আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

পিরের বাড়ি কোরবানি, একরামুল উম্মাহ ও একজন মনীষা চক্রবর্ত্তী

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৮-০৭ ০০:২৭:২১

সালাহ্ উদ্দিন ইবনে শিহাব :: পিরের বাড়ি কোরবানি হবে কি হবে না এই বিতর্ক যখন সামনে তখন কিছু উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদেরকে চমকিত করে। ফেরেববাজির বিপরীতে অনেক আনন্দ ও স্বস্থি দেয়। চিত্ত প্রশান্ত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে যেমন ভালো কাজে ব্যবহার করা যায় তেমনি অনেক মন্দকাজের ইন্দন যোগানো যায়। করোনাকালে আমরা লক্ষ্য করছি প্রাতিষ্ঠানিক ও ইলমি বিতর্ককে কিছু মওলানা বা নামদারি হুজুররা ফেইসবুকে নিয়ে এসেছেন।

মাঠে সুর আর স্বরের কারিশমা দেখানো যখন শেষ তখন ঘরের খবর পরকে জানানোর এক কুসংস্কৃতি চালু হয়েছে ফেইসবুকে। ফলে নিন্দুকরা হুজুর-মওলানার পশ্চাতদেশে হাত দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের হযরতেরা ভ্রুক্ষেপহীন। অন্ধ হলেও যে প্রলয় বন্ধ থাকে না তা তারা বুঝতেই পারছেন না। নিজকে সেরা মুনাজেরে আযম প্রমাণের জন্য পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তল্লাশি করে নেট দুনিয়ায় হাজির হচ্ছেন। এতে নিজেদের মধ্যে কামড়া-কামড়ির বত্রিশ দাঁত লোকে দেখছে। যদিও এ লেখাটি লিখার সময় অন্য একটি বিষয় মাথায় খেলছে। প্রদর্শন প্রিয়দের বাইরে আমাদের আলেম উলামাদের অনেকই মানবিক দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের এই কার্যক্রমের খবর জানতে পেরে আমরা আশান্বিত হই। বোগাস বকোয়াসগিরির বাইরে কিছু মানুষ ও কিছু সংগঠনের কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসনীয়। যা দেখে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মাথা নত হয়ে যায়। যারা এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছেন তারা ইতিহাসে অমর-অক্ষয় হয়ে থাকবেন।

এই করোনাকালে মানুষের কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ তা বেরিয়ে পড়েছে। কারো মুখের আড়ালে শুধুই মুখোশ আর কারো মুখ অন্যকিছু হয়ে গেছে তা খুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। করোনা দেশ-দুনিয়া, ধর্ম-অধর্ম, কথিত মানবতাবাদ, টকশোবাজ ও সুশীলদের আসল পরিচয় তুলে ধরেছে। করোনার এই অখন্ড অবসরে কিছু মানুষ যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনোদন আর বিতর্কে সময় কাটাচ্ছেন ঠিক তখন সত্যিকার মানব দরদিরা মানবতার চাদর গা জড়িয়ে পথে প্রান্তরে বেরিয়ে পড়ছেন। তারা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। মানুষের দোয়ারে দোয়ারে সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হচ্ছেন। অনেক সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে মানুষের সহযোগিতা নিয়ে তারা কাজ করে গেছেন ও এখনো করছেন।

করোনার শুরু থেকে চোখে পড়ার মতো যে কাজটি করেছে তা একরামুল মুসলিমিন পরে তা একরামুল উম্মাহ নামকরণ হয়েছে। তারা মানবতার পক্ষে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা এই সময়ে ও সমাজে বিরল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃতব্যক্তির দাফন-কাফন ও সৎকারে তারা এক অতিউজ্জ্বল ভূমিকা রাখছেন। অন্যরা যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে একে অন্যকে বাঁশ দেওয়ার ইন্তেজামে ব্যস্ত তখন ইকরামুল উম্মাহর হাবিবুর রহমান মিসবাহ ও তার সহযোগীরা ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, করোনা মহামারিতে আক্রান্ত চাল-চুলোহীন মানুষের সামনে হাজির। গরম খিচুরি রান্না করে নিজে ভ্যান চালিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াচ্ছেন। সামর্থ্য অনুয়ায়ী খাদ্যের প্যাকেট বিতরণ করেছেন। মৃত বাবাকে যে সন্তান ছোঁয়ে দেখছে না, যে স্ত্রী স্কামীর করোনার খবর পেয়ে ঘর তালা দিয়ে পালিয়েছে এমন মানুষের দায়িত্ব নিয়েছে একরামুল উম্মাহ। চাকুরি টিকানো বা বসকে খুশি করা নয় বরং তা করেছেন প্রাণের তাগিদে-স্বেচ্ছায়; মানুষ হিসাবে মানুষের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে। একরামুল উম্মাহর প্রতিটি লাইভ অনুষ্ঠান ছিলো মানুষের জন্য কিছু করার নিমিত্তে।

কিন্তু এর বিপরীতে এদের মতোই পোশাক-আশাকধারীদের কামড়া-কামড়ি করতে দেখছি। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহি কওমি মাদরাসা বোর্ডের ক্ষমতায় কে যাবেন আর কে আউট হবেন তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় নির্লজ্জ্ব বাহাস-মুনাজারা দেখছি। এসব কিছু মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক ক্ষতি ডেকে আনছে। অন্যদিকে পিরের বাড়ি কোরবানি দেওয়া নিয়ে দুইপক্ষের মওলানারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে গরম করে তুলছেন। দলিলের দোকান খোলে বসেছেন। মানুষ যখন খেতে পারছে না; ক্ষুধায় অস্থির। রাষ্ট্র যখন নাগরিক অধিকার প্রদানে ব্যর্থ তখন এসব বিষষ নিয়ে আলাপ কতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ?

করোনায় অর্থনীতিতে ধ্বস নামায় অনেকেই এবার কোরবানি দিতে পারেন নি কিংবা আগের চেয়ে ছোট বাজেটে তা সেরেছেন। এতে অনেক গরীব ও হকদার মানুষ অন্যান্য বছরের তুলনায় হয়তো কোরবানির গোশত পান নি। মানুষ যাতে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য বরাবরের মতো এবারও আরো পরিসরে পদক্ষেপ নেন মানবতার এক মহান সেবক সিলেটের ফুলতলীর পীর সাহেব আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী (বড় ছাহেব)। তাঁর তত্বাবধানে লতিফি হ্যান্ডস নামের দাতা সংস্থা প্রায় ১০ হাজার মানুষের ঘরে কোরবানির গোশত পৌছিয়েছে। স্বার্থপর ও ঘুণেধরা সমাজে এমন দৃষ্টান্ত সীমাহীন আলো ছড়ায়। এর আগেও কয়েক হাজার হিন্দু পরিবারকে ফুলতলী ছাহেব বাড়ির পক্ষ থেকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। ধর্ম ও গোত্র পরিচয় নিয়ে একশ্রেণির মানুষ যখন দ্বিধান্বিত তখন ফুলতলী পরিবারের এমন মানবিক উদ্যোগ প্রশংসনীয়। অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের চোখেমুখে আনন্দ ফুটিয়ে তুলতে জীবনভর নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। অসহায়-অনাথের পরমবন্ধু আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরীর মতো মানুষ এ সমাজে সত্যিই বিরল। যিনি তরিকতের উচ্চ মাকামে অবস্থান করছেন। যার মুরিদের সংখ্যা লাখো লাখো, তিনি সময় কাটাচ্ছেন পথে প্রান্তরে, পাহাড়-পর্বতে, মানবতার খোঁজে। তার চোখ খোঁজছে অন্নহীন, বস্ত্রহীন মানুষকে। তাকে দেখা যাচ্ছে একটি শিশুবাচ্চার সাথে চাটাইয়ে বসে আছেন। ঘরহীনের ঘর নিজহাতে মেরামত করে দিচ্ছেন। এরাই তো প্রকৃত আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। দুনিয়াবি কোন চাওয়া পাওয়া ছাড়া যারা মানুষের পাশে দাঁড়ায় এমন মানুষ এখন কোথায় পাই।

আজ অনেক সেক্যুলার মানবতাবাদিকে আমরা দেখি। মানবতার কথা বলে বলে এরা মুখে ফেনা তোলেন। নিজেদের সুশীল সমাজের সদস্য হিসাবে হাজির করেন। কিন্তু কাজের বেলায় পোরাই ফুক্কা। এই ঈদে আরো একটি উদ্যোগ আমার অন্তরকে নাড়া দিয়েছে। আর তা বরিশাল বাসদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তীর কোরবানির গোশত বিতরণ। ৫টি গরু কোরবানি করে হাজারও মানুষের মাঝে পোলাওয়ের চালসহ বিতরণ করেছেন। প্রায় ৪শ হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এই ঈদে মোরগের গোশতের তেহারি বিতরণ করা হয়েছে। তাঁর এই উদ্যোগ চোখে জল এনেছে। দারুন আপ্লুত হয়েছি। ডা. মনীষা চক্রবর্তী হিন্দু না মুসলিম, ডানপন্থী না বামপন্থী তা আমার দেখার বিষয় নয়। যে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় তাকে তো স্যালুট জানাতেই হয়। কিন্তু এ সমাজ এমন মানুষকে ধারণ করতে পারে না। কিছু হিন্দুত্ববাদীকে দেখলাম মনীষার চরম সমালোচনা করছেন। অনেকে তার নাম বদলে নেওয়ার প্রস্তাব করছেন। হিন্দু হয়ে কিভাবে গো-মাংশ বিতরণ করলেন তা নিয়ে হিন্দুত্ববাদী আপত্তি তোলেছেন। আবার কিছু মুসলিম ছেলেরা কিভাবে কোরবানি দেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে কমেন্টস করেছেন। এগুলো চরম অসুস্থতা। ধর্মীয় উৎসবের একটা মানবিক দিকও থাকে। সকলে এই উৎসবগুলো সমানভাবে উদযাপন করতে পারে না। এই মানুষগুলোর পাশে এসে কিছু হৃদয়বান মানুষ দাঁড়ায়। সে যে ধর্মেরই হোক। কিন্তু আমরা সবকিছুতে খুঁত আবিস্কার করার চেষ্টায় থাকি। কিন্তু উপরে বর্ণিত মানুষগুলোর মতো মানবিক হতে পারি না। কিছুদিন আগে বিএনপির এক মধ্যম সারির নেতাকে দেখেছি নিজ উদ্যোগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী হিন্দু মুসলমানের দাফন-কাফন ও সৎকার করতে। এই অসুস্থ ও ভোগবাদী সময়ে বুর্জোয়া রাজনীতির একজন নেতা বা কর্মীর এমন উদ্যোগকে মারহাবা জানাতেই হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যারা কথায় কথায় অসাম্প্রদায়িক, মানবতার ফেরিওয়ালা ইত্যাদি নাম জপ করেন তাদেরকে আমরা এসব কাজে দেখতে পাই না। টকশোজীবীরা আলোচনা করে রাষ্ট্রকে উলটপালট করে দেন কিন্তু মানুষের পাশে এদের প্রতিচ্ছবি খুবই মলিন। মানুষ এদের আর বিশ্বাস করে না। মানুষ তাদের অনেককেই ঠক, প্রতারক ‘শাহেদ’ চরিত্রেরই ভাবে। যুব সমাজের বড় একটা অংশ চরম ফাজলামোতে সময় কাটাচ্ছেন। ‘টিকটিক’ নামের ভাইরাসের সাথে রাতদিন মিশে আছেন। মানুষকে আনন্দ দেওয়ার নামে কুৎসিত ভিডিও বানাচ্ছেন। এগুলো চরম অসুস্থতা। আমাদের যুব ও তরুণরা খুব ভালো নেই। চরম আত্মকেন্দ্রিকতায় এদের বড় অংশ নিমজ্জিত।

তবুও আমরা চাই যাবতীয় অশুভের বিপরীতে শুভচিন্তার মানুষের সংখ্যা বাড়ুক। মানুষ যে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব তা তাঁর কর্মে প্রমাণ হোক। ঘৃণা নয় ভালবাসার চাষবাস হোক। আলাদা কোন পোষাক নয়, মানবতার পোষাক পরে সকলে কাঁধে কাধ মিলাক। দেশ জাতি ও উম্মাহর দুর্দিনে মানুষই তো মানুষের পাশে দাঁড়াবে। যাবতীয় হিংসা-বিদ্বেষ, ক্লেদ ও বাড়াবাড়িকে ঝেড়ে ফেলে।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, সাপ্তাহিক পূর্বদিক, মৌলভীবাজার।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন