম। আমার স্ত্রী কিন্তু শিক্ষিত ছিলেন । সেজন্য আমার বাবা তাকে চাকুরিতে ঢুকানোর চেষ্টা করলেন। স্ত্রীও উৎসাহী ছিলেন। এজন্য প্রথমে পাকড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু সেখানে আসা-যাওয়া ছিলো তাঁর জন্য ভীষণ কষ্টের। সেজন্য পরবর্তীতে লামনীগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।

ব্যবসায় মার খাওয়ার পর আবার চাকুরির খবর নিলাম। চট্টগ্রাম গিয়ে জানলাম যে, আমার চাকুরি যায়নি। অনেক তদবির করলাম সিলেটে পোস্টিংয়ের জন্য। শেষ পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল বদলি হলাম। এখান থেকে ডেপুটেশনে সিলেট বিমানবন্দরে কর্মস্থল দেওয়া হল।

প্রশ্ন : চাকুরি ছাড়লেন কেন?

উত্তর: তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। লন্ডন ভ্রমণের সময় সিলেটীদের সাথে তাঁর এক বৈঠক হয়। সেখানে সিলেট বিমান বন্দরে তাদের হয়রানির করুণ কাহিনী প্রবাসীরা রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরেন। তারপর দেশে ফিরে তিনি একজন সৎ ও দক্ষ অফিসারকে সেখানকার কাস্টমস-এ নিয়োগের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ প্রেক্ষিতে আমার দপ্তর আমাকে ডেপুটেশনে সেখানে দায়িত্ব দেয়।
এ সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের একটি অংশ অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে মিলে পুরো বিমান বন্দরকে দুর্নীতির এক আখড়ায় পরিণত করে। আমি গিয়ে কাস্টমসয়ের দুর্নীতির বিপরীতে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করি। এ সময় সে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক নেতারা আমার সাথে বসে। তারা অফার করে, প্রতিদিনের আয়ের এক তৃতীয়াংশ আমাকে দেবে। আমি বললাম, আমাকে যে কাজে ডেপুটেশনে পাঠানো হয়েছে সেটির বাইরে যেতে পারবো না। তারা ভেবে দেখার জন্য তিনদিন সময় দিয়ে চলে যায়। এরপরও আমি আমার জায়গায় অনঢ় থাকি। এতে তারা প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়। হুমকি দেয়। আমি আমার বিভাগের মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি। আমার নিরাপত্তার ব্যাপারটিও তাদেরকে জানাই। উর্ধ্বতন মহল থেকে আমার নিরাপত্তার ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ও এসপি কে জানানো হলে তারা আমাকে ফোন করেন। যখন কোন হুমকি আসে তখন তাদেরকে ব্যাপারটি অবগত করার জন্য বলা হয়। তারাও প্রচ্ছন্নভাবে এক প্রকার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।

১৯৮২ সালের ১ম দিকে এক ঘটনা ঘটে। যুক্তরাজ্য ফেরত এক ব্যক্তিকে একদিন খুব বিমর্ষ অবস্থায় এয়ারপোর্টের মধ্যে কান্নাকাটি করতে দেখে তার কাছে যাই। কী হয়েছে, বলতেই সে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করতে লাগলো। সে যা বললো তার মূল কথা হচ্ছে - সে যুক্তরাজ্য থেকে একেবাবে জীবনের সব সঞ্চয় নিয়ে দেশে চলে এসেছে।কিন্তু কাস্টমসয়ের কর্মকর্তারা তার সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন। আমি আমার অফিসে বসিয়ে তাকে সব ঘটনা উল্ল্যেখ করে একটি দরখাস্ত লিখতে বলি। আমার সহযোগিতায় সে সব লেখে। পরবর্তিতে এটি ডাকযোগে ঢাকায় পাঠিয়ে দেই। কিছুদিনের মধ্যে ঢাকা থেকে একটি বিশেষ তদন্ত দল আসে । তারা আমাকে ব্যাপারটি জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমি সব সত্য ঘটনা খুলে বলি। এরপর সে তদন্তের প্রেক্ষিতে একাধিক কর্মকর্তাও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

এ ঘটনায় পুরো সিন্ডিকেট আমার বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে উঠে। তখন আমি দক্ষিণ সুরমায় একটি সরকারি কোয়ার্টারে থাকতাম। একদিন সকালে বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা সশস্ত্র অবস্থায় আমার বাসায় ঢুকে। তারা যা বলে তা করার জন্য হুকুম করে। কোন কথা বললে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। সশস্ত্র একজন আমাকে ঘরের এক কোণে বসিয়ে রাখে। দেখলাম, আমার বাসার সব মালামাল একটি ট্রাকে উঠাচ্ছে। সবকিছু উঠানোর পর আমাকে গাড়ির দরজায় নিয়ে উঠিয়ে দেয় এবং বলে, আর কখনো সিলেটমুখী হবেন না। না হলে সব শেষ করে ফেলবো। গাড়ি জৈন্তাপুরে আমার বাড়িতে চলে আসে। এরপর পুরো ঘটনা আমার বিভাগের উর্ধ্বতন মহলকে লিখিতভাবে জানালাম। তারা অপেক্ষা করতে বললেন। শেষ পর্যন্ত একদিন ডেকে নিয়ে বললেন, আপাতত: কিছু করার নেই । আপনি বাড়িতে থাকেন আর বেতন নেন। এভাবেই চলছিল এবং চাকুরি জীবনের ইতি ঘটলো। আমি আর কখনো যোগদান করিনি।  

প্রশ্ন: চেয়াম্যান হয়ে উঠার গল্পটি যদি বলতেন?

উত্তর: ১৯৮২ সালের শেষের দিকে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। সে সময় চারিকাটা, নিজপাট ও জৈন্তাপুর নিয়ে এক ইউনিয়ন ছিল। চারিকাটার হাবিবুর রহমান হবই ভাই প্রার্থী হলেন। আমাকে পল্লীমঙ্গলের সদস্যরা ছাড়াও যুব সমাজের সবাই অনুরোধ করলেন প্রার্থী হতে। আমার আসলে সে রকম কোন ভাবনা ছিলনা। আমি আমার অনিহা প্রকাশ করলাম। টাকা-পয়সা নাই, যোগ্যতা নাই ইত্যাদি বুঝাতে লাগলাম। নমিনেশন সাবমিশনের শেষদিন সবাই বাড়িতে এসে জোরাজুরি করতে লাগলেন। তখন সরকারী পর্যায়ে উপজেলা নির্বাচনের আলোচনা চলছিল। সবাই আমাকে বললেন, মূলত: আপনাকে আমরা আমরা উপজেলা পর্যায়ে চাই । ইউ/পি ইলেকশন করলে পরিচিতি বাড়বে যেটা ভবিষ্যতে কাজ দেবে। অবস্থা পাস করার মতো হয়ে গেল আপনি সাইলেন্ট হয়ে হবই ভাইকে ছেড়ে দেবেন। শেষ পর্যন্ত তাদের যুক্তির কাছে হার মেনে নমিনেশন দাখিল করলাম। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসলো আমার ফিল্ড ততো ভালো হতে লাগলো। একপর্যায়ে আমি নিস্ক্রিয় হয়ে গেলাম। হবই ভাইকে বললাম, আপনি পেলেন। তারপরও ভোটের ব্যবধান হয়েছিল ৫শত এর মতো।
প্রশ্ন: থানা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কী যেন একটা ঘটনা ঘটেছিল :

উত্তর: হ্যাঁ। ঘটনার প্রসঙ্গ যখন বলছো তখন তা না বললেই নয়।  ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে ঘটনাটি ঘটেছিল। একদিন চাক্তা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুর রব সাহেব আমার বাড়িতে আসলেন। এসে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে গিয়েছিলাম অফিসের একটি কাজে। উনি আমাকে অপমানিত করে গলাধাক্কা দিয়ে বের দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে উনার সাথে পরিচয় না থাকলেও একজন সম্মানিত আলেম হিসেবে উনার ভক্ত ছিলাম। তিনি আরও বললেন, ইউপি চেয়াম্যান হবই , নজরুল চেয়ারম্যান দু’জনের কাছেই গেছেন কিন্তু উনারা এ ব্যাপারে কিছু করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। সে সময় ইউএনও ছিলেন আব্দুল হাকিম । আমি হুজুরকে একটু বসতে বলে সাথে সাথে ড্রেস বদলিয়ে উনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম । টিএনও ব্যক্তিভাবে আমাকে সম্মান করতেন, অফিসে গেলে খাতির যত্ন করতেন। আমি হুজুরকে নিয়ে টিএনও অফিসে যেতেই তিনি আমার সাথেও অপরিচিত লোকের মতো অপমানজনক ব্যবহার করলেন। আমিও রুমে ঢুকলাম। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হল। একসময় তিনি আমাকে পুলিশে দেওয়ার হুমকি প্রদান করে ল্যান্ড ফোনে হাত দিলেন। আমি ফোনটি কেড়ে নিলাম। ব্যাপারটি এমন পর্যায়ে গেল যে, এক সময় আমি উত্তেজিত হয়ে টিএনও-কে চেয়ার দিয়ে আঘাত করি। তিনি টেবিলের নিচে ঢুকে পড়েন কিন্তু টেবিলের উপরের সব কিছু ভেঙ্গে যায়। এরমধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। বাজার থেকে শত শত লোক টিএনও অফিসের সামনে চলে আসে। তারা শ্লোগান দিতে থাকে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যে পুলিশ এসে হাজির হয়। পুলিশ অফিসার বারবার আমাকে বাসায় চলে যাওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন। আমি বললাম, বাসায় যাবো কেন? আপনি আমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যান। কিন্তু কোনভাবেই আমি যাচ্ছিলাম আবার তারাও অ্যারেস্ট করছেনা । আমি বাইরে বেরিয়ে এসে উপস্থিত জনতাকে শান্ত থাকার আহ্বান জানাই। তারা শান্ত হন। এরপর ওসি সাব আসেন। তিনি এসে বলেন, আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করেছি। বিকেলে ডাকবাংলোতে ডিসি ও এসপি স্যার এসে ব্যাপারটি মীমাংসা করবেন। বিকেলে যথারীতি ডিসি ও এসপি আসলেন। আমাদেরকেও ডাকা হলো। কিন্তু টিএনও আসলেন না। প্রথমে অধ্যক্ষ হুজুর ঘটনা বললেন। এরপর আমাকে বলা হলে আমিও পুরো ঘটনা খুলে বললাম। আমি বললাম যে, আমি তো ঘটনা শেষ করতে গিয়েছিলাম। সব ঘটনা শুনে ডিসি মো: আব্দুল হাফিজ মাথা নিচু করে বসলেন। তিনি প্রশাসনের সবার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইলেন এবং টিএনও-এর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিলেন। এভাবেই ঘটনার ইতি ঘটলো। 
প্রশ্ন: উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন নিয়ে যদি বলতেন:

উত্তর: ১৯৮৪ সালে প্রথমে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও পরবর্তিতে এটি স্থগিত করা হয়। ১৯৮৫ সালে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমি যাতে প্রার্থী হই সেজন্য মানুষের পক্ষ থেকে ভীষণ চাপ আসে। আমিও মনে মনে প্রার্থী হওয়ার নিয়ত করি। আমার বিপরীতে হাবিবুর রহমান হবই ও নজরুল ইসলাম চেয়ারম্যান প্রার্থী। এ সময় শুনলাম, টিএনও আব্দুল হাকিম তাদেরকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন। আমাকে যেকোনভাবে আটকাতে হবে। সেজন্য তাদের দু’জনের মধ্যে যেকোন একজনকে প্রার্থী হওয়ার অনুরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত নজরুল ইসলাম সরে দাঁড়ান। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিলো ততোই আমার আওয়াজ জোরদার হচ্ছিল। যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই মানুষের জোয়ার। শেষ নির্বাচনী সভা হয় সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। লোকে লোকারণ্য চারদিক। যেকোন অঘটন ঘটে যাওয়ার একটা আশংকা ছিল। সেজন্য সবাই খুব সতর্কতার সাথে আমাকে সভাস্থলে নিয়ে যান। সভা চলাকালীন সময়েই হঠাৎ চুরিসহ একটা লোক ধরা পড়ে। সাথে সাথে সবাই আমাকে নিরাপদে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসেন এবং জৈন্তাপুরে পৌছে দেয়। এতে সবার মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পাবলিক সেন্টিমেন্ট আমার পক্ষে আরও জোরালো হয়। নির্বাচনে মানুষ বিপুল ভোটে আমাকে নির্বাচিত করে।
প্রশ্ন: চেয়ারম্যান জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতাকে কিভাবে দেখেন?

উত্তর: আসলে পৃথিবীতে কেউই পারফেক্ট নয়। আমি চেয়ারম্যান হিসেবে প্রথমে জৈন্তাপুরের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দেই। আমার নির্বাচনী অঙ্গিকার ছিল একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করেছি এলাকার উন্নয়নের জন্য।
দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই আমার সাথে জৈন্তিয়া কন্দ্রেীয় ছাত্র পরিষদের খসরুজ্জামান খসরু ও এটিএম বদরুল ইসলাম দেখা করেন। তারা দরবস্তে কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সম্মেলনের আয়োজন করতে চান। আমি সর্বোতভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দেই। সম্ভবত: ১৯৮৬ সালে সে সম্মেলনটি সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আমি সভাপতিত্ব করি এবং প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য ইমরান আহমদ। গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলার চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তৃতার এক পর্যায়ে ঘোষণা করি, এ বছর যারা এসএসসি পাস করবে তাদেরকে দিয়েই এ বছর কলেজের যাত্রা শুরু হবে। আবেগে তখন পুরো সম্মেলনস্থল শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে।

ফান্ড নাই, জায়গা নাই- শূণ্যের উপর এভাবে একটি কলেজের যাত্রা শুরু হয়। আমি খাদ্য অফিসারকে দরবস্তের গোডাউন সংস্কারের জন্য একটি প্রজেক্ট জমা দিতে বলি। যথারীতি সে প্রজেক্ট অনুমোদন করে গোডাউনের দু’টি রুম ক্লাস রুমের উপযোগি করে তোলা হয়। দরবস্তের ইউপি চেয়াম্যান নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করি-তিনি যেন তার পরিষদ থেকে কলেজের একটি অফিস  কক্ষের ব্যবস্থা করে দেন। তিনি পরিষদ চত্বরে তা করে দেন। এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে ভর্তি আহ্বান করা হয়। শুধুমাত্র মানবিক বিভাগ খোলা হয়েছিল প্রথম বছর। শিক্ষক ও আনুষঙ্কিক সবকিছুর ব্যবস্থা করে ক্লাসের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু শিক্ষকদের বেতন আসবে কোথা থেকে? সেটারও একটা সাময়িক ব্যবস্থা করি। প্রত্যেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের বিল পাসের আগে জৈন্তিয়া কলেজের ফান্ডে একটা অনুদান দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। তারাও সম্মতি দেন। তাদের মানি রিসিপ্টও দেওয়া হতো। এভাবে প্রথম বছর শিক্ষকদের বেতনের একটা ব্যবস্থা হয়। পরবর্তীতে আমরা বাস মালিক সমিতির শরণাপন্ন হই। তাদের অনুরোধ করি- তারা যদি প্রত্যেক বাস থেকে সামান্য চাঁদা দেন তবে কলেজটি ভালোভাবে চলতে পারবে। তারা সম্মতি দেন। ডিসি’র কাছে বাঁশ স্থাপনের অনুমতি চাইলে শেষ পর্যন্ত তিনি আন-অফিশিয়ালী সম্মতি দেন। আমাদের ফান্ডের ভালো একটা বন্দোবস্ত হয়ে যায়। কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের বাজারগুলোতে দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কাছেও আমরা রুটিন করে যেতে থাকি। সবাই সামর্থ্যমতো টাকা দিয়েছেন। আমাদের সে টিমে এলাকার গণ্যমান্য সবাই থাকতেন।

কিন্তু এভাবে জোড়াতালি দিয়ে তো বেশিদিন চালানো সম্ভব নয়। এজন্য কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জায়গা খোঁজতে থাকি। প্রথমে আমরা হাজী নাজিম উদ্দিন ওরফে কুতুব হাজীর দ্বারস্থ হই। অনুরোধ করতেই তিনি রাজি হয়ে যান এবং  কলেজের জন্য ২ বিঘা জায়গা দিয়ে দেন। এমনকি সে জায়গার রেজিস্ট্রির ফিও তিনি নিজে বহণ করেন। আমি নিজে ৪ বিঘা জায়গা দান করি। মরহুম ইব্রাহিম চেয়ারম্যানও ২ বিঘার মতো জায়গা দান করেন। পরবর্তীতে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শামছুজ্জামান, অধ্যাপক ডা: এমএমতিন, এডভোকেট নুরুল হক সহ আরও অনেকে এগিয়ে আসেন ও জায়গা প্রদান করেন।

এভাবে সীমিত ফান্ড নিয়ে কলেজ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়।। প্রায় সন্ধ্যায় গাড়ি থামিয়ে নির্মাণ কাজ দেখতে  গাড়ি থামিয়ে কাজের অগ্রগতি দেখতে যেতাম। একদিন দেখি, মরহুম সিকন্দর আলী ওরফে সেক্রেটারী সাব সড়ক থেকে কাঁধে ইট বহণ করে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি খুব মর্মাহত হই। উনাকে বিনয়ের সাথে এ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করি । তিনি বললেন, অন্ধকারে কেউ তো দেখছে না। নিজে বহণ করলে কয়েকটি টাকা তো সাশ্রয় হবে। এভাবে আস্তে আস্তে অনেক মানুষের দান আর শ্রমে কলেজটি গড়ে উঠে।
 
প্রশ্ন: আপনার সময় আরও অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আপনার অবদান আছে শুনেছি?

উত্তর: হ্যাঁ। টিক বলেছো। এখানে একটি কথা বলা প্রাসঙ্গিক বোধ করছি। সে সময়ের উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ছিল অনেক বেশি। আইন-ই চেয়ারম্যানদের এ ক্ষমতা দিয়েছিল। উপজেলা চেয়ারম্যান পদটি ছিল আজকের চেয়ে অনেক শক্তিশালী ও কার্যকর। আমরা চাইলেই সচিবালয়ে যেতে পারতেন, মন্ত্রী-সচিবদের সাথে দেখা করতে পারতেন। যাই হোক, আইন প্রদত্ত সে ক্ষমতাকে আমি এলাকার উন্নয়নে ব্যবহারের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এ সময় সারিঘাটের মরহুম কালা মাস্টারসহ আরও অনেকে সারিঘাট এলাকায় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। আমি তাদেরকে আশস্থ করি বলি যে, আপনারা জায়গা দেন, বাকিটা আমি দেখবো। আমার কাছ থেকে কিছু টাকাও নেওয়া হয় এই বলে যে, আপনাকে দিয়েই ফান্ড কালেকশন শুরু করলাম। এভাবে একদিন আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি গেলাম। বিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন হল। পরবর্তিতে বিদ্যালয় চালানোর জন্য আমি সরকারের বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র প্রোগ্রামে অন্তর্ভূক্ত করি। এর মাধ্যমে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা চলে। বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রের একটি সাইনবোর্ডও টানানো হয়েছিল। ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে জৈন্তাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ফতেহপুর উচ্চ বিদ্যালয়সহ সবগুলো প্রতিষ্ঠান এমপিও ভূক্ত হয়। আমি বলছিনা যে, সবই আমার দ্বারা হয়েছে। কিন্তু আমার সাধ্য ও ক্ষমতাকে সর্বোতভাবে ব্যবহার করেছি প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে। নিজের গাড়ি-বাড়ি আর বিত্ত-বৈভবের কথা কখনো চিন্তা করিনি। 

প্রশ্ন: সমাজটা তো এখন অনেক বদলে গেছে।

উত্তর: সমাজের অনেক পরিবর্তন দেখছি। বর্তমান প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনার মধ্যেও অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগে যারা জনপ্রতিনিধি ছিলেন বা সমাজসেবা করতেন , তাদের মধ্যে মাটি ও মানুষের  আন্তরিকতা ও দরদটা ছিল অসীম। কর্মগুলো ছিল নিখাদ ও নির্ভেজাল। ওরা নিজের জন্য চিন্তা না করে ভেবেছে মাটির জন্য, মানুষের উন্নয়নের জন্য। সমাজসেবা করতে গিয়ে নিজের অনেক কিছু তাঁরা খুইয়েছেন। এরকম উদাহরণ আমার কাছে আছে। গাড়ি-বাড়ি আর সঞ্চয়ের কথা তারা চিন্তাই করেননি। তাদের পরকালের চিন্তা ছিল, হক-নাহকের চিন্তা ছিল। সত্য-মিথ্যার ভেদাভেদ তারা জানতেন। এখনকার পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন মুখের চেয়ে মানুষের মুখোশটাই বেশি দেখা যায়। মানুষ কাজের চেয়ে প্রচার চায় বেশি। মানুষরাও সেগুলো পছন্দ করে। এখনকার ভাবনাটা এরকম যে, প্রচারেই প্রসার। কাজের চেয়ে প্রচারেই মানুষের মনোযোগ বেশি। মানুষকে মূল্যায়নের মাপকাঠিও সময়ের সাথে বদলে যাচ্ছে। মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয়ের জন্য এসব পরিবর্তন। রাতারাতি সফল ও যেকোন পন্থায় বিত্তবৈভবের জন্য মানুষ কোন কিছুরই পরোয়া করেয়া। দৃষ্টিভঙ্গির এ পরিবর্তনের জন্য বৈশ্বিক ব্যবস্থাও কম দায়ি নয়। আমার চেয়াম্যান থাকাকালীন সময়ে কোথাও কোনদিন একটি নামফলকও কাউকে ব্যবহার করার অনুমতি কাউকে দেইনি। মানুষের ভেতর বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিদের ভেতর পরকালীন জবাবদিহীতা, আল্লাহ আর মৃত্যুর ভয় না থাকলে সে সত্যিকারের সৎ জীবন-যাপন করতে পারবে না।  

প্রশ্ন: পরিবেশ ও প্রকৃতিও তো অনেক বদলে গেছে ?

উত্তর: হ্যাঁ। অনেক পরিবর্তন দেখতি পাচ্ছি। আগের সেই জাফলং, লালাখাল, শ্রীপুর আর নেই। দেখতে দেখতে সব বনগুলো উজাড় হয়ে গেল। বন্যপ্রাণি ও মৎস্যসম্পদ হারিয়ে গেছে। নদ-নদী, হাওর-বাওর, খাল-বিল-জলাশয়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সারী-গোয়াইন প্রকল্পের মাধ্যমে অনেকগুলো নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে। চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে আমি ডিপিপি অনুসারে যে কাজটি হয়টি, সেটি মন্ত্রণালকে জানিয়েছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা ঢাকা থেকে এসে তদন্ত করে গেছেন। শিক্ষার বাহ্যিক অগ্রগতি হলেও মানুষের সত্যিকার মনোজাগতিক পরিবর্তন আসেনি। সবার মধ্যে যেন একপ্রকার খাই খাই ভাব কাজ করছে।

প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আপনার বক্তব্য-

উত্তর: নতুনরা পুরোনোদের থেকে, নেতাদের দেখে শেখে থাকে। নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আমার একটাই কথা- লক্ষ্য টিক রেখে নিজের কাজটি আন্তরিকভাবে ভাবে করে যাও। পথভোলা নেতাদের মিষ্টি কথায় অনুপ্রাণিত না হয়ে মানবতার যারা নেতা, পৃথিবীর কালজয়ী মানুষদের জীবনি পড়, তাদের মন্ত্রে উজ্জ্বিবিত হও। সাফল্যের জন্য তাড়াহুড়ো করা পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জীবনে সাফল্যের কোন শর্ট-কাট পথ নেই। সাধনার মাধ্যমেই জীবনকে গড়ে তুলতে হয়।

প্রশ্ন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

উত্তর: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।

আবদুল হাই আল হাদী : লেখক ও পরিবেশ সংগঠক

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন