আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মেঘ পাহাড়ের দেশে (শেষ পর্ব)

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-১০-২৫ ০০:০২:০৮

ফারজানা ইসলাম লিনু :: পুরো শিলং চেরাপুঞ্জি ভ্রমণে আমরা এ পর্যন্ত কোন সমস্যার মুখোমুখি হইনি। এইবার পড়লাম মোটামুটি বড় সমস্যায়। বিশাল গাড়ি বহরের লাইন। কোন এক অসাবধানি ড্রাইভারের এলোমেলো করে গাড়ি রাখার কারণে এই জট লেগেছে। বেচারা ড্রাইভার গাড়ি রেখে উদাও।

তির্যক সুর্যরশ্মি গাড়ির কাচ ভেদ করে একেবার গায়ের উপরে পড়ছে। ভিটামিন ডি এর অভাবজনিত কোন সমস্যা থাকলে একদিনেই সমাধান। আমাদের উশখুশ দেখে গনেশ দাদা অভয় দিলেন, চিন্তা করবেন না কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের ছেলেরা এসে রাস্তা পরিষ্কার করে দিবে। কিছুক্ষণ তো আর আসেনা। হাজার হাজার পর্যটকের কয়েকশো গাড়ির জট কেমনে পরিষ্কার হবে বুঝতেছি না।

মাউলিনং দেখতে আসা আমার মত বিরক্ত এক বাবা পুত্রকে নিয়ে নেমে পড়েছেন রাস্তা পরিষ্কারের কাজে। গরমে ঘেমে পিতা পুত্র তেমন কিছু করতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। যারা মাউলিনংয়ে এসে ঢুকছেন তাদের সমস্যা হচ্ছে না। গাড়ি ছেড়ে হাটা শুরু করেছেন। কিন্তু যারা আমাদের মত বহির্মুখি তাদের হয়েছে সমস্যা। গাড়ির মধ্যে সিদ্ধ হয়ে বেড়ানোর শখ ভোতা হচ্ছে।

আলী ভাই একটু পর পর খবর নিয়ে আসেন এই চলছে এই চলবে বলে। গাড়ির চাকা নড়ার কোন নাম নেই। একঘন্টার বেশি সময় পেরিয়েছে। পর্যটকদের ঢল নেমেছে আজ। স্রোতের মত পর্যটক আসছেতো আসছেই।

হৈ হৈ করে গ্রাম থেকে এক দল ছেলে এসেছে। খুঁজে বের করেছে সেই কারবারি ড্রাইভারকে যিনি গাড়িখানা রাস্তার উপর রেখে লিভিংরুট ব্রীজ দর্শনে গিয়েছিলেন।

সেই পিতাপুত্র তখনো রাস্তা পরিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামের ছেলেদের চেষ্টায় আর পিতাপুত্রের নির্দেশনায় দুইমাইলের বেশি লম্বা জ্যাম ছুটাতে আরো ঘন্টা খানেক লাগলো। গাড়ির চাকা ঘুরলে আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচি।

আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে আমরা এখন তামাবিলের পথে। ভাবলাম গাড়িতে একটু ঘুমিয়ে নেই। কিন্তু মেঘেদের হাতছানি কি আর ঘুমাতে দেয়। পরিতৃপ্ত ভ্রমণের শেষ সমাপ্তিতে না ঘুমিয়ে আশপাশের দৃশ্য দেখেই কাটিয়ে দিলাম।

সূয্যিমামা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছেন। বিদায়ী হাসির ঝলকটা মেঘেঢাকা পাহাড়ের চূড়ায় আভা ছড়াচ্ছে। ডাউকির ব্রীজে উঠেছি। ছবি তোলা নিষেধ। কিন্তু পাহাড়ি পিয়াইন নদের স্বচ্ছ পানি দেখে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা না করে উপায় নেই। গাড়ির ভেতর থেকে আস্তে করে ক্লিক করলাম। আমাদের মত নীড়ে ফেরা পর্যটকদের সাথে যুক্ত হয়েছেন আরো শত শত পর্যটক।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত বা বিশ্বের অন্যান্য জায়গা থেকে শিলং, চেরাপুঞ্জি দেখে সীমান্তে এসেছেন জাফলং দেখতে। সীমান্ত পাড়ি দেয়ায় বাধ্যবাধকতা থাকায় সবাই দূর থেকে জাফলংয়ের অপার সৌন্দর্য দেখছেন।

জিরো পয়েন্টের শুন্যরেখায় দাড়িয়ে বাংলাদেশের ছবি তুলা হচ্ছে অনেক। আমাদের মোবাইলে বাংলাদেশের মোবাইলের নেটওয়ার্ক চলে এসেছে।

ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আলী ভাই ও গনেশ দাদার কাছ থেকে বিদায় নেই। গত তিন দিন অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্টার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন দুজন। বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে ও ধন্যবাদ দিয়ে হাটা শুরু করি বাংলাদেশ অভিমুখে।

তামাবিল চেকপোস্টে আবারও লম্বা আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমাদের জন্য অপেক্ষমান গাড়িতে উঠে বসার পালা।

এইবার শরীরের যন্ত্রাংশ গুলো টের পাবে কোথায় এসেছে। তামাবিল জাফলংয়ের ভাঙ্গা রাস্তায় গড়া গড়িতে শিলংয়ের আনন্দ ভ্রমণের স্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার পথে।

বেচারা ড্রাইভার অতি সন্তর্পনে চালাতে গিয়ে গাড়িকে ঝাকুনি থেকে রক্ষা করতে পারেন না। হাজার হাজার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে যে মেঘ, পাহাড় আর ঝর্ণার দেশে আমরা যাই সে সবের কিছু তো আমাদেরও আছে। পাংথুমাই ঝর্ণা, বিছানাকান্দি, জাফলং দেখতে তো আসতে পারতো অনেক লোক। শিলং একবার গেলে বার বার যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিছনাকান্দি, জাফলং ও রাতারগুল একবার গেলে আর জীবনে যেতে ইচ্ছে করবে না। যোগাযোগের অবকাঠামোগত সমস্যায় কেউ যেতে চাইলেও নিরুৎসাহিত করা হয়। পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এই জায়গাগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থার দিকে একটু খেয়াল নিলেই হত। তাছাড়া ভুমিখেকোদের দৌরাত্মেও হারিয়ে যায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। অনেক মানুষের ভীড় ও গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখে পর্যটন নিয়ে ভাবনায় ছেদ পড়ে। আবার না কত সময় রাস্তায় কাটাতে হয়।

ড্রাইভার নেমে গিয়ে কিছুক্ষণ পর খবর নিয়ে আসলেন যাত্রী ভর্তি লেগুনা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে চিৎপটাং। গ্রামের মানুষজন নিজের চেষ্টায় উদ্ধার কাজে ব্যস্ত। কিছু কৌতুহলী মানুষ আজাইরা দাড়িয়ে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছেন আর হা হুতাশ করছেন। খাদে পানি কম থাকাতে মনে হয় কিছুটা রক্ষা। উদ্ধারকারী লোকজনের দক্ষতা দেখে মনে হচ্ছে এই রাস্তায় প্রায়ই তাদের এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়। আহত লোকজনদের উদ্ধার তৎপরতা চলছে দ্রুত। থেমে থাকা গাড়ির জট খুলতে শুরু করেছে।

পেটের ক্ষিধার সাথে মাথার ব্যাথাটা পুরোপুরি ঝেঁকে বসেছে। বাসায় গিয়ে গোসল সেরে খেয়েদেয়ে দিতে হবে লম্বা এক ঘুম। ড্রাইভার সাহেব অতি দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সিলেটে আসলেন। তামাবিল রোডের নিত্যদিনের দুর্ঘটনার নানা কাহিনী শুনালেন। কি ভয়াবহ সব ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। ট্রাক সিএনজি অটোরিকশাকে চাপা দিয়ে ভেতরের যাত্রীদের ভর্তা বানিয়ে ফেলে। অতিরিক্ত পাথর বোঝাই ট্রাক মুখথুবড়ে পড়ে যায় রাস্তার পাশে। মানুষের জীবনের একবিন্দু নিরাপত্তা নেই সড়কে।

আমার মনে পড়ে যায় বছর দশেক তুতুলকে খুব শখ করে জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে ভর্তি করেছিলাম ক্লাস টু তে। ছোট বাচ্চাদের জন্য স্কুল বাসের বরাদ্দ সে সময় না থাকায় নিজেদের দায়িত্বে স্কুলে পাঠাতে হত। প্রতিদিন একটা না একটা দুর্ঘটনা দেখে আমি ঐ স্কুলের প্রতি আগ্রহ ফেলি। স্কুল বদলানোর পর আমার জানে পানি আসে।

এখন তো জেসিপিএসসি স্কুলের অনেকগুলো বড় বাস রয়েছে। একেবারে ছোট ক্লাসের বাচ্চারাও অনেক নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে।

রাত নয়টার মত হবে, আমরা প্রায় চলে এসেছি বাড়ির কাছে। কিন্তু মেজর টিলায় এসে আবার দীর্ঘ বিরতি। আজ পুজার দশমী। তাই রাস্তাঘাটে ভীড় অনেক বেশি। এই ভীড় ছাড়তেও সময় লাগবে।

ড্রাইভার ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে কোন বাগানের ভেতর দিয়ে অন্ধকার গ্রামে ঢুকে পড়েন। জোনাকিরা অন্ধকারে পথ দেখালে বেশ ভালো লাগে। কিন্তু পথ তো শেষ হয় না। ভয় লাগে ড্রাইভার ভাইয়ের কোন কুমতলব আছে কিনা। যদিও চেনাজানা ড্রাইভার। যা দিনকাল পড়েছে কোন কিছুতে ভরসা করা যায় না। কোন গহীন গায়ে চলে এসেছি। ঘরবাড়ীও তেমন চোখে পড়েনা।

কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার ভাই নিজেই নিরবতা ভাঙলেন, উজ্জ্বল ভাই আমি মনে হয় পথ হারাইলাইছি। বুঝিয়ার না কোন বায় দিয়া যাইয়ার। বলে এক জায়গায় থামলেন।

সামনের দোকানের দোকানিকে জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দিলেন শহরে আসার পথ। যা আমরা অনেক আগে ফেলে এসেছি। আজকের রাতটা রাস্তায় কেটে যাবে করে করে আমরা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে বালুচর হয়ে শহরে প্রবেশ করি। তীরে এসে তরী ডোবা অবস্থা থেকে মুক্তি মেলে আমাদের। বেচারা ড্রাইভার ভাইয়ের বুদ্ধিমত্তায় শেষমেশ পৌছা গেল বাসায়। একটু ঘোরাপথ হলেও অনেক নিরাপদে বাড়ি আসতে পেরে আমরা কৃতজ্ঞ ও স্বস্তি বোধ করি । পরের দিন শাজানের কাছে শুনেছি অনেক রাত অবধি যানবাহনের এই জট অটুট ছিল। শেষ মুহুর্তের অল্প কিছু ঝক্কিছাড়া অত্যন্ত সফলভাবে সমাপ্ত হল আমাদের শিলং ভ্রমণ।

পরতে পরতে সুখস্মৃতি নিয়ে ঘুমাতে যাব, ভাবলাম টেলিভিশনে একটু চোখ বুলিয়ে নেই। দেশ দশের সংস্পর্শ থেকে এই কদিন দূরে ছিলাম। টিভির পর্দায় চোখ পড়তেই চোখ ছানাবড়া। সবগুলো চ্যানেলে স্ক্রলিংয়ে একটা খবর ঘুরেফিরে আসছে, রুপালী গিটারের নায়ক আইয়ুব বাচ্চু রুপালী গিটার ফেলে আজ সকালে হঠাৎ করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। প্রবাসী ছেলে মেয়ের অপেক্ষায় লাশটা হিম ঘরে রাখা। চোখের কোনা গড়িয়ে দু ফোঁটা অশ্রু না গড়ালেও চাপা কান্নায় বুকটা ভারী হয়ে গেল।

পরানের গহীন কোনে অনুরণিত হয় একে একে কত গান...
"ঘুমন্ত শহরে রুপালী রাতে, কষ্টের নীল চাঁদর বিছিয়ে,"
"দিশেহারা এই হৃদয় আমার,"
"আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি"

আমাদের সোনালী দিনের রুপালী গায়কের আকস্মিক এই বিদায়ে ভ্রমণের সুখানুভূতি ও সুখস্মৃতি পানশে হয়ে যায়। বুকের চাপা কষ্টে চোখের পাতায় ঘুমটা ভর করতে পারেনা। এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি আমাকে নিয়ে যায় ঘুমের দেশে।

(সমাপ্ত)

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন