আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

মেঘ পাহাড়ের দেশে (পর্ব ৬)

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-১০-২১ ০০:২৪:২২

ফারজানা ইসলাম লিনু :: ভোরে উঠে রেডি হতে না হতেই গনেশ দাদা ও আলী ভাই হাজির। এত ভোরে গেস্ট হাউসে রান্নাঘরের দরজা খুলবে না। তাই বাইরে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ি শিলং পিক দেখতে।

পুরো শিলং ও খাসিয়া পাহাড়কে এক দৃষ্টে দেখতে হলে মেঘালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতেই হবে। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ছয় হাজার ফুট উচু এই চূড়া শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে পনেরো ষোল কিলোমিটার দূরে। আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তায় চাইলেই গাড়ির গতি বাড়ানো যাবেনা। তাই একটু সময় নিয়ে উঠতে হলো। পিকের উপর ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি রাডার ষ্টেশন রয়েছে। কঠোর নিরাপত্তা মেনে পর্যটকদের চুড়ায় উঠার অনুমতি দেয়া হয়। খাসিয়া পাহাড়ের উপত্যকায় গড়ে ওঠা শিলং শহরের সবকিছু চুড়া থেকে অনেক ক্ষুদ্র দেখায়। ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসকেরা শিলংয়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একে একে আবিষ্কার করেন মনমুগ্ধকর দৃষ্টিনন্দন জায়গা। স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে বৃটিশরা প্রায়ই ছুটে আসতেন প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড খ্যাত পাহাড়ি শহর শিলংয়ে। উচু পাহাড়ের চূড়া থেকে শহর দেখা সমাপ্ত করে নেমে আসার পালা।পাহাড়ের ঢালে অনেক মানুষের ভীড়। এখানেও মহা আয়োজনে চলছে খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ছবি তোলা। সহযাত্রীদের কেউ রাজি না হওয়াতে আমার ছবি তোলা হল না।

সূর্য তখন প্রায় মধ্যগগনে। পেটের ক্ষিধে জানান দিচ্ছে খেতে হবে কিছু। পরবর্তী গন্তব্য মেগালয়া স্টেট মিউজিয়াম। সিদ্ধান্ত হল মিউজিয়ামে পৌছেই আশেপাশে খেয়ে নিব কিছু। মেগালয়া স্টেট মিউজিয়াম ও সেন্ট্রাল লাইব্রেরী একই জায়গায়। স্থানীয় কোন একটা স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসের হাজারখানেক বাচ্চাদের নিয়ে শিক্ষা সফর জাতীয় কোন একটা অনুষ্ঠান চলছে। এই উপলক্ষে অস্থায়ী খাবারের পসরা নিয়ে বসেছে কতগুলো দোকান। পরিষ্কার পরিছন্ন পরিবেশে চলছে সুস্বাদু খাবারের পরিবেশনা। পেটপুরে খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেই।

অনুষ্ঠানে আসা বাচ্চাদের সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগে। পাহাড়ি খাসিয়া বাচ্চাদের ইংরেজি উচ্চারণ অনেক উচু মানের। দলবেঁধে বাচ্চারা ঘুরছে আনন্দ করছে। কিছু বাচ্চারা একই রকম পোশাক পরে এসেছে। বেশির ভাগ বাচ্চাদের সাথে মা বাবাও এসেছেন।

শিলংয়ের মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথার ছাপ সর্বত্রই লক্ষণীয়। অফিস আদালত, শপিংমল, খাবার দোকান সব জায়গায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি কাজ করছে।

বাচ্চাদের অনুষ্ঠান দেখা অসমাপ্ত রেখেই চলে গেলাম সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। বিশাল লাইব্রেরিতে হাজার হাজার বই। বিশাল হলরুমে দর্শনার্থীদের বসার ভালো সুব্যবস্থা রয়েছে। পড়াশুনারও জন্য রয়েছে নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। সবকিছু অবলোকন করে একটি কথাই মনে হলো সেই বৃটিশ আমল থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতিতে পাহাড়ি এই শহর কেন এত উন্নত। বৃটিশ আমলে নির্মিত লাইব্রেরি ভবনের প্রতিটি পরতেই রয়েছে উন্নত ও আধুনিকতার ছোয়া। ভবনের সামনের বাগানে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ঢুকে যাই শিলংয়ের মেগালয়া স্টেট মিউজিয়ামে।

এইখানেও বিস্ময়ের শেষ নেই। মেহগনি কাঠের তৈরী সিড়ি ও দেয়াল সমেত মিউজিয়ামের প্রতিটা কক্ষ নান্দনিকতায় ভরপুর। বিখ্যাত শীতল পাটি দিয়ে সাজানো হয়েছে মিউজিয়ামের দেয়াল। খাসিয়াদের ব্যবহৃত তৈজসপত্র, পোশাক পরিচ্ছদ, অলংকার, বাদ্যযন্ত্র, সমরাস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রের সুন্দর প্রদর্শনীতে শোভা পাচ্ছে মিউজিয়ামের প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে। প্রদর্শিত জিনিস গুলোর সাথে জুড়ে দেয়া বিশদ বিবরণ পড়ে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। খাসিয়া পূরুষ মহিলাদের নিজস্ব পোশাক পরিহিত অনেকগুলো মূর্তিও রয়েছে এই জাদুঘরে। আলো আঁধারির অপূর্ব পরিবেশে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। জাদুঘরের প্রতিটা রুমে শোভা পাচ্ছে বৃটিশ রাজকর্মচারী, খাসিয়া রাজারাণী ছাড়াও ভারতীয় বিশেষ ব্যক্তিত্বের বিশাল ছবি। মনভরে উপভোগ করি ঐতিহ্যবাহী এই জাদুঘরের শোভাবর্ধক আয়োজন। আরো কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছা থাকলেও থাকা যাবে না। অনেক জায়গা দেখতে হবে।

জাদুঘর থেকে বের হয়ে দেখি গনেশ দাদা আর আলী ভাই আমাদের অপেক্ষায়। এবার যেতে হবে শিলং গলফ কোর্স বা গলফ খেলার মাঠে। যাবার আগে সেন্ট্রাল লাইব্রেরী ও স্টেট মিউজিয়ামের বাইরের এলাকাটাতে আরেকটু চোখ বুলিয়ে নেই।
শিলং শহরের উঁচুনিচু পথ বেয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে হাজির হই শিলংয়ের বিখ্যাত গলফ খেলার মাঠে।

বিশ্বের উচ্চতম ও দীর্ঘতম গলফ মাঠগুলোর মধ্যে অন্যতম এই মাঠ। নানা বয়সী মানুষের ভীড় এইখানেও। ভৌগলিক কারণে বৃষ্টিবহুল এই মাঠের চারপাশে রয়েছে ঘন সবুজের সমারোহ। বৃটিশ শাসিত আসাম রাজ্যের রাজধানী ও প্রশাসনিক এলাকা শিলংয়ে সৌখিন বৃটিশদের আনাগোনা ছিল বেশি। সেই সুত্রে ১৮৯৮ সালে গড়ে উঠা এই গলফ মাঠে ছিল ভারতের অন্যতম পুরনো গলফ খেলার মাঠ। ঘড়ির কাটা দৌড়াচ্ছে দ্রুত। কিন্তু প্রকৃতির কোল ঘেষে গড়ে উঠা এইসব স্থাপনা থেকে নড়তে মন চায়না সহজে। তারপরও রূদ্ধশ্বাসে বের হতে হয় প্রতিটা জায়গা থেকে।

দিগন্ত বিস্তৃত অসীম আকাশের নিচে দাড়িয়ে নিজেকে বড় সসীম লাগে। স্রষ্টার প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠে। জঙ্গলে ঘেরা এই উপত্যকাকে যত্ন করে সাজানোর কারণেই আজ এত মানুষের পদধুলি পড়ে। এই জনপদের পিছিয়ে পড়া মানুষের রুটিরুজির অন্যতম মাধ্যম পর্যটন খাত। গলফ মাঠের চারপাশ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য পন্যের মেলা। বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা মনের আনন্দে কিনে নিচ্ছেন নানা জিনিসপত্র। ছোট শিশুরা আপনমনে খেলছে। ছেলেবুড়ো সবাই সবুজ ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ বা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে ব্যস্ত। আরেকবার ফিরে আসার আকুতি নিয়ে ট্যাক্সিতে ফিরে আসি। গনেশ দাদা জানিয়ে দিলেন এবার নিয়ে যাবেন ডনবস্ক মিউজিয়াম ও উমিয়াম লেকে।

বিকেলের আবহাওয়ায় শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শরতের শেষ সময়ে আমাদের দেশের পৌষ-মাঘের শীত এখানে। একারণেই কিনা জানি না দিনের বেলাটা অনেক ছোট। বাইরে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। ডনবস্ক, উমিয়াম লেক ও বড় মসজিদ যাওয়ার কথা থাকলেও সবগুলো দেখতে পারবো কিনা জানি না।

উমিয়াম লেকে যেতেই সময় লাগলো বেশ কিছুটা। অনেক ক্লান্তি লাগছে হাটাহাটির কারণে। উমিয়াম লেক যা স্থানীয় ভাষায় বরাপানির লেক নামে পরিচিত। পুরোটা দেখতে অনেক সময় লাগবে। ঘোরাঘুরি সংক্ষিপ্ত করতে হবে এইবার। কিন্ত বাচ্চাদের পিড়াপীড়িতে লেকের পারে বসি কিছুক্ষণ। বাচ্চারা লেকের পারে চক্কর দিয়ে এসে বলে চলেন যাই।

বিখ্যাত ডনবস্ক মিউজিয়াম ও বড় মসজিদে একটু ঢু মারি। ভালো করে দেখার সময় বা ধৈর্য্য কোনটাই নেই। মন কে সান্তনা দেই সামনের কোন এক বর্ষায় লম্বা সময় নিয়ে আবার আসবো। শিলংয়ের বৃষ্টিবিলাস মন ভরে উপভোগ করবো। পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঘুরবো। কবি গুরুর থাকার সেই বিখ্যাত জায়গা যেখানে বসে আমাদের জন্য কিছু গল্প কবিতা রচনা করেছিলেন সেখানে যাব। কিছু সময় কাটিয়ে দিব কবির স্মৃতির সান্নিধ্যে। সার্ধশত বছর আগে জন্ম নেয়া এক কবি শতবর্ষ আগে আমাদের জন্য রচনা করেছিলেন অমর কত গল্প,কবিতা ও গান। সে সবের কোনটা তো এই শিলংয়ে বসে লিখেছিলেন। লিখার টেবিল চেয়ার আজও কবিগুরুর লিখার সাক্ষী বহন করছে।

মাটির নিচে তিন তলা উপরে চার তলা বিশিষ্ট স্পাইরাল সিড়ির ডনবস্কো মিউজিয়াম দেখে যাবার ইচ্ছাটা প্রবল। কিন্তু সময় স্বল্পতা এইখানেও বাঁধ সাধে। অনেক কিছু দেখার বাকি। একেক জায়গায় বাড়তি সময় ব্যয় করার কারণে নির্ধারিত কিছু জায়গা না দেখেই ফিরে যেতে হবে। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। আবার আসার টান থাকলো। গনেশ দাদা তবুও জোর করে ডনবস্কো মিউজিয়াম ও বড় মসজিদ বাইরে থেকে একটু একটু দেখিয়ে নিয়ে আসলেন।

গেস্ট হাউসে ফিরে এসে অনেক কাজ। সবকিছু গুছিয়ে রাখতে হবে। ভোর হওয়ার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে চেরাপুঞ্জির উদ্দেশ্যে।

ডনবস্কো থেকে ফেরার পথে একটা জায়গা দেখিয়ে গনেশ দাদা বললেন, এই জায়গায় নাকি বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা সালাউদ্দিন সাহেবকে হাত পা বাধা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ডাউকির বর্ডার থেকে অনেকটা দূরে শিলং শহরে পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া এই লোক এত দূর পর্যন্ত আসলো কেমনে? সালাউদ্দিন সাহেবের গল্প শুনতে শুনতে আমরা লাবানে আমাদের গেস্ট হাউসের সামনে চলে এসেছি। আমাদের গেস্ট হাউসের ঠিক উল্টো পাশের সানরাইজ গেস্ট হাউসে থাকেন সালাউদ্দিন সাহেব। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে শিলংয়ের আদালতে বিচার চলছে। শিলংয়ে বেশিরভাগ সময় সালাউদ্দিন সাহেবের ব্যক্তিগত ড্রাইভারের দায়িত্ব পালন করেন গনেশ দাদা। গাড়ি থেকে নেমে আমরা রুমে চলে আসি। পুত্রকন্যার বাবা সালাউদ্দিন সাহেবের সাথে দেখা করতে সাইরাইজ গেস্ট হাউসে যান। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসলে জিজ্ঞেস করি কি খবর? কেমন আছেন সালাউদ্দিন সাহেব?

পরিবার পরিজন ছাড়া যে রকম থাকার সে রকম আছেন।মাঝেমাঝে স্ত্রী সন্তানেরা এসে দেখে যান। ভালো না থাকলেও ভালো থাকতে হয়।

তবে শিলংয়ের বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর আবহাওয়াটা হল নির্বাসিত জীবনের বাড়তি পাওনা। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। মনে হয় এ মাসের শেষে রায় হয় যাবে।

অবৈধ অনুপ্রবেশ, ইমিগ্রেশন আইন লঙ্ঘন ও অন্যান্য কারণে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজা হতে পারে। দেশে ফিরে এসে সপ্তাহ খানেক পর খবরের কাগজে দেখি সালাউদ্দিন সাহেব একটি মামলায় শিলংয়ের আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন।

সালাউদ্দিন সাহেবের আলোচনা অসমাপ্ত রেখে আমরা সবকিছু গুছানো শেষ করি। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে গেস্ট হাউসের বিল মিটিয়ে ঘুমাতে যাই।

এমনিতেই আমাদের অনেক ভোরে বিছানা ছাড়ার অভ্যাস। যথারীতি শিলংয়ের শেষ রজনীর নাতিদীর্ঘ সুখনিদ্রা ভাঙতে দেরী হয়নি সবার।

ভোরের আলো ফোটার আগেই আলী ভাই ও গনেশ দাদা হাজির। বাক্সপেটরা গাড়িতে ভরে শেষ বারের মত লাবানকে আরেকবার দেখে নেই। দৃষ্টিনন্দন বাগান, পরিচ্ছন্ন ঘরবাড়ি গভীর মৌনতায় আমাদের বিদায় জানায়। সামনের বর্ষায় আবার আসবো। থাকবো এই লাবানেই। ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে লাবানের উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানির সাথে আমরাও হারিয়ে যাব। জম্পেশ বৃষ্টি স্নান হবে আমাদের। চিৎকার করে গাইবো। এসো করো স্নান নবধারা জলে

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন