আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মেঘ পাহাড়ের দেশে (পর্ব ২)

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-১০-১৫ ০০:১৯:১৩

ফারজানা ইসলাম লিনু :: সময়মত বুকিং না দেয়াতে শিলং ভ্রমণ অনেকখানি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজের প্রচেষ্টায় গেস্ট হাউসে রুম প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। গোছানো ছিমছাম গেস্ট হাউসে সব কিছুই রেডি। ঘন্টা খানেকের ভেতর গোসল, নামাজ, খাওয়া দাওয়া সম্পন্ন করে লাবান দর্শনে বের হই। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে সবাইকে খানিকটা ক্লান্ত দেখায়। ছানাপোনারা ক্লান্তিকে বেশ পাত্তা দেয় না। বেশ চনমনে ভাব তাদের। মধ্যবিত্তের জীবন আমাদের চাইলেই যখন তখন ঘুরতে যেতে পারিনা। অনেক হিসেব নিকেশ, সময় জ্ঞান মেনে চলতে হয়। যখন সুযোগ আসে,ঘুরতে যাওয়া হয় কোথাও বাচ্চারা অনেক আনন্দ পায়। ওদের আনন্দ দেখে মনে হয়, এই তো জীবন। ভাবনাহীন নিরন্তর ছুটে চলি আপন বেগে, ঘুরে দেখি পৃথিবীর এমাথা ওমাথা।

আপাতত পুরে পৃথিবী নয় পায়ে হেঁটেই চলছে আমাদের লাবান দর্শন। আব্বার ফেলে যাওয়া শৈশব, কৈশোর ও তারুন্যের দৃপ্ত পদাবারে মুখরিত লাবানে আমরা। কি এক ভালো লাগায় আচ্ছন্ন আমি মুখে বলে বোঝাতে পারিনা। মুগ্ধতা আর বিস্ময় বাড়ছে ক্ষনে ক্ষনে। বলা তো যায় না, পেয়ে যেতে পারি সত্তর বছর আগের কোন স্মৃতি। বৃটিশ আমলের স্কুল বা কোন স্থাপনা দেখলে থমকে দাড়াই। এই বুঝি আব্বা চাচাদের স্কুল। কতগুলো পুরোনো দিনের আসাম প্যাটার্নের বাড়িও চোখে পড়ে। শতবর্ষী বাড়ি গুলোর রক্ষনাবেক্ষন দেখলেই মনে হয়, এইতো সেদিন বানানো হয়েছে। পরিচ্ছন্ন পরিপাটি প্রতিটা বাড়িতে রয়েছে সুন্দর ফুলের বাগান। শান্তশিষ্ট পাহাড়ি এই শহরে নিরাপত্তার কোন ঘাটতি নেই। নেই কোন ময়লা আবর্জনা। একটা উন্মুক্ত ডাস্টবিন মনে হয় খোঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও। সরকারি স্থাপনাগুলোতে সুনসান নিরবতা। গেটের সামনে পাইক, বরকন্দাজ তেমন চোখে পড়েনা।

পদব্রজে চলছে আমাদের শিলং দর্শন। লাবান পেরিয়ে রাইনো মিউজিয়ামের সামনে চলে এসেছি হাঁটতে হাঁটতে। মাঝে মাঝে বিরতি নিয়ে নানা পদের মিষ্টি ও স্থানীয় খাবার পরখ করি। স্থানীয় লোকজনের চেয়ে ভ্রমণেচ্ছুক পরিব্রাজক বেশি।

 সন্ধ্যা হতে সময় নেই আর। অফিস ফেরা মানুষের তাড়া।কার্ড পাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়ছে সবাই। বেশির ভাগ মানুষ বাড়ি ফিরছে পায়ে হেঁটে। রিক্সা বা অটোরিকশার ভীড় না থাকাতে রাস্তায় ট্রাফিকজ্যাম নেই। টাউন বাস, ছোট ট্যাক্সিক্যাব ও ভেসপা চলছে বেশি। শহরের ভেতর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রেখেই তৈরী হয়েছে রাস্তা গুলো। উচু টিলা না কেটে প্রকৃতির নিজস্বতা রক্ষা করে বানানো রাস্তায় আমার মত দুর্বল হৃদপিন্ডের মানুষের হাঁটতে কষ্ট হলেও ভালো লাগে। এয়ার ভাইস মার্শালের সদর দফতরের সামনে এসে একটু দম নেই। সবার সাথে হেটে তাল মেলাতে পারিনা। বিশাল শতবর্ষী এক গাছের নিচে বসে পড়ি। সঙ্গী সাথীরা আমাকে পশ্চাতে ফেলে অনেক দূরে তখন। একটু একটু আড়াল হচ্ছে সবাই। আমারও অভিমান হয়, ডাকতে গিয়ে ডাকিনা। আবার মনে মনে ভয় লাগে, যদি হারিয়ে যাই অচেনা এই শহরে? হারিয়ে গেলে গেলাম আর কি। দেখি আমাকে না পেয়ে সবাই কি করে। অযথা নিজেকে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত অমনি ছেলে মেয়েদের চিৎকার, আপনি এখানে বসে আছেন? আমরা তো পেছন ফিরে আপনাকে খুজে পাই না। এই অল্প হাঁটাতেই ক্লান্তি ! তা হলে আপনি হিমালয় দেখতে যাবেন কেমনে? আমরা তো বাফনের সাথে এই মাত্র কথা বলে ঠিক করলাম, আমরা কিছুদিনের ভেতর নেপাল যাবো। তার পর হিমালয়। আপনাকে রেখেই হিমালয়ে যেতে হব। উত্তরের তোয়াক্কা না করেই সমস্বরে চলতে থাকে কথার পিঠে কথা।
কই ভেবেছিলাম আমাকে খুঁজে না পেয়ে কপালে চিন্তার রেখা ফুটবে! চিন্তার তো কোন লেশ মাত্র নেই উল্টো ভৎর্সনা চলছে। চলছে আমাকে বাদ দিয়ে হিমালয় দর্শনের পরিকল্পনা। তাদের ক্লান্তিহীন কিলবিলানি দেখে নিজের খানিক লজ্জা লাগলো। লজ্জা গোপন করে কিছুটা শক্ত হয়ে বলি আমি আর এক পা ও হাঁটবো না। দরকার নেই আমার হিমালয় দর্শনের। শিলং দর্শনই যথেষ্ট।

আমার অপারগতায় গত্যন্তর না পেয়ে সবাই মিলে অপেক্ষা করে যানবাহনের।একটাও খালি ট্যক্সি চোখে পড়েনা। রাস্তা পার হয়ে যাই ওপাশে। একটা টাউন বাস পেয়ে ধপ করে উঠে পড়ি সবাই। সীট খালি না পেয়ে বাদুরের মতো ঝুলে ঝুলে চলছে বাস চড়া। সীট খালি হলেই একজন একজন করে বসি। সীট পেয়ে সবাই বসতে না বসতে পুলিশ বাজারে চলে আসে বাস। আসতে তেমন একটা সময় লাগেনি । জনাকীর্ন পুলিশ বাজারে নেমেই মনে হল অতিপরিচিত জায়গায় এসেছি। শহরের নিস্তব্ধটা কাটিয়ে এই জায়গায় অনেক কোলাহল। বেশিরভাগই বেড়াতে আসা পর্যটক। হকার, ক্রেতা সবার হাঁকডাঁকে পুরাই সরগরম জায়গাটা। পানি পুরি, ভেল পুরি, মমোস সহ নানা খাবারের স্বাদ নিতে ব্যস্ত আমার ছেলেমেয়েরা। আমি বড় সাইজের দুইটা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে বসে পড়ি। আশপাশে নানা ভাষাভাষীর ভীড়ে সিলেটি ভাষা একটু বেশি শোনা যাচ্ছে। এখানে ওখানে উঁকি দিয়ে বুঝা যায় পর্যটনের মৌসুম হকার ফেরিওয়ালারা অনেক ব্যস্ত। জিনিস পত্রের দামও অনেক বেশি। তারপর ও লোকজন কিনছে দেদারসে। শপিংমল গুলোর আনাচে কানাচে ঘুরতে গিয়ে অনেক রাত হয়। ছেলেমেয়েরা শিলংয়ের কেএফসি দেখতে চায় একবার। সর্বসম্মতি ক্রমে রাতের খাবারটা কে এফ সি তে সেরে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আমার অতিউৎসাহী ছেলেমেয়েদের সবকিছুতে বাড়তি আগ্রহ। এখানকার কেএফসির খাবার নাকি অনেক স্বাদের। রোজ একবার লাবান থেকে পুলিশবাজার এসে কেএফসিতে খেয়ে যেতে হবে। আমার কাছে পার্থক্য তেমন একটা লাগেনি। খেয়েদেয়ে নেমে আসি রাস্তায়। পাহাড়ি শহরে শীতের তীব্রতাও বেড়েছে। শিলং পিকের উপরে পাহাড়ের গা ঘেষে ঝলসানো থালার মত চাঁদ আমাদের অনুসরণ করে। শিলংয়ের ঠান্ডা চাদের বুড়িকে কাবু করেছে অনেকটা । বেচারি চাঁদের বুড়ি কালো চাদর গায়ে জড়িয়ে চরকা কাটছে। চরকা বুড়ি চরকা কাটতে কাটতে আসছে আমাদের পিছু পিছু। বুড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে ভালোই হাটছি। দেখা যাক কতটুকু হাটতে পারি। পর্যটকদের আনাগোনায় ব্যস্ত শিলং শহরের রাতের সৌন্দর্য ও নিরাপত্তার ঘাটতি নেই। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে এক খাসিয়া দোকানি মহিলা কড়াই সদৃশ পাতিলে কয়লা জ্বালিয়ে উম নিচ্ছেন। অবিকল এই জিনিসটা আমাদের ঘরে ছিল। আব্বারা বলতেন আংটা। ডিসেম্বর জানুয়ারির প্রচন্ড শীত থেকে বাঁচতে আংটায় কয়লা জ্বালিয়ে ঘর গরম করা হত তখন। আধুনিক বৈদ্যুতিক হিটারের অবাধ বিস্তারেও আদিবাসী এই মহিলা শতবর্ষ আগের ঘরোয়া পদ্ধতিতে উম নিচ্ছেন। আফসোস হলো আমাদের অবহেলায় আব্বাদের ব্যবহার্য জিনিসগুলো জাদুঘরে না গিয়ে ঘি চমচম ওয়ালার টুকরিতে স্থান পেয়েছে কোন এক সময়।
রাস্তার পাশের ফুটপাতের বেশির ভাগ দোকানে কেরোসিনের কুপি বাতি জ্বলে। মিতব্যয়ী খাসিয়াদের বিদ্যুতের খরচ বাচানোর কৌশল এইটা। বাংলাদেশের শহরে দূরে থাক দূর গ্রামের বাজারেও কুপি বাতি জ্বলে কিনা সন্দেহ আছে।

ফুটপাতের একটা খাবারের দোকানের মহিলা কলাপাতায় গরম ভাতের সাথে নানা পদের ভর্তা দিয়ে বিক্রি করছে। কেরোসিনের আলোয় ধোয়া উঠা গরম ভাতের উপর ভর্তা দেখে আমারও খেতে ইচ্ছে করছে।কলা পাতায় ভাতের পরিবেশন চোখে পড়লো অনেক বছর পর। ছোট বেলা মসজিদে পড়ার সময় প্রায়ই কলাপাতায় শিরনি খাওয়া হত। গ্রামে নতুন ধান কাটা হয়েছে, কারো গাভী নতুন বাচ্চা দিয়েছে, কারো বাচ্চা নতুন হাটা শিখেছে, কারো বাচ্চার মুখে ভাত হলে মসজিদে শিরনি আসতো। আখনি বিরিয়ানীর দিন তখনো আমাদের অজপাড়াগায়ে পরিচিত হয়নি। তাই গুড় আর নতুন চাল দিয়ে ক্ষীর বানিয়ে মসজিদে পাঠানো হত। খুব বড় ধরনের মানত থাকলে মুরগীর মাংসের সাথে আলু বা পানি কদুর ঝোল ও আতপ চালের ভাত থাকতো। শিরনির সাথে এক বাণ্ডিল কলা পাতা দেয়া হত। মসজিদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বায়োজ্যাষ্ঠ কেউ সবার সামনে কলাপাতা পেতে দেন। পিতলের চামচ দিয়ে এক চামচ দেড় চামচ ক্ষীর দেয়া হয় কলা পাতায়। ভাত শিরনির ক্ষেত্রেও এক চামচ ভাত ও একচামচ তরকারি দেয়া হত। পেটের কোনা না ভরলেও অমৃত স্বাদের এই শিরনি খাওয়ার বিশেষ আকর্ষন ছিল। শেষবার কলা পাতায় শিরনি খেয়েছিলাম কলেজে পড়ার সময়। একদিন পরিক্ষা দিয়ে আমি ও জোছনা অবেলায় বলতে ভর দুপুরে বাড়ি আসছি। দরগাবাজার পেরিয়ে মোকামের সামনে আসতেই আখলাছ চাচার সামনে পড়ি। অতি পরিচিত আখলাছ চাচার পিরাকি বা পাগলামির সাথে পুরো বড়লেখার মানুষ পরিচিত। আখলাছ চাচাকে দেখলে আমাদের জানের পানি শুকিয়ে খরা হয়ে যেত। ছোট বেলা আমাদের খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো হত আখলাছ চাচার কথা বলে। সেই আখলাছ চাচা আমাদের সামনে কলা পাতায় শিরনী নিয়ে। নির্জন দুপুরে আশেপাশে কোন মানুষ নেই। কয়েকটা গরু রাখাল ছেলে আয়েশ করে আখলাছ চাচার দেয়া শিরনি খাচ্ছে। আমার আর জোছনার পা চলে না। ভয়ে জমে যাওয়া বাকি আছে। কড়া গলায় আখলাছ চাচা আমাদের ডাক দিয়ে কলাপাতায় দুই ভাগ শিরনি ধরিয়ে দিলেন। আমাদের মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। শিরনি সমেত কলাপাতার পুটলা হাতে নিয়ে চলে আসতে চাই। জোরে ধমক দিয়ে আমাদেরকে মাজারের বেঞ্চিতে বসিয়ে দেন আখলাছ চাচা। নিজেদের চেয়ে বয়সে ছোট রাখাল বালকদের দিকে অসহায় নয়নে তাকিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করি। চোখের ভাষায় ভয়ের উপস্থিতি দৃশ্যমান। ছেলেরা অভয় দিয়ে বলে, “খাওগো ডরাইও না। আখলাছ মামুয়ে কিচ্ছু দিলে খাওয়া লাগে। তাইন হকলেরে হকলতা দেইন না”। আমি আর জোছনা একজন আরেকজনের দিকে তাকাই। হাত না ধুয়ে কলাপাতার ভাত ও কদু মুরগির ঝোল দিয়ে দুই গ্রাস গিলে তাকিয়ে দেখি আখলাছ চাচা উল্টো পথে চলে যাচ্ছেন। হাফ ছেড়ে বাচি আমরা। ছেলে গুলো আরাম করে শিরনি খেয়ে মোকামের পুকুর থেকে হাতের আজলা ভরে পানি নিয়ে খাচ্ছে। পানি খাওয়া দূরে থাক আমরা হাত ধুতেও সাহস করিনা মোকামের পুকুরে। দানব সাইজের গজার মাছগুলো আমাদের আস্ত গিলে ফেলবে। সেদিনের মত আখলাছ চাচার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে বাড়ি আসি। মোকামে শিরনি খাওয়া নিয়ে সবাই আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করলেও ঘরে পালা মুরগির মাংস ও কদু তরকারির স্বাদটা মনে রাখার মত ছিল। অনেক বছর পর শিলংয়ে এসে কলাপাতায় ভাত দেখে সেই ঘ্রানটা আবার নাকে এসে লাগলো। পেটের চিপায় একটুখানি জায়গা না থাকায় কলাপাতায় নিয়ে খাবারটা চেকে দেখতে পারলাম না। তবে খাবার পরিবেশন দেখে মনে হয়েছে অনেক সুস্বাদু হবে।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন