আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মেঘ পাহাড়ের দেশে (পর্ব ৭)

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-১০-২২ ০০:২২:৫৭

ফারজানা ইসলাম লিনু :: চেরাপুঞ্জির উদ্দেশ্যে গাড়ি ছেড়ে দেয় আমাদের। গন্তব্যে পৌছাতে আড়াই ঘন্টার মত লাগবে। রাস্তায় কোথাও নেমে নাস্তাটা সেরে নেব।

মসৃন ট্রাফিকজ্যাম বিহীন রাস্তায় আমাদের সফল আনন্দভ্রমনের আরেকটা পর্ব শুরু হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল শহর চেরাপুঞ্জিতে যাচ্ছি।

সমুদ্রপৃষ্ট থেকে চেরাপুঞ্জির উচ্চতা চার হাজার ফুটের বেশি। বায়ুর চাপ ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবারও জানান দিচ্ছে আমরা অনেক উপরে উঠছি। রাস্তার দুপাশে গভীর গিরিখাদ।ছোটছোট নাম না জানা লতাগুল্মের সবুজ ছাউনিতে ঘেরা পাহাড়ে মেঘেদের আনাগোনা। ঘন মেঘের দল এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়, তাবু খাটায় না কোথাও। গাড়ি থেকে নেমে পড়ি সবাই। চেরাপুঞ্জি গামী প্রায় সব পর্যটকরা এখন রাস্তায়। অবাক বিস্ময়ে দেখছে দিগন্ত জোড়া মেঘের সৌন্দর্য। সকালের সূর্য তখনও পুব আকাশে। মিষ্টি রোদের মাখামাখিতে আদুরে মেঘের সৌন্দর্য কয়েকগুন বেশি। আলী ভাই যদিও বললেন বর্ষায় নাকি আরো বেশি সুন্দর থাকে চেরাপুঞ্জি।

পাহাড়ের চুড়া থেকে ঝর্ণাগুলো চঞ্চল পায়ে নুপুরের ছন্দে নেমে আসে। শরতের সৌন্দর্যে যদি এত মুগ্ধতা বর্ষায় না জানি কি অবস্থা। কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে সকালের নাস্তাটা সেরে আবার রওয়ানা দেই চেরাপুঞ্জি শহরের দিকে।

রাস্তায় দুপাশের সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় হারিয়ে যেতে যেতে চলে আসি চেরাপুঞ্জি শহরে। ছিমছাম সাধারণ একটা শহর। একটু থেমে এগিয়ে যাই সেভেন সিস্টার্স ফলসে। বর্ষা শেষ হয়ে যাওয়াতে ফলস গুলোতে পানির জোর কম। মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে হালকা ধারায়। সুর্যের আলো ফলসের গায়ে লেগে চকচক করছে। মেঘ সরতে শুরু করেছে, রোদের ঝাঁঝও বাড়ছে। তারপরও ঠান্ডা কম না। রাস্তার পাশের দোকানে গরম কফির অর্ডার দিয়ে বিস্কিট দিয়ে পাহাড়ি কলা দুটো খেয়ে নেই।

বেচারি খাসিয়া দোকানি অনেক গুলো ডিম সিদ্ধ বসিয়েছেন চুলায়। পাহাড়ি মহিলা বাংলা বলতে না পারলেও ইংরেজি বেশ ভালোই পারেন। মিষ্টভাষী মহিলা কথা বলেন অনেক সুন্দর করে। পর্যটকদের নিয়ে আসা যাওয়ার সুবাধে গনেশ দাদা ও আলী ভাইয়ের সাথে ভালোই জানাশোনা মহিলার। অতি দুর্গম জায়গা, রাস্তার পাশে ঘরবাড়ি তেমন নেই।

জিজ্ঞেস করলাম থাকেন কোথায়?
হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন দুরের মেঘে ঢাকা গ্রাম, কি জানি নাম মনে পড়ছেনা এখন। মাইলখানেক দুরের খাসিয়া গ্রাম থেকে প্রতিদিন পাহাড় ডিঙ্গিয়ে হেটে আসেন। ভোর হওয়ার আগেই দোকানের পসরা সাজিয়ে বসেন। মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া পরিবারে মেয়েরা ঘরে বাইরে কাজ করেন। আমার মনে হল বাইরের কাজ একটু বেশিই করেন। ছেলেরা বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে চলে আসেন। দেখে মনে হবে মহিলাদের রাজত্ব মনে হয় বেশি। কিন্তু দোকানি মহিলার কথাবার্তায় মনে হল সমঝোতা আর সমঅধিকার দুইটার ভালো সমন্বয় আছে পরিবার গুলোতে। দু'একটা ব্যতিক্রম যে হয় না তা না। সে ক্ষেত্রে মহিলাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিছুক্ষণের আলাপচারিতায় মহিলার সাথে ভালোই জমলো। ছবি তুলতে গেলে খুব সুন্দর করে পোজ দিলেন। আমার সাথে ছবি তোলে মন ভরলো না, দাদার সাথে ছবি তুলতে চাইলেন। দাদাকে পাশে বসিয়ে তুলে দিলাম একটা ছবি। এবার বিদায় নেবার পালা।

মহিলা সন্ধান দিলেন দোকানের পেছনে স্বচ্ছ পানির একটা ঝর্ণা ধারা শক্ত পাহাড়ের বুক চিরে নেমে গেছে সেই গভীরে। দেখতে গেলাম সেই পাহাড়ি ঝর্ণা। ছোট্ট নদীর মত দেখতে ঝর্ণার হিম শীতল পানিতে পা ভেজাতে না পেরে হাত ভেজালাম। বিশাল নিশ্চল পাথরের চিপায় চিপায় চিকন পানির ধারা অবিরাম ছুটে চলছে। বসা যাবে না বেশিক্ষণ।

ছুটতে হবে মাওসমাই গুহায়। এতক্ষণে পর্যটকদের ভীড় বেড়েছে মহিলার দোকানে। একফাঁকে বিদায় নিয়ে চলে আসি।

শহর থেকে একটু দূরে মাউসমাই গুহায় পৌছুতে বেশি সময় লাগেনা। গুহা সংলগ্ন রেস্টুরেন্টটা খুলেছে মাত্র, মহাসমারোহে চলছে রান্নাবান্নার আয়োজন। গুহার গেট খুলতে কিছুটা সময় লাগবে। এই ফঁকে গুহার আশপাশ ঘুরে দেখতে যাই। গুহাগামী লোকজন আসছে, চলছে গুহায় প্রবেশের প্রস্তুতি।

আশপাশের নিস্তব্ধতায় বুনো ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে কেমন ভয় ভয় লাগে। ভুতুড়ে গুহায় প্রবেশের আগ্রহ আমার তেমন ছিল না। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে আগ্রহ আরও হারিয়ে ফেলি। বাবার নেতৃত্বে ছানাপোনারা গুহাদর্শনের সিদ্ধান্তে অনঢ়। আমার ভয় দেখে উলটো হাসাহাসি করে সবাই মিলে চলে যায় গুহা পরিভ্রমণে। একটা বিশাল দলের সাথে মিলে অদৃশ্য হয়ে গেলে আমার গা ছমছম করে। গলা বাড়িয়ে ডাকতে চেষ্টা করি। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না।

মাকে নিয়ে আমি বাইরে অপেক্ষা করি, কিন্তু অপেক্ষার সময় শেষ হতে চায় না। আজ আসুক দেব ইচ্ছামত ঝাঁড়ি। মনে প্রতিজ্ঞা করি ত্যাদড় নির্ভীক বাচ্চাগুলোর বেড়ানো একেবারে বন্ধ।

বড়ছানাটা ছাড়া বাকি দুটোই একটু ভীতু। অন্ধকার গুহায় ভয় পেয়ে চিৎকার দিলে বাপ কোনটাকে রেখে কোনটাকে সামলাবে। আলী ভাই অভয় দিলেন, কিচ্ছু হবে না কত লোক রোজ যায়। কখনো খারাপ কিছু শোনা যায় নি।

যদিও জনশ্রুতি আছে অনেক আগে নাকি এই গুহায় ভুত পেত্নীরা মহা আনন্দে বাস করতো।

পর্যটকদের চাপে ভুতেরা মনে হয় পালিয়েছে। উল্লেখ করার মত দুর্ঘটনা ঘটেনি এযাবৎ। এবড়ো থেবড়ো চিপা সুড়ঙ্গ পথ পাড়ি দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আমার অভিযাত্রী দল হাজির। চোখে মুখে বিশ্বজয়ের আনন্দ দেখে মেজাজ আমার বিগড়ে যায়। সাফ জানিয়ে দেই আমি আর কখনো তোমাদের নিয়ে বেড়াতে যাবো না। এই তো কদিন আগে থাইল্যান্ডের গুহায় আটকে পড়ে কতগুলো কিশোর। কত কষ্ট করে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করা হয় বাচ্চাগুলোকে।

ছোট ছানাটা বলে উঠে, আমরা আটকা পড়লে অনেক মজা হত এডভেঞ্চার ও হত। মেজাজ চরম পর্যায়ে থাকায় কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসি।

এখন যেতে হবে নহকালিকাই ফলসে। প্রায় এক হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের মাথা থেকে অনেক নিচে কলকল ধ্বনিতে আছড়ে পড়ছে ঝর্ণার জল। বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে পাথুরে পাহাড় সবুজের চাদরে ঢাকা। জমাট বাঁধা সাদা মেঘে ঢেকে আছে পাহাড় গুলো। ঝর্ণার অবিরাম পতনে সৃষ্টি হয়েছে স্বচ্ছপানির প্রাকৃতিক জলাশয়ের। বর্ষায় জলাশয়টি দেখতে অপরূপ হয় এমনটাই জানালেন আলী ভাই। নহকালিকাই ফলসের কাছেই রয়েছে বাংলাদেশ ভিউ পয়েন্ট।

নহকালিকাই ফলস থেকে আসতে চোখে পড়ে বিশাল এক কবরস্থান। খৃস্টান ধর্মাবলম্বী খাসিয়া উপজাতির এই কবরস্থানের পাশেই রয়েছে একশো সাতান্ন বছরের পুরনো প্রেসবিটারিয়ান চার্চ। বৃটিশ আমলে বিশাল জায়গা জুড়ে তৈরী চার্চটির নির্মাণ শৈলী অনেক সুন্দর ও আধুনিক।

চার্চে কিছুক্ষণ কাটিয়ে চলে যাই রামকৃষ্ণ মিশনে। ১৯৫২ সালে জওহর লাল নেহেরু রামকৃষ্ণ মিশনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। খাসিয়া জনগোষ্ঠীর জীবন মান পরিবর্তনে খৃস্টান মিশনারীদের পরে রামকৃষ্ণ মিশনেরও অবদান রয়েছে। দুর্গাপুজার সময় তাই রামকৃষ্ণ মিশনে বাঙ্গালী কায়দায় পুজা চলছে। রামকৃষ্ণ মিশনের নৃতাত্বিক সংগ্রহশালাটি অসাধারণ। উত্তর পুর্ব ভারতের উপজাতীয়দের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পেতে এই সংগ্রহশালাটির তুলনা হয়না। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বের হয়ে আবারও চেরাপুঞ্জির রাস্তায়। পথের দুপাশের মনোমুগ্ধকর শোভায় আচ্ছন্ন হয়ে মনে হল ঘড়ির কাটা দ্রুত দৌড়াচ্ছে। পেটের ক্ষিধে জানান দিচ্ছে দুপুরের খাবারের সময় চলে যাচ্ছে। ঢুকে পড়ি একটা রেস্টুরেন্টে।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন