আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

আমীনূর রশীদ চৌধূরী: তাঁকে ভোলা যাবেনা কোনোদিন

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৮-৩০ ১৪:০৭:২৬

অপূর্ব শর্মা :: ‘দূর করো ভাই দূর করো বেইমান সবকো দূর করো...’ আমীনূর রশীদ চৌধূরীর অসমাপ্ত আত্মজীবনী সত্য ও তথ্যের প্রারম্ভিক বক্তব্য এটি। আমিনূর রশীদ চৌধূরী তাঁর বেড়ে উঠা কালের কথা বর্ননা করতে গিয়ে ইংরেজ বিরোধী এই শ্লোগান তুলে ধরেন আমাদের সামনে। তখন সহজেই অনুমান করতে পারি তাঁর জন্মের সময়টা। সহিংস অহিংস উভয় পন্থার আন্দোলনের কারনে দীর্ঘ শাসনের শেষপ্রান্থে তখন দাঁড়িয়ে ব্রিটিশরা। মাহাত্মা গান্ধি এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সংগ্রামে তখন ব্রিটিশদের নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। সেই সময়টাতই আমিনূর রশীদ চৌধূরীর বেড়ে ওঠা। বাঙালির সন্তান হলেও পরিস্থিতিগত কারনে ভূমিষ্ট হওয়ার পর পরই ইংরেজ দম্পত্তির হাতে তুলে দেওয়া হয় তাঁকে। তাদের আপত্য স্নেহে লালিত হয়েছেন তিনি। স্বভাবতই ইংরেজি ভাষা হয়ে উঠে তাঁর মুখের ভাষা। অথচ রক্তের উত্তরাধিকার তাঁকে ব্রিটিশ বিতারণে শুধু উদ্বুদ্ধই করেনি ইংরেজ বিরোধী সহিংস এবং অহিংস উভয় পন্থার আন্দোলনে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়তে করেছে সংকল্পবদ্ধ। ব্রিটিশের সা¤্রাজ্য পতনের ঠিক ৩২ বছর পূর্বে অবিভক্ত ভারতর্ষে জন্মগ্রহন করেন আমিনূর রশীদ চৌধূরী।

কলকাতার ৩৮ নম্বর জাননগর রোডে ১৯১৫ সালের ১৭ নভেম্বর ভূমিষ্ট হন তিনি। তাঁর জন্মের আগের বছর অর্থাৎ ১৯১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরেন মাহাত্মা গান্ধি। সে সময়টায় সারা ভারত ভ্রমন করে তিনি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র অবলোকন করতে থাকেন। যুদ্ধের বিকল্প হিসেবে সত্যাগ্রহ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ন হওয়ার সংকল্পে তিনি তখন বদ্ধপরিকর। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ বিতারণের আন্দোলন শুরুর পটভূমি তৈরি হয় তাঁর জন্মের সময়টায়। তিনি যখন দুই বছরের শিশু সেই সময়টায় ঘটে রুশ বিপ্লব। আমীনূর রশীদের জন্মের আগের বছর বেজে উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা।

বিপ্লব, যুদ্ধ আর আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্যেই আমিনূর রশীদের আগমন ঘটে পৃথিবীতে। যুদ্ধাবহে জন্ম নেওয়া শিশুটির মানষপটেও তাই প্রোথিত হয়ে যায় সংগ্রামমুখরতা। বাঙালি এই শিশুর বিকাশপর্ব মূলত সমৃদ্ধ হয়েছে অগ্রসর বেল দম্পত্তির বদৌলতে। কারন কর্মসূত্রে কলকাতায় অবস্থান করা এই ইংরেজ দম্পত্তি সর্বক্ষেত্রেই ছিলেন প্রাগ্রসর। তাদের এই প্রাগ্রসরতাই শিশু আমিনূর রশীদ চৌধূরীর বোধ শক্তিকে করেছে শানিত, কিন্তু অনুগামি করতে পারেনি এতটুকুও। রক্তের যে উত্তরাধিকার সেটাই সুখ-সাচ্ছন্দে বেড়ে উঠা রশীদ পরিবারের সন্তানকে করেছে মুক্তিকামী, বিপ্লবী। নিজের আরাম আয়েস উপেক্ষা করে তিনি সাধারণের জীবনমান উন্নয়নের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। সার্বজনীনতার পথেই তিনি প্রবহমান করেছেন জীবনের গতিপথ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, গণভোট, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, অসহযোগ আন্দোলন এবং মুক্তিসংগ্রামে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন অকুতভয় বীর সেনানী হিসেবে এবং প্রতিটি লড়াইয়ে হয়েছেন বিজয়ী। মানুষের মুক্তিই ছিলো তাঁর আরাধ্য। সেই আরাধ্যের আরাধনাই আজীবন করেছেন তিনি।       

আমীনূর রশীদ চৌধূরী ব্যক্তিপ্রজ্ঞায় আলোকিত এক অনন্য মানুষ। তাঁর আলোকপ্রভায় আলোকিত হয়েছে সময়। ব্যক্তির উৎকর্ষতা নয় সামগ্রিকতায় বিশ্বাস করতেন তিনি। অতীত আর বর্তমানের সংযোগ স্থাপনেও তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। খন্ডাংশ বা চুর্ণাংশ নয় প্রকৃত সত্য ও তথ্যের পূজারী ছিলেন তিনি। সত্যকে ধারণ করেই অব্যাহত ছিলো তাঁর জীবনের গতিপথ। জেল, জুলুম আর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করা ছিলো তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি। ‘সত্য যে কঠিন সে কখনো করেনা বঞ্চনা’- কবির এই অমোঘ বাণীকে মর্মমূলে লালন করেছিলেন গভীর প্রত্যয় আর বিশ্বাসে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে এতটুকু বিচ্যুৎ হননি। কর্মের প্রতি ছিলেন শতভাগ নিষ্ঠাবান। সে কারণে তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কর্মবীর শব্দটি।

সিলেটের ন্যায্য দাবি দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে আপোষহীন থাকায়-সিলেটবন্ধু অভিধাটিও চিরদিনের জন্য নিজের করে নিয়েছেন আমীনূর রশীদ চৌধূরী। যুদ্ধ কিংবা বিপ্লবে, ত্যাগে কিংবা সংগ্রামে, নীতিনিষ্ঠায় সমকালে তাঁর মতো মুক্তিপথের অভিযাত্রী আর একজনও নেই কথাটি বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেই। তিনি দুহাত ভরে শুধু দিয়েই গেছেন, বিনিময়ের প্রত্যাশা করেননি কখনও।

‘ছাত্র জীবনেই স্বাধীনচেতা উদার মানসিকতার আমীনূর রশীদ চৌধূরী ১৯২৯ সালে গান্ধী আন্দোলনে যোগদান করেন এবং ১৯৩০ সালে কারাবরণ করেন। উপমহাদেশের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদদের সাহচর্যে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা প্রখর ও সুদৃঢ় হয়েছিল। অবিভক্ত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন তরুণ সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি দফায় দফায় কারাবরণ করেছেন এবং শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কারণে পাকবাহিনী ’৭১-এ তাঁকে সিলেট রেসিডেন্সিয়াল পাবলিক স্কুলে ১৩০ দিন বন্দি রেখে অমানবিক নির্যাতন করে এবং তাঁর সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে। সততা ও মানবিকতার আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে তিনি সংযুক্ত হয়েছেন বহু সামাজিকতায় এবং করে গেছেন এমন কিছু যুগান্তকারী কর্মকান্ড যা আজ চিরস্মরণীয় কৃতিত্বে রূপান্তরিত হয়েছে।

সিলেট মহিলা কলেজ, তিব্বিয়া কলেজ, সিলেট ল’ কলেজ, সিলেট প্রেসক্লাব, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ সিলেটের সার্বিক স্বার্থ রক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনন্য ও সর্বজনগৃহীত।

সিলেটের প্রাচীন সংবাদপত্র ‘যুগভেরী’ তাঁর হাত ধরে সম্পূর্ণরূপ ধারণ করে এবং অনন্যতা অর্জন করে। সিলেট তথা উপমহাদেশের ইতিহাসে ‘যুগভেরী’ কিংবদন্তীতে পরিণত হয় আমীনূর রশীদ চৌধূরীর দক্ষতাতেই। ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার দায়িত্ব তিনি ১৯৬০ সাল হতে সম্পূর্ণরূপে পালন করতে শুরু করেন। সিলেটে সংবাদপত্র তথা সাংবাদিকতার সেটি ছিল একই সাথে প্রারম্ভিক এবং স্বর্ণযুগ। উলে­খ্য, ‘যুগভেরী’ নামকরণও তারই অবদান।’

তাঁর জন্মের শতবর্ষ পরও তাই তিনি প্রাসঙ্গিক। তাঁর আদর্শ, চেতনা আমাদের চলার পথের পাথেয়। অথচ সমাজ ও রাষ্ট্র সেভাবে মূল্যায়ন করেনি এই সূর্য সন্তানকে। এতে আমীনূর রশীদ চৌধূরীর কিছু যাবেও না আসবেও না। কারণ আজ এসবের অনেক উর্ধ্বে তাঁর অবস্থান। কিন্তু একজন আমীনূর রশীদ চৌধূরীকে যদি মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে আগামীতে তাঁর আদর্শের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে অগ্রগামী হবে কেউ না কেউ। কারণ গুণের কদর না করলে গুণীর জন্ম হয় না সমাজে।

সিলেটের সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃত, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিলেটবন্ধু আমীনূর রশীদ চৌধূরীর আজ ৩৫তম প্রয়াণবার্ষিকী। মহাপ্রাণ এই মানবদরদী ১৯৮৫ সালের ৩০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াণদিবসে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি তাঁকে। সেই সাথে দাবি জানাচ্ছি রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে মূল্যায়ণের।


লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক যুগভেরী

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন