আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

একটি টিউবওয়েলের আত্মকাহিনী

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-১২-০৩ ১৬:৪৩:৩৬

শহীদনূর  আহমেদ :: তখন তার ভরা যৌবন। তার আশেপাশে পাড়ার লোকেরা জড়ো হতো সব সময়। সে যেনো এক দিবানিশি সেবক। বেলা অবেলায় চলতো তার কর্মযজ্ঞ। পাড়ার একমাথা থেকে অন্যমাথায় তাহার গুণকীর্তনে পঞ্চমুখ ছিলেন মা চাচি, কিশোর কিশোরী আর বয়োজ্যেষ্ঠরা। অনেকেই বলতেন তাঁর কাছে নাকি মধুর নহর ছিলো। তার সুধা পানে তৃপ্ত হতো কত তৃষ্ণাতুর প্রান। কত প্রতিক যে তার প্রেমে পড়ে এর ইয়ত্তা নেই। তাকে ঘিরে তৈরী হয়েছিলো অকৃত্রিম মেলবন্ধন আর ভালোবাসার সম্পর্ক। অদেখা মানুষটির খোঁজ মিলতো তার কাছে গেলেই। গোধুলীর আকাশে যখন অন্ধকার নেমে আসতো ঠিক সেই সময়টাতে তার দর্শনে কপোত-কপোতীদের লম্বা লাইনে জল সংগ্রের দৃশ্যায়ন জানান দিতো পাতালপুরীর অলৌকিক ক্ষমতার কথা।  

বলছিলাম, আমাদের বাড়ির পাশের উঠানের টিউবওয়েলটির কথা। তখন আমি অনেক ছোট। প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। গ্রামের মধ্যে আমাদের পাড়াটি অনেক বড় ছিলো। মোটাদাগে হাজার খানেক মানুষের বাস। পাড়ায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে দুয়েকটা টিউবওয়েল ছিলো। তাও সেগুলো ছিলো সরকারি। ২০ থেকে ২২ বছর আগের কথা বলছি। তখন টিউবওয়েল স্থাপন করা ছিলো ব্যয়বহুল। আমাদের বাড়ির পাশের উঠানে একটি সরকারি টিউবওয়েল ছিল। শুনেছি এটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বসানো হয়েছিল। আমার মরহুম দাদা শেখ শেখই উল্লাহ ও পাড়ার দুয়েকজনের চেষ্টায়  সরকারি অনুদানে সেই সময়ে টিউবওয়েলটি বসানো হয়। বড় চাচা মাঝে মধ্যে বলতেন, টিউবওয়েলের পানি যাতে সুস্বাদু হয় সেজন্য মরহুম দাদাজান শ্রমিকদের কাজের উৎসাহের জন্য আমাদের একটি ডাব গাছের সকল ডাবের পানি খাওয়ান। তিনি বলতেন টিউবওয়েলের পানি যেনো ডাবের পানির মতো হয়।  সেই জন্যেই  টিউবওয়েলটির পানি ডাবের মতোই এতো সুস্বাদু ।

ছোটবেলায় এই টিউবওয়েলটি ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি এখনও মনে পড়ে। সকালে ঘুম ভাঙ্গতে টিউবওয়েলের টিং টাং টুং শব্দ শুনে। পাড়ার মা চাচি বউ জিরা সকালের পানি নিতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতেন। কে কার আগে পানি নিবেন। এ নিয়ে মাঝে মধ্যে বাকবিতন্ডায় দেখা দিতো। ঘুম থেকে উঠে ছাঁই হাতে নিয়ে টিউবওয়েলে পাশে গিয়ে অপেক্ষা করতাম। সুযোগ পেলেই টিউবওয়েলের হাতলে ধরে ঝুলে থাকতাম। ছোট থাকায় টিউবওয়েলের হাতল লাগাল পেতাম না। লাফ দিয়ে হাতলে ঝুঁলে ঝুঁলে পানি উঠানোর চেষ্টা করতাম। নিচে জগ কিংবা ছোট পাত্র রাখতাম। পানি উঠানো ছিল সবচেয়ে বড় কষ্টের কাজ।

বিরতিহীনভাবে টিউবওয়েলে পানি উটানো হতো। বলা চলে পাড়ার অর্ধেক পরিবার এখান থেকে পানি নিতেন। সব চেয়ে বেশি ভীর জমতো সন্ধ্যা বেলায়। রাতের খাবার পানি সংগ্রহ, গোসল, বাচ্চাদের হাতমুখ ধোয়াসহ নানা কাজে পানি সংগ্রহ করতে প্রায় সময়ই লম্বা লাইন দেখা যেতো। টিউবওয়েলের পারে অনেক অদেখা মানুষের দেখা মিলতো। অনেকদিন পর নাউরি আশা বিবাহিত আপা, ফুফু, মামার বাড়িতে বেড়াতে আশা সমবয়সী খেশকুটুম কিংবা শহরে বসবাসরত প্রতিবেশীদের খোঁজ মিলতো। অতীতের নানা স্মৃতিচারণ করতে দেখা যেতো টিউবওয়েল পাড়ে। বলা চলে টিউবওয়েলটাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশীদের মধ্যে একটা নিবিড় যোগাযোগ ছিলো। টানা সার্ভিসে প্রায় সময় হাঁপিয়ে উঠতো টিউব ওয়েল বেচারা।  লেদার, নাট, বল্টুসহ নানা যন্ত্রপাতির বিপত্তির  কারণে টিউবওয়েলে  অসুখ দেখা দিতো। টিউবওয়েলের অসুখ দেখা দিলে সম্যায় পড়তে হতো। "ঠ্যালাঠ্যালি ঘর খদা রক্ষা কর" সরকারি টিউবওয়েল হওয়ায় একা কেউ দায়িত্ব নিতে চাইতো না। দুটাকা পাঁচটাকা চাঁদা তুলে যন্ত্রপাতি ক্রয় করে টিউবওয়েল সচল করতে হতো। যারা চাঁদা দিতো না প্রতিবেশীদের তীরস্কারের ভাগিদার হতে হতো সব সময়। তবে টিউবওয়েল নষ্ট হলে পানি সংগ্রহে কষ্টের শেষ থাকতো না মানুষের। দূর দুরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করতে হতো। তখনকার সময়ে পানির বিরম্ভনা ছিলো বড় বিরম্ভনা। ২০০৪ সালের বন্যায় যখন টিউবওয়েলটি ডুবে গেল তখন বিশুদ্ধ পানির অভাব কেমন ছিল আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে।

বর্তমানে প্রতি পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে টিউবওয়েল রয়েছে। অনেকেই  ব্যক্তিগত টিউবওয়েল স্থাপন করে মোটরের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে পরিবারের যাবতীয় কাজ সমাধান করছেন। সরকার এখন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও সেনিট্যাশন নিশ্চিতে কাজ করছে। তাই ডায়রিয়া, কলেরাসহ পানিবাহিত রোগের প্রকোপ কমে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান মহোদয়ের বিশেষ উদ্যোগে জগন্নাথপুর দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ৫ হাজার টিউবওয়েল স্থাপনের  কাজ চলমান রয়েছে। আমার জন্মস্থান বীরগাঁও গ্রামেও সরকারিভাবে অনেক টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। হাওরের দুর্গম বাড়িতেও বিশুদ্ধ পানি ব্যবস্থা করা হয়েছে। যা ১৫ বছর আগেও ছিলো অকল্পনীয়।

এবার আসি শিরোনামের দিকে। কিছুদিন আগে গ্রামে গিয়েছিলাম। চোখ পড়েছিলো সেই টিউবওয়েলের  দিকে। পলক পড়তেই মুহুর্তে  মনটা শীতল হয়ে গেল। একসময় ব্যস্ততম টিউবওয়েলটি আজ দুর্দশাগ্রস্ত, পরিত্যক্ত। প্রানহীন মৃতকায় দেহ। ধ্বংসের প্রহর গুনছে সে। পাটাতনের অংশবিশেষ টা অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে। কে বা কারা তার বডি চুরি করে নিয়ে গেছে। স্বার্থপর পৃথিবীতে তার প্রান দিতে কেউ এগিয়ে আসেনি। গত ৯ বছর ধরে  এমন অবস্থায়ই পড়ে আছে সে। এখন আর তার কাছে পাড়া মা চাচি বউ জিরা কেউ আসে না। একসময়ের ২৪ ঘন্টা কামলার খোঁজ এখন কেউ নেয় না। পাড়ার সকল বাড়িতে টিউবয়েল বসেছে। কবছর আগেও যে চাচি তাঁর হাতলের দখল নিতে মরিয়া থাকতো তিনি এখন ঘরের বাথরুমে ঝরণা গোসল করেন। এক টিপেই সকল কাজ সাড়েন। পাড়ার কেউ তার খোঁজ না নিলেও এ পাড়া কিছু বাচ্চারা নিয়মিতই আসে তাঁর কাছে। তার সাথে খেলে। খেলার ছলে টিউবওয়েলটির ভেতরে পাথর, বালি, মাটি ডুকিয়ে আনন্দ পায় বাচ্চারা।

পাথর, বালি, মাটি টিউবওয়েলটি গলা অবদি এসেছে। বৃদ্ধ বয়সে জীবন সায়াহ্ন দাঁড়িয়ে নিঃশেষ হওয়ার প্রহর গুনছে সে। গ্রাম বাংলার প্রায় বাড়িতে এমন হাজারো মৃতকায় টিউবওয়েলের গল্প রয়েছে। অবহেলা আর দায়িত্বহীনতায় এভাবেই প্রাণ হারিয়ে ইতিহাস বিলীন হয়েগেছে।


লেখক- সাংবাদিক ও নাট্যকর্মী

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন