আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

অন্ত্যলীলায় শ্রীপাদ মিশ্র

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৯-১৭ ১৭:২১:৫৬

মনোজবিকাশ দেবরায় :: শ্রীরাধাবিনোদ মিশ্র একটি নন্দিত নাম। পবিত্র এ নামটি মুখে উচ্চারণ করলে দেহ পবিত্র হয়। শ্রীমতী রাধারাণীকে যিনি বিনোদন বা আনন্দ দিতে পারেন তিনিই ‘রাধাবিনোদ’। এই রাধাবিনোদ বলতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বোঝায়। কৃষ্ণ নাম নিলে কী হয় আমরা সবাই তা জানি। এ বিষয়ে শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গাইলেন-
কৃষ্ণনাম কৃষ্ণগুণ কৃষ্ণলীলাবৃন্দ।
কৃষ্ণের স্বরূপ সম সব চিদানন্দ (০২.১৭.১৩০)
শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী জগৎ জীবকে জানলেন ১. কৃষ্ণনাম ২. কৃষ্ণগুণ ৩. কৃষ্ণলীলা এগুলো সবই কৃষ্ণের স্বরূপ এবং মানুষকে আনন্দে আপ্লুত করে। ‘রাধাবিনোদ’ নামটি শ্রবণ করলেও দেহের কলুষ নাশ হয়ে প্রেমের উদ্দীপন হয়। এই মধুর নামটি পেয়েছিলেন শ্রীপাদ মিশ্র তাঁর পিতা-মাতার নিকট থেকে। পিতা-মাতার দেয়া এ নামের সার্থকতা দেখিয়ে গেলেন শ্রীপাদ মিশ্রজী তাঁর যাপিত জীবনে। এই বৈষ্ণব মহাত্মার জীবন কথা অতি পবিত্র। একটি ত্যাগী জীবন, পরার্থে উৎসর্গীকৃত জীবন। এই ত্যাগী বৈষ্ণব মহাত্মার পদকমলে বার বার প্রণতি নিবেদন করি।

০২. কলিপাবনাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবাদর্শে যাপিত জীবনের বিগ্রহ শ্রীপাদ রাধাবিনোদ মিশ্র। মহাপ্রভুর আদর্শ হলো লোককল্যাণ। মানবসেবা। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা হলো-
ভারত-ভূমিতে হৈল মনুষ্য জন্ম যার।
জন্ম সার্থক করি কর পর উপকার (০১.০৯.৩৯)
চৈতন্যপদাঙ্কিত ভূমিতে যাঁর জন্ম হয়েছে তিনিই ধন্য এবং এ মানব জীবন সার্থক করার উপায় হলো মানুষের উপকার করা। বর্তমান বিশ্বে আমরা প্রত্যেক যখন স্বসুখ বাসনায় লিপ্ত এমনি সময়ে চৈতন্য আদর্শের পতাকাকে উড্ডীন করেন শ্রীপাদ মিশ্র। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি নিয়েও তিনি কোন রাজকর্মচারী হতে চাননি বরঞ্চ তাঁর কুলের দেবতার পদকমল সেবাতেই নিজেকে উৎসর্গ করে ছিলেন। এই ব্রাহ্মণদেবতা তাঁর কুলের গৌরব ‘শ্রীচৈতন্যচরণসুখৈক তাৎপর্যময়ী সেবাতে’ নিজ জীবনকে নিয়োজিত করেন। শ্রীচৈতন্যচরণে অটুট ভক্তি না থাকলে তা কি সম্ভব হয়? মহাপ্রভুর সেবা ছিল তাঁর জীবন ধন। তথাপি এ সেবানন্দে তিনি বুঁদ হয়ে থাকতেন। প্রভুর পরিকর ছাড়া এমন প্রেমসেবা কে করতে পারে?

০৩. ঢাকাদক্ষিণ কলেজে তিনি অধ্যাপনা করতেন। শ্রীচৈতন্য যেমন সিলেটি ভাষায় মাঝে মাঝে কথা বলতেন শ্রীপাদ মিশ্র সব সময় মায়ের ভাষায় কথা বলতেন। ছাত্রগণ তাঁর ক্লাশে খুব আনন্দ পেতেন। ডানপিঠে ছেলেরাও কোনদিন তাঁর ক্লাশ মিস করতেন না। এ যেন আনন্দেরই মূর্তি। আনন্দ শব্দটি আমরা শুনেছি কিন্তু এর মূর্তি কখনও দেখিনি। আনন্দের মূর্তি আমরা দেখেছি শ্রীপাদ মিশ্রজীর মধ্যে। আজানুলম্বিত এ মানুষটি যেকোনও বিষাদের পরিবেশকেও আনন্দমুখর করে তুলতে পারেন। পাঠে, বক্তৃতায়, গানে কথাবার্তায় সর্বদা আনন্দভূমিতে ছিলো তাঁর বিচরণ। আমরা দেখি শ্রীচৈতন্য পরিকর রঘুনাথ দাস, শ্রীরূপ, শ্রীসনাতন প্রমুখকে প্রভু স্বয়ং তাঁদের জমিদারী তথা মন্ত্রীত্ব ও ঐশ্বর্য বৈভব থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর পদকমলে তেমনি শ্রীপাদ মিশ্রজীকেও তিনি টেনে নিয়েছিলেন তার চরণতলে। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ। শ্রীপাদ মিশ্র শুয়ে আছেন গভীর রজনী। হঠাৎ কীর্তনের শব্দ শুনলেন তিনি। আবেগে আপ্লুত হয়ে সামনে গেলেন। দেখেন শ্রীচৈতন্য কীর্তনসহ প্রবেশ করছেন ঢাকাদক্ষিণে। দন্ডবৎ হয়ে পড়লেন প্রভুর চরণে। প্রভু বললেন, ‘মিশ্র কিছু কথা আছে।। একান্তে এসো।’ মন্দিরের সামনে বড় বৃক্ষের নিচে বসলেন দু’জনে। প্রভুর বদনকমলে মধুর হাসি। শোন মিশ্র, ‘আমি তোমাকে আরও বেশি করে পেতে চাই। একটু ভেবে দেখোনা। তুমি যখন কলেজে চলে যাও আমার ভালো লাগে না। আমাকে আর একটু সময় দেও না। তুমি ভাবছো চলবে কী করে? হতাশ হয়ো না। তোমার অভাব হবে না।’ ঘুম ভেঙে গেলো। একি স্বপ্ন না বস্তব। মনে হলো-
অজিও সে নিত্যলীলা করে গৌর রায়।
কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়
এরপরেই তিনি কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন প্রভুর সেবায়। নিজে সেবা করতেন। সেবানন্দে এতোই বিভোর থাকতেন যে কীভাবে বেলা গড়িয়ে চলে যেতো তিনি বুঝতে পারতেন না। তাই প্রায়ই দুপুরের ভোগ দিতে বিকেল হয়ে যেতো তিনি বুঝতে পারতেন না। প্রায়ই দুপুরের ভোগ দিতে বিকেল হয়ে যেতো। প্রীতির ভূমিতে নীতি অচল হয়ে যায়। একেই বলে প্রেমসেবা। মহতের ক্রিয়ামুদ্রা অনেক সময় আমরা না বুঝে নানা মন্তব্য করি। এগুলো অসুন্দর।

০৪. জন্মাবধি তিনি শ্রীচৈতন্য সেবা করেছেন মনের মাধুরী নিয়ে। নিজে লাগানো ছাদের উপরের ফুল গাছ ও অঙ্গনের বিভিন্ন ফুল নিজে চয়ন করে প্রভুকে সাজাতেন মনের আনন্দে। একা সেবা করতেন। তিনি বলতেন, আমার প্রভুকে আমি সেবা করতে চাই। তাই অন্য লোক নিতে মন চায় না। প্রভু যে আমার হাতে সেবা চান। আমাকে তিনি বড়ো ভালোবাসেন। তাই আমি এমন করি। আমি মহাপ্রভুর এক পুতুল। আমাকে তিনি যেভাবে নাচান আমি সেভাবেই নৃত্য করি। এতে করে কাউকে আনন্দ দিতে পেরেছি। কাউকে আনন্দ দিতে পারিনি। যাদেরে আনন্দ দিতে পারিনি এ ব্যর্থতা আমার। প্রভুর চরণে প্রার্থনা করি সকলেই প্রেমভক্তি লাভ করুন তবেই মনের কলুষ যাবে। প্রেমভক্তির জোৎস্নায় স্নাত হলেই আপ্রাকৃত আনন্দ হৃদয়ে অনুভূত হয়। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জের সর্বত্র তিনি চৈতন্য বার্তা প্রচার করেন যেন এক চলমান তীর্থ।

০৫. ২০২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ্চ মাস থেকে তিনি শ্রীচৈতন্যচরণসেবা ছেড়ে কোথাও যাননি। একদিন তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল ফোনে। কোভিড-১৯ সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘জয় মহাপ্রভু। এ যে মহাপ্রভুর কৃপা। প্রভূর এক বিস্ময়করলীলা চলছে বিশ্বব্যাপী। বহির্মুখী মানুষকে কৃষ্ণমুখী করার জন্যই এই মহামাঙ্গল্যময় লীলা। প্রভু জগজ্জীবকে ডেকে বলছেন, তোমরা সত্যমুখী হও। অসত্যের পথ থেকে ফিরে এসো। অসুন্দর ত্যাগ করে সুন্দর হও। অশান্তির রাস্তা ছেড়ে শান্তির পথে এসো। হৃদয়ে আমাকে দেখো। আমি তো তোমাদের হৃদয়ে আছি। একবার মনে প্রাণে ডাকো। বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে এসো। আমাকে নিশ্চয়ই পাবে।’
জীবনে নিবিড় সেবা করার সুযোগ পাইনি। দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছি। এবার গম্ভীরায়। একান্তে প্রভুরচরণতলে বাস আর মনের আনন্দে হৃদয় উজাড় করে দিয়ে প্রভুর সেবা। এমন সুযোগ করে দিয়েছেন অপার করণানিলয় প্রভু আমার। আমার প্রভুর চরণতলে লুটিয়ে বলি, হে পরমদয়াল! এ গম্ভীরাতেই আমি চাই তোমার নিত্যসেবায় চলে যেতে। মার্চ মাসের কথা। ছয় মাস পরেই তিনি চৈতন্যচরণে আশ্রয় নিলেন ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ খ্রিস্টাব্দে প্রভুর মন্দিরের সামনে। এটি এক অলৌকিক ও বিস্ময়কর কাহিনি।

০৬. দেহত্যাগের পূর্বদিন ০৪.০৯.২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই অসুস্থ বোধ করছিলেন। তাই বলে প্রভুর সেবা ত্যাগ করেননি। নিজেই সেবাপূজা করেছেন। আঙ্গিনার ফুটা ফুল এনে সাজিয়েছেন প্রভুকে। কী সুন্দর দৃশ্য! মাঝে মাঝে ‘জয় মহাপ্রভু’ বলে জোড়ে চিৎকার। সমস্ত বেদনা যেন প্রভুর নিকট সমপর্ণ চলছে। সেদিন ০৪.০৯.২০২০ খ্রিস্টাব্দ। শ্রীপাদ মিশ্র অন্তরে মহাকালের আহবান শুনেছিলেন। তাই তাঁর অন্তিম প্রস্তুতি ছিলো বড়ো হৃদয়গ্রাহী। অমল পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবত মৃত্যুপথযাত্রীর জন্য তিনটি নির্দেশ দিয়েছেন। ১. মৃত্যুভয়ে ভীত না হওয়া ২. সংসার আসক্তি ত্যাগ ৩. হরিনামে মন লাগাইয়া দেওয়া। শ্রীমদ্ভাগবতের এ তিনটি আজ্ঞাই তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। শ্রীপাদ মিশ্র ছিলেন জীবন্ত ভাগবত। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রঘুনাথ ভট্টকে যে উপদেশ দান করেছিলেন তা তিনি স্মরণে রেখেছেন।
ভাগবত পড় সদা লহ কৃষ্ণনাম।
অচিরে করিবেন কৃপা কৃষ্ণ ভগবান (০৩.১৩.১২০)
মহাপ্রভুর অন্তিম আহবানে ভীত হননি শ্রীপাদ মিশ্র। তিনি বরঞ্চ খুশি হয়েছিলেন যে নামাচার্য হরিদাসের মতত্ত তিনি প্রভুর সামনে দেহখানি রাখবেন। প্রথমেই তিনি সংসারের বন্ধন অনাসক্তিযোগে ছিন্ন করেন। চলে আসেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সামনে নাটমন্দিরে। সারা রাত তিনি এখানেই কাটিয়েছিলেন। বুকের ব্যথায় ছটফট করছিলেন। বার বার ‘জয় মহাপ্রভু’ বলে চিৎকার। বার বার বলছিলেন, আমি কিন্তু তোমার চরণ ছেড়ে যাবো না। মুখে উচ্চারণ করছিলেন মধুর হরিনাম। বিনিদ্র রজনী কেটেছে। শুধু নাম আর নাম। তাঁর অন্ত্যলীলাতে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করছিলেন বাজিতপুরের শ্রীসজীব দাস, তেলিয়াপাড়ার শ্রীহীরেন্দ্র এবং গোয়ালাবাজারের শ্রীমতী সন্ধ্যা চক্রবর্তী। নিশ্চিদ্র ভজানানন্দে দেহরক্ষার পূর্বরাত এবং শেষক্ষণ অবধি তিনি ছিলেন। তাঁর শ্রীমুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল এক মধুর শ্লোক-

অয়ি দীনদয়াদ্র নাথ হে
    মথুরানাথ কদাবলোক্যসে।
হৃদয়ং ত্বদলোককাতরং
    দয়িত ভ্রাম্যতি কিং করোম্যহম (০২.০৪.০২)
হে দীনদয়াল! হে প্রভু! হে মথুরানাথ! আমি কবে তোমার দেখা পাব? হে প্রিয়! তোমায় না দেখে হৃদয় আমার কাতরে হয়ে পড়েছে; আমি আর কী করবো বলো।
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ খ্রিস্টাব্দ। ক্রমেই দেহ নীথর হচ্ছে। এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ থেকে কৃষ্ণ অনুরাগী যুবক সংঘের ৪০ জন ভক্ত আসেন শ্রীহিমাদ্রী শেখর রায় (প্রান্ত) এর সঙ্গে। উদ্দন্ড কীর্তনে মেতে উঠেন তাঁরা শ্রীপাদ মিশ্রজীকে ঘিরে। এমনি সময়ে জয় মহাপ্রভু উচ্চারণ করে তিনি তাঁর দেহ থেকে প্রাণ উৎক্রামণ করেন।
রাধাবিনোদ ছিলেন বাংলার শিরোমণি।
তাঁর প্রয়াণে রত্নশূন্য হইলা মেদিনী
শ্রীপাদ মিশ্র তোমায় নমি বারে বার।
এ দাসের শিরেতে করো কৃপার বিস্তার
শ্রীল রাধাবিনোদ মিশ্র বাঙলার মানুষের অন্তরে থাকবেন অনাদিকাল।
জয় জগদ্বন্ধু হরি। জয় মহাপ্রভু।

লেখক : সম্পাদক, শ্রীচৈতন্য গবেষণা কেন্দ্র, সিলেট।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন