আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মাজার দর্শন

পূর্ণ দৈর্ঘ্য জীবনের স্বল্পদৈর্ঘ্য রোজনামচা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৯-০৬ ২৩:১২:৫৮

ফারজানা ইসলাম লিনু :: দরগার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম গতকাল সন্ধ্যার পর। মনের সুখে কোন শুঁটকি প্রেমিক মহিলা দুপুরের রান্নাকরা শুঁটকি তরকারি চুলায় গরম বসিয়েছে। বিটকেল গন্ধে খালি আমার না পথচারী দের সবার নাকে হাত। সাইনাসের কারণে ঘ্রাণ শক্তি আমার ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হলেও বাজে গন্ধে কোন ছাড় নেই। ঘ্রাণেন্দ্রিয় ছুঁয়ে যাবে ঠিকই। সাথে সাথে বিরক্তিকর মস্তিষ্ক ব্যাথা থেকে রক্ষা নেই। দু আঙ্গুলে নাক চেপে ধরে আছি।

অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর আমার কখন শেষ হবে জানিনা। মাজারে আসা পুণ্যার্থিদের গাড়ি বহরের লম্বা লাইন। বার বার জ্যামে আটকা পড়ছে আমার ত্রিচক্রযান। বিশাল বাসের একেবারে গা ঘেষে থামার সাথে সাথে আমি চিৎকার দেই, মামা রিক্সা দূরে সরিয়ে রাখেন।

কি করবাম মায়া? ফাঁক তো নাই।

ঢাউশ সাইজের বাস গুলো পুরা রাস্তা জুড়ে আছে।

ড্রাইভার মামা ভেবেছেন এক্সিডেন্টের ভয় পাচ্ছি।
একটু অভয় দিয়ে বলেন, মায়া, চিন্তা করিও না বাসের নিচে ঢুকাইতাম নায়।

বাসের নিচে, উপরে ঢুকার চিন্তা না মামা! পরে বিস্তারিত বলবো আগে রিক্সা সরিয়ে রাখেন।

বেচারা ড্রাইভার মামা কি করবে?

পুর্ণ্যার্জনের আশায় দূর দুরান্ত থেকে মাজার জিয়ারতে আসা লোকজনের ভীড়ে তিল ধারণের জায়গা নেই।

দীর্ঘ ভ্রমণে বাস যাত্রীদের উর্ধ্বমুখী চাপ বেশি থাকে। জায়গায় বে জায়গায় বর্জ্য উগলে দিয়ে পথচারী দের জন্য এক বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী করে তবে না পুণ্য নিয়ে ফিরে যান নিজ ভূমে।

আমি অসহায় রিক্সা যাত্রী এদের নিয়ে মহা চিন্তায় আছি

টেনশনে আমার গলা শুকিয়ে চৈত্র মাসের শুকনো কুয়া।
আমার চিন্তা ভাবনা যে মোটেই অমূলক নয় তা প্রমাণ হতে সময় লাগেনা। হাত দুয়েক তফাতে এক বয়স্ক মহিলা বাসের জানালা দিয়ে কল্লা বের করে ওয়াক, ওয়াক। আমি চোখ কান বন্ধ করে বলি মামা রিক্সা সরাও।

কি করবাম মায়া? জায়গা নাই।

আঙ্গাজের নাম কিড়িমিড়ি অবস্থা আমার, ড্রাইভার মামার একটু মায়া লেগেছে মনে হয়। পেছনের রিক্সাকে অনুরোধ করে একটু পেছনে সরিয়ে নিজে রিক্সা নিরাপদ দুরত্বে রাখলেন।

কিসের নিরাপদ দুরত্ব! এইবার অল্প বয়সী মেয়ে একটা আমার থেকে একটু পেছনে ওয়াক ওয়াক শব্দে নাড়িভুঁড়ি বের করে বমি শুরু করছে। দৌড়ে রিক্সা থেকে নেমে ফুটপাতে গিয়ে দাড়াই।

ড্রাইভার মামাকে বলি, মামা যাও ঐ বাসের হেল্পারকে কান ধরে নিয়ে আসো।

মামা ফিরে এসে তেতুল বিচি রঙের দাঁত বের করে বলেন, মায়া হে তো চা খাইতে গেসে।

মাথা ধরা আমার বাড়ছে। মেজাজ ছাপ্পান্ন ছুঁই ছুঁই।
ভাবলাম বাড়াবাড়ি মনে হয় বেশি হয়ে যাবে।
তবুও বললাম, হেল্পারের ওস্তাদ কি গাড়িতে বসা?
জ্বী মায়া।

তারে বলে আসো ডজন খানেক পলিথিন ব্যাগ এক্ষুনি কিনে এনে যেন বাসের যাত্রীদের মধ্যে বিতরন করে।

ড্রাইভার মামা খবর দিতে কিছুটা অপারগতা প্রকাশ করলেন। কিন্তু আমার জোরাজুরিতে না গিয়ে পারলেন না শেষপর্যন্ত।

ভাবলাম রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা দেই। কিন্তু দরগার ভেতর থেকে আলিয়া মাদ্রাসার মাঠের কর্ণার পর্যন্ত হেঁটে আসা নিরাপদ না। একটু পর পর পীর ফকির গোছের একেকজন আসে আর নানা ভঙ্গিমায় টাকা চায়। হাতের লাঠি ঝনঝন করে বাজিয়ে চলে কসরত। মহিলাদের দেখলেই এই বিশেষ চাঁদাবাজি বেড়ে যায়। এসব চিন্তায় রিক্সা ছাড়ার চিন্তা আপাতত বাদ।

অগত্যা রিক্সায় বসে প্রমাদ গুনা ছাড়া বিকল্প পথ নেই।

এতক্ষণে ড্রাইভার মামা হেল্পারের ওস্তাদকে আমার খবর পৌছে দিয়ে ফিরে এসেছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, মামা কি বলেছে হেল্পারের ওস্তাদ?

কিচ্ছু কয় নাই মায়া।

জ্যাম ছুটতে শুরু করেছে অল্প অল্প করে। রিক্সা ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার ধপাস করে কিসের পুটলা যেন পড়লো আমার সামনে। পুটলার ভেতরের সরঞ্জামাদি রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে। বুঝতে বাকি থাকলো না বমি ভর্তি ব্যাগ এইবার আমার সামনে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।

ড্রাইভার মামা প্রচণ্ড রাগ নিয়ে আমাকে বলেন, দেখেন মায়া ব্যাগে বমি কইরা রাস্তায় ফালাইছে। ব্যাগ দিয়া হ্যাগোরে কি হইতো?

রাগে, দুঃখে, বিরক্তিতে আমার জবান সাময়িক বন্ধ। বাকরুদ্ধ ভাব কাটানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু মুখে কথা আসছে না।
অনিচ্ছাকৃত নিরবতা পালনের ব্রত নিয়ে আমি রিক্সায় চোখ বন্ধ করে বসে আছি। ভেতরে ভেতরে কিছুটা উদ্বিগ্ন মেয়ের ক্লাস ছুটি হয়ে যাবে।

বাসের ভেতর থেকে ছাগল একটা ডেকে উঠলো,ম্যাঁয় ম্যাঁয়। আল্লাহ জানেন বেচারার আবার উর্ধ্বমুখি অথবা নিম্নমুখী কোন চাপ ধরলো কিনা!

বাসের গায়ে লিখা ঢাকা-মাওয়া-কাওড়াকান্দি-। আরো কিছু একটা লিখা আছে বুঝতে পারছিনা। আগামীকাল শুক্রবার ছাগলটাকে মাজারের ডেক্সিতে দান করা হবে নয়তো জবাই করে শিরনি দেয়া হবে। অতিরিক্ত ডাকাডাকির কারণে ছাগলটাকে বাইরে বের করে আনা হয়েছে। তাও ডাকাডাকি থামছেনা। কান লম্বা কালো চকচকে ছাগলটা ডেকে চলছে অবিরাম। ছাগলের মালিক একটু আড়ালে নিয়ে ছাগলটাকে হিসু করাচ্ছে।

আহারে নালায়েক প্রাণী! সে ও চিৎকার করে জানান দিচ্ছে তার প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হবে। আর আমাদের মানবকুল পথচারীদের গায়ে বমি করে পুণ্য কামাচ্ছেন।
ফুটপাতে জায়গায় জায়গায় পুণ্যার্থিদের ভীড়। ছোট ছোট বাচ্চারা অবলীলায় প্রাকৃতিক কর্ম সারছে খোলা আকাশের নিচে। সাথে থাকা গাট্টি বোচকায় হেলান দিয়ে ক্লান্ত পুরুষ মহিলারা বিশ্রাম নিচ্ছেন।

পুরা সপ্তাহের না হলেও আমার মনে হয় প্রতি বৃহস্পতিবারে দরগা ও তার আশে পাশে এমন দৃশ্য অতি সাধারণ।

জীবনের সব সঞ্চয় জমিয়ে গোনাহ মাফের আশায় লোকজন আসেন মাজার জিয়ারতে। পুণ্যভূমি ও মাজারের শহর সিলেটের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে সব মানত ইবাদত শেষ করে শুক্রবার রাতে বা শনিবারে ফিরে যাবেন পুণ্যার্থীরা।
নিজের কান ভালো করে মলে দিয়েছি, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর আর ঐ পথে রিক্সাযাত্রা বন্ধ আমার।

ফারজানা ইসলাম লিনু : শিক্ষিকা ও গল্পাকার

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন