আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২১-০২-২১ ১৩:২২:০২

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়
:: খালেদ মাসুদ ::

বাঙালি মুসলমানদের জোরালো সমর্থনের কারণেই মুসলিম লিগ ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে৷ জয়লাভ করে। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পথ সেইখান হতেই সুগম হয়। অতঃপর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর শাসকশ্রেণী এ সত্যটি স্বীকার করতেই ভুলে যায়।

তখন থেকেই মুসলিম লিগ নেতারা বিভিন্ন সেমিনার বক্তৃতা এবং বিবৃতিতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পায়তারা শুরু করেন।

উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম বক্তব্য আসে চৌধুরী খালিকুজ্জামনের কাছে থেকে ১৯৪৭ সালে ১৭ মে। তাঁর বক্তব্যে বাঙালি সুশীল সমাজ তথা বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।এতে তাঁরা বেশ বিচলিতও হন। ফলে এই বিচলিত বক্তব্যের প্রতিবাদে হাতে তুলে নেন কলম।

লেখক, সাংবাদিক আব্দুল হক ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ প্রবন্ধে তিনি প্রথম প্রতিবাদ জানান। ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৭ জুন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায় তাঁর এ লেখা প্রকাশিত হয়।১৯৪৭ সালের ২৭ জুন রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোরালো সম্পাদকীয় প্রকাশ করে সাপ্তাহিক ‘মিল্লাত’ পত্রিকা।

১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.জিয়াউদ্দিন আহমদ হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মতামত প্রদান করেন। তাঁর এ মতের প্রতিবাদ করেন জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্।

‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন "দৈনিক আজাদী" পত্রিকায়।এ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন,কংগ্রেসের নিদিষ্ট হিন্দির অনুকরণে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাৎগমণই হইবে। ইরেজি ভাষার বিরুদ্ধে একমাত্র যুক্তি এই যে,ইহা পাকিস্তান ডোমিনিয়নের কোনো প্রদেশের অধিবাসীরই ভাষা নয়। উর্দুর বিপক্ষেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। এরপর "রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব" প্রবন্ধ ১৯৪৭ সালে ২০ জুলাই প্রকাশ করেন মাহবুব জামাল জাহেদী।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় ও তৎপরবর্তী কালেও অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসেও রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার পক্ষে লেখালেখি চলে তুমুল পর্যায়ে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পাকশাসন ও পাকিস্তানবাদি চক্র সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলো সেগুলো ছিল সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। প্রাকৃতিক নিময়বিরোধী,নিবুদ্ধিতাপ্রসূর, হাস্যকর ও কাণ্ডজ্ঞানশূন্য।তবে পূর্ব পাকিস্তানের কাছে তা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ- বাঁচা-মরার প্রশ্ন।এ প্রশ্নে বাঙালিরা দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছিল। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ ছিল বাঙালি, যাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। অন্যদিকে ৪৪ ভাগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশের মোট বাসিন্দা। তাদের কোন সাধারণ ভাষা ছিল না। সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর - পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব প্রতিটি প্রদেশে মানুষ নিজস্ব ভাষায় কথা বলতো।

তাদের ছিল স্বতন্ত্র সাহিত্য ও সংস্কৃতি। কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষিত মানুষের ভাষা উর্দু। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করা মোটেও যুক্তিযুক্ত ছিল না।যদি একটি ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হতো তাহলে সঙ্গত কারণেই সংখ্যাধিক লোকের ভাষা বাংলাকেই অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল।কিন্তু বাস্তবে তা করা হয় নি। উর্দুকে জোরপূর্বক পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পায়তারা শুরু করে।তবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে লেখালেখি চলতেই থাকে। ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ঢাকায় ‘তমদ্দুন মজলিশ’- এর প্রচেষ্টায় একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। যার নাম দেয়া হয় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’। এ পুস্তিকার প্রথমমদিকে তমদ্দুন মজলিশের পক্ষে ভাষা বিষয়ক একটি প্রস্তাব সংযোজন করা হয়।প্রস্তাবটি লেখেন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও তমদ্দুন মজলিশের  প্রধান কর্মকর্তা আবুল কাসেম।

এ প্রস্তাবে বলা হয় -
১.বাংলা ভাষাই হবে:
ক. পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন
খ.পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা
গ. পূর্ব পাকিস্তানের দাপ্তরিক ভাষা

২. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে দুটি- উর্দু ও বাংলা।

৩.
ক. বাংলাই হবে পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা। এটা পূর্ব পাকিস্তানের ১০০/ লোক গ্রহণ করবে।
খ. উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা। যারা পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলে কাজ করবেন তারাই শুধু এ ভাষার শিক্ষা নেবেন।এটা পূর্ব পাকিস্তানের ৫-১০ ভাগ লোক গ্রহণ করলেই চলবে।ইংরেজি হবে পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা। পাকিস্তানের কর্মচারী হিসেবে যারা চাকরি করবেন বা বিজ্ঞান শিক্ষায় উচ্চতর জ্ঞান লাভে আগ্রহী তারা কেবল এ ভাষার শিক্ষা লাভ করবেন।তাদের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানে হাজারে একজন হলেও চলবে।
ঠিক একই ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু প্রথম ভাষা বাংলা দ্বিতীয় ও ইংরেজি তৃতীয় ভাষা হিসেবে পরিগনিত হবে।

৪. শাসনকার্য   পরিচালনা ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার  জন্য আপাতত কয়েক বছরের জন্য ইংরেজি ও বাংলা ভাষাতেই শাসনকার্য চলবে। প্রয়োজন অনুযায়ী বাংলা ভাষার সংস্কার সাধন করতে হবে।

ড. মুহম্মদ এনামুল হক ১৩৫৪ সালের কার্তিক সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ‘মাসিক কৃষ্টি’ পত্রিকায়। যা নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত।  কবি ফররুখ আহমদ ১৩৫৪ সালে আশ্বিন মাসে ‘সওগাত’ পত্রিকায় লেখেন- ‘পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধ। এতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষেই জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করা হয়।

সত্যি বলতে কি একক রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বিরুদ্ধে এবং বাংলার পক্ষে লেখক সাংবাদিকরাই প্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন।আবার এ সত্য যে তখন এ বাংলার বিপক্ষেও অনেক লেখক,সাংবাদিক,কবি, শিক্ষক  আমলারাও  অবস্থান নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে, কবি গোলাম মোস্তফা, সাংবাদিক মাওলানা আকরম খাঁ,মজিবুর রহমান খান,মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসাইন, সরকারি কর্মকর্তা মীজানুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া মুসলিম লিগের নেতারাও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জোর প্রচেষ্টা চালান।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যারা সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন প্রকৃতপক্ষে সাংগঠনিকভাবে তারা দুর্বল ছিলেন।গণআজাদী লিগ,গনতান্ত্রিক যুবলিগ,পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ তাদের গঠনতন্ত্রে ও বক্তব্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তুললেও সাংগঠনিকভাবে তারা শক্তিশালী ছিল না।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো  কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত এনভেলাপ, পোস্টকার্ড,ডাকটিকিট ও মানি অর্ডার ফরমে বাংলা ব্যবহার না করা।সেখানে শুধু উর্দু ও ইংরেজি ভাষার ব্যবহার করা হয়। এর ফলে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে নীলক্ষেত ব্যারাকের সরকারি কর্মচারীরা মিছিল বের করে।

কিছু সংখ্যক ছাত্র এতে অংশ নেয়। মিছিলের স্লোগান ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,সবকিছুতে বাংলা চাই, উর্দুর সাথে বিরোধ নাই’। এরপর ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচি শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিন্ধান্তের প্রস্তাব গৃহীত হয়।ফলে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের ঝর উঠে সর্বত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের ও ছাত্র নেতাদের উদ্যোগে১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর আর্টস বিল্ডিংয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

এতে সভাপতিত্ব করেন আবুল কাশেম আর বক্তব্য রাখেন মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, একেএম আহসান প্রমুখ।

সভাশেষে মিছিল বের করা হয়।  মিছিলের স্লোগান ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই,উর্দুর জুলুম চলবে না।এ প্রতিবাদ মুসলিম লিগ সরকারের রাষ্ট্রভাষা সিন্ধান্ত বদলাতে পারে নি।অবশেষে ভাষার পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যেতে গঠন করা হয়   ১৯৪৭ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এর আহবায়ক হন নূরুল হক ভূঁইয়া, সদস্য হন আবুল কাশেম, মুহাম্মদ তোয়াহা,নইমুদ্দিন আহমেদ, শামসুল আলম প্রমুখ।

লেখক: খালেদ মাসুদ, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, দক্ষিণ সুরমা সরকারি কলেজ, সিলেট।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ শাদিআচৌ-০২

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন