আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

কুমারী পূজা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-১০-২২ ১৫:১০:১৩

ফাইল ছবি

পুলক রঞ্জন চৌধুরী :: ‌‘মাগো আনন্দময়ী নিরানন্দ করো না’- সাধক রামপ্রসাদের এই গানটি শ্রুতিমধুর। এতে মায়ের নিকট সন্তানের কাতর প্রার্থনার নিবেদন আছে। যাতে মা প্রসন্ন হয়ে নিরানন্দ দূর করেন শান্তির বারিতে সিক্ত করেন সন্তানদের ।

এমনই প্রার্থনার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের হিন্দুধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর পাঁচদিন ব্যাপী দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। যার অন্যতম পর্ব কুমারী মায়ের পূজা। সনাতন ধর্ম সুপ্রাচীন হলেও বাঙলায় কুমারীপূজার চল সম্প্রতি বলা যায়। যেজন্য তা নিয়ে এখনও খানিক কৌতুহল রয়েছে।

‘পূজা-বিজ্ঞান’ গ্রন্থে জানি, কামরূপের কামাখ্যাধামে দেবীর মন্দিরে কুমারীপূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। নেপালের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের একটি অপরিহার্য অঙ্গ কুমারীপূজা। ভূটান, সিকিমেও তা বিদ্যমান। (পৃষ্ঠা-৫৬)

“সব ধর্ম এক, যত মত তত পথ” দর্শনের প্রবক্তা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব-এর প্রধান ভাবশিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রামকৃষ্ণ মঠে কুমারী পূজা শুরু করেন। বাংলাদেশের একাধিক রামকৃষ্ণ মঠেও তা অনুষ্ঠিত হয়। যেথায় কুমারীর মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গাই পূজিত হন। উল্লেখ্য সমাজজীবনে নারীর প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দেওয়াও এই পূজার অন্যতম দিক।

একটু পেছনে তাকালে দেখি, প্রাচীন মুনি-ঋষিগণ প্রকৃতির গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বিবেচনা করে চন্দ্র-সূর্য, নদী-পাহাড় ইত্যাদির সন্তোষ্টিকল্পে আরাধনা করতেন। তাঁদের মতে প্রকৃতি মানে নারী, যার মাধ্যমে সৃষ্টির জন্ম। তাই, নারী পূজিত হলে প্রকৃতি তথা স্রষ্টাও পূজিত হন।

প্রাচীন মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “যেখানে নারীরা পূজিত, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন।” মহাভারতের একাধিক পর্বে নারীর প্রতি অসম্মান এবং লালসার পরিণামের বিশদ বর্ণনা আছে। যুবরাজ দুর্যোধন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করে যে চরম অনৈতিক ও পাপকর্ম করেছিল এর ফলে কুরুক্ষেত্রের মহারণে শতভ্রাতাসহ দুর্যোধন নির্বংশ হয়। ইতোপূর্বে মহাপরাক্রমশালী বীর কীচক যখন সৈরন্ধীকে (অজ্ঞাতবাস থাকা অবস্থায় দ্রৌপদীর ছদ্মনাম) পত্নীরূপে পাওয়ার অনৈতিক বাসনা নিজ বোনকে (বিরাট রাজ্যের রানী) জানায়, উত্তরে সোহদরা ভ্রাতাকে বলেন “মধুর বচনে কন বিরাট রানী, কেন হেন কহ ভাই অনুচিত বাণী।” (মহাভারত বিরাটপর্ব, পৃষ্ঠা-৩৫)

কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী ফলে, প্রাণ হারায় কীচক। রামায়ণ-এ পাই পঞ্চবটি বনে বনবাসরত রামের পত্নী সীতাকে হরণের পরিণামে লঙ্কাধিপতি রাবণ কেবল বধ হন নিছাই হয় সোনার লঙ্কাও। অক্ষুন্ন থাকে সীতার সম্মান। বলা আবশ্যক, কুমারী বালিকাই দেবী চন্ডিকা। “ইনিই প্রবুদ্ধা হয়ে সবংশে রাবণ নিধন করে সীতা দেবীকে উদ্ধার করেন।”
অন্যত্র দেখি, সাবিত্রী ও বেহুলার আরাধনায় তুষ্ট হয়ে ভগবান তাঁদের স্বামী যথাক্রমে সত্যবান ও লক্ষীন্দরকে পুনর্জীবন দান করেন। অর্থাৎ নারীর সৃষ্টি-সাধনা-সম্মান স্বীকৃত হয়েছে যুগে যুগে। যদিও সেসবের নিদর্শন বঙ্গ কিংবা ভারতে বিশেষ নেই। নেই জীবনচরিত চর্চা। হ্যাঁ, নিদর্শনের খোঁঁজ মিলে ভারতের সর্বদক্ষিণে কন্যাকুমারী অন্তরীপ, কন্যাকুমারী মন্দির।

বঙ্গদেশে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণ স্ত্রী শ্রীসারদাদেবীকে উত্তরমুখী করে বসিয়ে দেবী জ্ঞানে ষোড়শোপচারে পূজা করেন। বললেন “হে সর্বমঙ্গলের মঙ্গল স্বরূপে, হে সকল কর্ম সম্পন্নকারিণি, আশ্রয়দায়িনি ত্রিনয়নি শিবগোহিনি, হে নারায়ণি তোমাকে প্রণাম করি।”(শ্রীরামকৃষ্ণ, পৃষ্ঠা-৫৫) তিনি মনে করেন, “শুদ্ধাত্মাকুমারী ভগবতীর প্রকাশ।” পরবর্তীতে তাঁরই শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ চালু করেন কুমারী মায়ের পূজা। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোল বছর পর্যন্ত বালিকাকে দেবী (কুমারী) জ্ঞানে পূজা করা হয়। সাধারণত অষ্টমী পূজার দিন ব্রাহ্মণকন্যা, সুদর্শনা, কুমারীকে নির্দিষ্ট দিন সকালে স্নান করিয়ে আলতা-সিঁদুর পড়ানো হয়, নতুন কাপড় পরিয়ে অলঙ্কারে সাজিয়ে মন্ডপের আসনে বসিয়ে ফুল-জল-বেলপাতা দিয়ে পূজা করা হয়। তখন ধ্যান ও প্রণাম মন্ত্রে সাধারণ কুমারী হয়ে উঠেন সাক্ষাৎ দেবী, ভক্তগণ তাঁর মধ্যে জগন্মাতা শ্রীশ্রীদুর্গাকে অনুভব করে কৃতার্থ বোধ করেন।”(পূজা-বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা-৫৮)

ভক্তের একাগ্র প্রার্থনায় ভগবতী তাঁদের সুস্থ-সুন্দর-সফল জীবন দান করেন। এভাবে ব্যক্তি ও পরিবারে শান্তি-স্থিতি বিরাজ করলে সমাজ শান্তিময় হয়ে উঠে। যেথায় নারী তথা মায়েদের মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন হওয়ার কোন শঙ্কা থাকে না। বরং নজরুলের ভাবনার মতো তাঁরা বাস্তবে হবেন

জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য-লক্ষ্মী নারী, সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি।(কবিতা-নারী)

এতে নারী-পুরুষের মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত বিদ্বেষ বিদূরিত হয়। মানবতার জয়গানে এগিয়ে যাবে মনুষ্য সমাজ। জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জগৎবাসীর মঙ্গল হয়।
বিগত আট-দশমাস যাবৎ করোনা ভাইরাসের (ঈড়ারফ-১৯) বিষাক্ত ছোবলে বিশ্ব মহাসংকটে। জীবন-জীবিকা নিয়ে এরূপ সংকট বিশ্ববাসী কখনো দেখে নি। এজন্য এবারের দুর্গাপূজা দুর্গোৎসব বিহীন পূজা। দেবীর পদতলে অহর্নিশি প্রার্থনা করি, চলমান মহামারি-মহাব্যাধিসহ সব নিরানন্দ নির্মূল করে আনন্দধারা বহে দাও ভুবনজুড়ে; আমাদেরও ‘চৈতন্য হোক’।

লেখক: শিক্ষক।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন