Sylhet View 24 PRINT

মানবিক পুলিশ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৭-২৬ ২৩:৩৬:৩৫

ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল :: শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তার প্রগতি এ মূলমন্ত্রকে ধারণ করে বাংলাদেশের আপাময় জনতার কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। মানুষের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে কাজ করার সুবাদে এ বাহিনী যেমন নানাবিধ কাজে প্রশংসিত হয়েছে পাশাপাশি এমন কর্ম ও তাদের দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে যার কারণে নিকট অতীতে অনেকের কাছেই তাদের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।

জনতার বন্ধু এ আদর্শকে বুকে নিয়ে জনস্বার্থ, নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান নানাবিধ দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার নিমিত্তেই পুলিশ শব্দের গোড়াপত্তন হয়। ইতিহাস ঘাটলে প্রতীয়মান হয় যে অনেক প্রাচীনকালেই রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এবং জনমনে শান্তি আনয়নে নানা দেশে নানা নামে এ বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। ১৬৪২সালে দ্য সেকেন্ড পার্টি অব দ্য ইনস্টিটিউট অফ দ্যা লজ অব ইংল্যান্ডে প্রথম শব্দটির আনুষ্ঠানিক ব্যবহারের কথা জানা যায়। রোমান সাম্রাজ্যে ভিজিল এবং মধ্যযুগের স্পেনে ব্রাদারহুড নামে রাষ্ট্রীয় আইন শৃংখলা ও নিরাপত্তা বিধানে এরকম বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল। পরবর্তীতে ১৬৬৭ সালে কিং লুইস সর্বপ্রথম প্যারিসে সংগঠিত পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলেন।

এ দেশে পুলিশ বাহিনীর ইতিহাস অনুসন্ধান করলে যে তথ্যটি বেরিয়ে আসে তাহলো ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এদেশীয় মানুষের নিরাপত্তা এবং বিশেষত রাষ্ট্রীয় সংহতি ও শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে এ বাহিনীর গোড়াপত্তন ঘটায়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ নামে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ পুলিশ নামে পরিচিত লাভ করে।

স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কার, আইন ও নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এ বাহিনীকে নানাভাবে জনবান্ধব ও কল্যাণকামী হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হলে ও জনহয়রানি, দুর্নীতি, স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ঘাটতির কারণে কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারেনি। যার কারণে জনগণের মাঝে পুলিশ বাহিনীর ব্যাপারে এক ধরনের ভীতিকর প্রত্যক্ষণ তৈরি হয়।

প্রকৃত বন্ধু সেই যে বিপদে, আপদে, দুর্যোগে, মহামারীতে অনিশ্চয়তায়, অন্ধকারে এবং প্রতিকূলতায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানব সেবার উদাহরণ তৈরি করে মনের আঙ্গিনায় স্থান করে নিতে পারে। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীতে তাবৎ দুনিয়ায় এ বাহিনী তাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কারণে মানসপটে ইতিবাচকভাবে চিত্রায়িত হয়েছে।

জঙ্গি দমন, বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সামনের সারির যোদ্ধা হিসেবে এ বাহিনীর কৃতিত্ব এবং সাহসিকতাপূর্ণ আচরণ প্রশংসার দাবি রাখে। ১৯৭১ সালের২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে সুসজ্জিত হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজার বাগ পুলিশ লাইন্সের রুখে দাঁড়ানোই প্রমাণ করে দেশমাতৃকার বিপদে, প্রয়োজনে এ বাহিনীর ত্যাগ এবং তিতিক্ষা প্রশ্নাতীত। সেই রাত্রিতে সারাদেশে পুলিশ বাহিনীর ২৪জন শহীদ হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলিলের তত্ত্বানুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ১২৬২ জন সদস্য রণাঙ্গনে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য আনয়নে ভূমিকা রেখেছে ।


যেকোনো দুর্যোগ, ক্লান্তিকালে, অরাজকতা দমনে, আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সরকার ও জনগণের পাশে থেকে সর্বদা পুলিশ বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। করোনা বাংলাদেশে আগমনের শুরুতে এ বাহিনী স্বীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সারাদেশে নানাবিধ অভিনব কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনতার মনিকোঠায় বিশেষ স্থান অর্জনে সক্ষম হয়। এ সময় লকডাউন, আইসোলেশন নিশ্চিত করণ, সামাজিক দুরত্ব কার্যকরে ভূমিকা পালন, গৃহবন্দী মানুষের পাশে খাবার ও ঔষধ নিয়ে সরব উপস্থিতি, রোগীকে হাসপাতালে প্রেরণে সহযোগিতা, চিকিৎসক ও রোগীকে বাড়ির মালিকদের রোষানল থেকে পরিত্রান, কৃষকের পাকা ধান কেটে দেওয়া, সৎকার ও দাফন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ বাহিনী জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়।


সারাদেশে পুলিশ বাহিনীর নানামুখী সৃষ্টিশীল, কল্যাণমুখী এবং প্রণোদনামূলক কার্যক্রম জনমনে স্বস্তি আনয়নে ভূমিকা রেখেছে। জেলা, মহানগর ও রাজধানীর বিভিন্ন ইউনিটের ব্যতিক্রমী , সৃজনশীল এবং উদ্দিপনা মূলক কার্যক্রম গ্রহণের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। সবগুলো আয়োজন দেশমাতৃকার এবং মানুষকে ভালোবেসে, গৃহীত পদক্ষেপ মানুষের উপকারে আসে। করোনাকালে দেখা যায় ডিএমপির মিরপুর 'খোঁজ নিয়েছেন', চুয়াডাঙ্গা পুলিশের ' খাদ্য যাবে বাড়ি', শেরপুর পুলিশের 'নো-মাস্ক-নো -বাজার', চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের 'ডোর-টু- ডোর শপ', দাফন-কাফনের নিমিত্তে পুলিশ কর্মকর্তার ১০ শতাংশ জায়গা দান, গাজীপুর পুলিশ সুপারের জনমুখী গানের আয়োজনএবং ঘরে খাবার পৌঁছানো, সিলেট পুলিশের জনতার পাশে সার্বক্ষণিক অবস্থান এবং মাঠ পর্যায়ে সেবা কার্যক্রম তদারকি, গাজীপুর পুলিশ কমিশনারের হস্তক্ষেপে বিক্রিত সন্তান মায়ের কোলে ফেরত আনয়নসহ নানা সচেতনতামূলক উদ্যোগ গ্রহণ এর মাধ্যমে জাতির প্রত্যাশা পূরণে ভুমিকা রেখেছে।

করোনাকালীন সময়ে মানুষ যখন অসহায়, আতঙ্কগ্রস্ত এবং সবাই যখন নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ব্যস্ত এমতাবস্থায় এদের আত্নত্যাগ মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। যার কারণে দেখা যায় ছোট্ট আয়ান ও তার গচ্ছিত টাকার ভল্ট পুলিশের তুলে দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল সে চেয়েছিল পুলিশ সদস্যের কাছে টাকার ভল্ট হস্তান্তরের মাধ্যমে জনগণের পাশে দাঁড়াতে।

পুলিশ বাহিনীর মানবিক আচরণ এবং অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে দেখে এদেশের জনগণ আবারও আশায় বুক বাঁধছে। এ লেখা যখন ছাপা হবে পুলিশ বাহিনীর আত্মত্যাগের পরিসংখ্যান বর্তমানকে ছাড়িয়ে যাবে কারণ এ পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার ১৮৩ জন আক্রান্ত ও ৬১ জনের প্রাণের বিনিময়ে এ বাহিনী জনতার পাশে থেকে সাহস যোগাচ্ছে। এ বাহিনী তার কর্মযজ্ঞ পরিচালনায় নানাবিধ বিষয়ে প্রশ্নবোধক আচরণ ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একক বাহিনী হিসেবে তাদের অবদান ও আত্মত্যাগ জাতি ভুলতে পারবে না। তাদের এই অসীম ত্যাগ ও ভালোবাসার কারণে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গেল। প্রত্যাশা থাকবে এ বাহিনী করোনাকালীন সময়ে সেবার যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে তার ধারাবাহিকতায় দেশমাতৃকার কল্যাণে তাদের প্রচেষ্টা সর্বদা অব্যাহত রাখবে।

লেখক: শিক্ষক, গবেষক ও কলামিস্ট, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: alioakkas@gmail.com

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.