আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং

প্রেক্ষিত করোনা : প্রসঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২১-০৩-২০ ১৬:০৭:৪৮

প্রফেসর ড. মোঃ আতী উল্লাহ :: ২০২০ এর মধ্য-মার্চে বাংলাদেশে করোনা সনাক্ত হওয়ার পর খোদ এ আমি লকডাউন সামনে রেখে গবেষণার যথাসম্ভব গভীরে ঢুকে পত্রিকান্তরে অনে…ক-গুলো কলাম লিখেছি। সবগুলোই প্রকাশিতও হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে আজও বিদ্যমান এইড্স্ সহ বিশ্বব্যাপি নূন্যতম শ’খানেকের অধিক মহামারির নিষ্ঠুর ইতিহাসও তুলে ধরেছি, তুলে ধরেছি হিংসাত্বক ও দাম্বিক যুদ্ধ, মরনাস্ত্র বানানো-বিক্রির মানবতাবিরোধী প্রতিযোগিতা, দেশ-দখল, এবং করালগ্রাসি দুর্ভিক্ষের করুন ইতিহাসও। দেশে-বিদেশে সাড়ে ৪৪ বছরের আপাদমস্তক এ শিক্ষক মানবতার কল্যান মাথায় রেখেই ঐ লেখালেখিগুলো করেছি। সংস্লিষ্ট দপ্তর বা কর্তৃপক্ষের নজরে ওগুলো আদপেই পড়েছে কি না, তা অবশ্য আমি জানি না; কারণ, সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া তার অতিরিক্ত কোন ফলাফল আমি কখনো বুঝতে পারিনি।

অনেকগুলো কলামে আমি ভিন্ন ভিন্ন প্রসংগে উল্লেখ করেছিলাম, কৃষি-উন্নয়ন ব্যতিরেকে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা কখনো সম্ভব নয়। আর, তাই, প্রতিটি পেশাজীবি কৃষককে প্রণোদণা হিসেবে মাসিক কমপক্ষে আপাতত ১৫০০/= টাকা করেই চিকিৎসা-ভাতা দেয়া হোক। আমরা চাকুরিজীবিদের অসুখ-বিসুখ হয়, ডাক্তার-ঔষধ লাগে; কৃষকদের কি হয় না বা লাগে না? আমরা ভোট দিয়ে সরকার বানাই, তারা কি ভোট দেয় না? ধীরে ধীরৈ এই ১৫০০/= টাকাকে আমাদের সমান করা হবে। দেখবেন, কৃষকগণ কি ঘটায়। আর, ত্রাণ দিয়ে পাবলিককে ফকির বানানো ও ছবি তোলার দর্শণ আমরা বন্ধ করি; আর, ত্রাণ কতদিন দেয়া সম্ভব? একবার ত্রাণ আনতে গিয়ে রোজ-কামলা মানুষের ক্ষতি হয় তিন দিনের মজুরি; অধিকন্তু, ত্রাণে যা কিছুই দেয়া হয়, তাতে ঐ পরিবারের দু’দিনও চলে না এবং ঐ ত্রাণ-দ্রব্যের সকল কিছুই আবার ঐ কৃষকেরই উৎপাদন। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ত্রাণ আনতে গিয়ে পথের খরচে, বিতরণের খরচে লেগে যায় অর্ধেক; ফাও গেল তাদের নিজেদের রোজগার; অধিকন্তু, কেউ কেউ, সত্যি হোক আর মিথ্যে হোক, বনেন চোর, আবার গাল-মন্দও কম খান না।

আমার অনেক লেখায় আমি উল্লেখও করেছি – ইতিহাস ঘাটালে দেখা যায়, এক এক দেশে বা এক এক অঞ্চলে মহামারি এসে শুধু ঐ দেশেই, শহরেই বা অঞ্চলেই একটানা ৫/৭ বছরও থেকেছে বা স্থায়ী হয়েছে। দুনিয়ার একটিমাত্র দেশে ঐ অতিথি এসে যদি ৫/৭ বছর স্থায়ী হন, তাহলে বলুন এবার, দুনিয়ার ২৪০ টির মত দেশে/অঞ্চলে এসে করোনা-মেহমান কতদিন থাকতে পারেন? দেশ-দেশ ঘুরে উনি এ ভূবনে অন্তত এক শতাব্দি থাকার সম্ভবনা রয়েছে; কারণ, ‘করোনা’ শব্দের এক অর্থ  হচ্ছেঃ ‘শতাব্দি’। আবার, সংগে করে উনি অন্য আরো অনেক নানা ভাইরাস-মেহমানও নিয়ে আসতে পারেন। আর, পত্র-পত্রিকায় তো দেখলামই, বাংলদেশের কোন কোন অঞ্চলে নাকি করোনার সাথে আরও ডজনখানেক থেকে কুড়ি ধরনের ভাইরাস/উপ-ভাইরাসের সন্দেহও বিশেষজ্ঞরা করছেন। যদি তা সত্যই হয়, তা হলে, হে মানব! আপনি কয় প্রকারের ভাইরাসের ভেক্সিন আবিষ্কার করবেন, আর কত দিনে করবেন; ফলপ্রসুই বা হবে কতটুকু? অর্থাৎ, লাঠি আনতে আনতে কিলে শেষ; যদিও মাত্র গতকালই (১৮/৩/২০২১) আমি স্বয়ং এবং আমার অর্ধাঙ্গীনি, দু’জনে হানিমুনের মত একত্রে গিয়ে ভেক্সিনের প্রথম ডোজ্ নিয়ে আসলাম; আর, এখন আমরা বেশ আত্নপ্রসাদের নিঃশ্বাস ছাড়ছি।

বাংলাদেশের আলেম-উলামাগণ সকল ক্বওমি মাদ্রাসাহ্ তিন মাসের ভেতরেই খুলে দিয়েছেন। বড়-ছোট-র কোন ভেদাবেদ নেই। মসজিদের মক্তবসমূহে, বড়রা তো আছেই; ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়েরাও সকলেই আছে। একজন হুজুর, বা ছোট-বড় কোন একজন শিক্ষার্থী করোনায় মারা গেছেন বা গেছে – এ রকম কোন খবর অন্তত আমি আজও পাই নি। তাঁরা মোলাকাত (হাত মেলানো) তো করেনই, কোলাকোলিও করেন। মাস্ক পরেন খুব অল্পসংখ্যক, আর, তাও নামমাত্র করেন আত্নসম্মানের জন্য বা বাধ্য হয়ে মাত্র কিছু সময়ের জন্য। গ্রাম্য বাজারের ঠেলাঠেলি, চায়ের দোকানের এবং অলি-গলির আড্ডা, কই? প্রশাসন সহ সবাই তো নীরব। দাপটে ওয়াজ- মাহফীলসমূহ চলছে, পিন পড়ার জায়গাও নেই। জানাযাহ্ ও দাফন-কাপনের চাপাচাপি, খতম-পড়া, মিলাদ মাহফীলে গায়ে গায়ে লেগে-পড়ে বসা, গ্রামে-শহরে শাদী-মোবারকসমূহও চলছে নির্দিধায়, কুটুম-খেশের অভাব নেই, নাইওরি যাওয়া বরং বেড়েছে, শহরের বিয়ের সেন্টারগুলোতে উপচেপড়া ভীড়, একই চিত্র বৌ-ভাত বা ওয়ালিমায়ও, এক হাজারের জায়গায় মেহমান তিন হাজার। সিলেটের বন্দরবাজার, কাজিরবাজার, কোর্ট-পয়েন্ট, হাসানমার্কেট, সুরমা মার্কেট, কীনব্রিজ মোড়, কোর্ট-কাছারি, অফিস, ব্যাঙ্ক, এন.জি.ও.,মাছবাজার, সব্জিবাজার, কালিঘাট, হকারমার্কেট,  সকল ধরনের আড়ৎ এবং গুদাম, মহাজন-পট্টি, আন্তঃজেলা বাস-টার্মিনাল, শেখঘাট, হাসপাতাল-ওয়ার্ড-ক্লিনিক, ডাক্তারের চেম্বার, সোবহানিঘাট, উপশহরের বিভিন্ন পয়েন্ট, মিরাবাজার, শিবগন্জ, টিলাগড় পয়েন্ট, মেজরটিলাবাজার, খাদিম-বাজার, দরগাহ-মাজার, তালতলা, মির্জাজাঙ্গাল, লামাবাজার, রিকাবিবাজার, মধুশহিদ, নাইওরপুল, নয়াসড়ক, শাহী ঈদগাহ এলাকা, ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই এলাকা, আম্বরখানা, লেচুবাগান, জামতলা, চৌকিদেখি, নয়াবাজার, বিভিন্ন সিএনজি-স্ট্যাণ্ডসমূহ, লোকাল বাস-স্ট্যাণ্ডসমূহ, ট্রাক-স্ট্যাণ্ডসমূহ, ওসমানী মেডিকেলের সামনের এলাকা, ওসমানী মেডিকেলের দীর্ঘ লাইন, জালালাবাদ আই হস্পিটাল, রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল, উইম্যান্স মেডিকেল, সুবিদবাজার, পাঠানটুলা, মদিনামার্কেট, আখালিয়া, তেমুখি, মজুমদারি, বিভিন্ন খেলার মাঠ, সকল মসজিদ, আমার দেখা মন্দির ও পূজা উদযাপন; আর, সবার উপরে – পয়সাওয়ালাদের শপিংমলে ভীড়, হোটেল-রেস্টুরেন্ট,  ফার্মেসি, চুলকাটার দোকান, ছাপাখানা, পত্রিকা-অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ধাক্ক-ধাক্কি, রিক্সায়-মোটর সাইকেলে চড়ে দু’জন/তিনজন, অটোরিক্সার ভেতরের চাপাচপি, লেগুনার ভেতরের চাপাচাপি, বাসের ভেতরের ভিড়, ট্রেনের ভেতর, বিমনের ভেতর, অহরহ মানববন্ধন, শহর-গ্রামের পাড়ার দেকানের ভিড় ও আড্ডা, গ্রাম্য বিচারে ভিড়, এমন কি, বিউটি পার্লারসমূহ, সব জায়গাই লোকে-যানবাহনে লোকারণ্য, কোথায় গেল ফিজিক্যাল বা সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং? তার উপরে রয়েছে বরাবরের মত যানজটের চিরচেনা দৃশ্য।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠলগ্ণ থেকে আমার অধ্যাপনা-জীবনের ২৯ বছরই আমি কাটিয়েছি এই ক্যাম্পাসে। এর কাদা-ধূলা-বালি-ইট-পাথরের সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক থাকবে আজীবন। বিসিএস ক্যাডারের মর্যাদা লাভ করেও, এবং এমসি কলেজের মত একটি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পোস্টিং পেয়েও পেশাগত জীবনের প্রথম দিকেই সরকারি কলেজের চাকুরি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছি। সম্প্রতি সপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েও সিলেটের একটি ইংলিশ-স্কুল ও কলেজে (ক্যাম্ব্রিজ গ্রামার স্কুল এণ্ড কলেজ – বৃটিশ কারিকুলামে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল সহ, জাতীয় পঠ্যক্রমও সম্পূর্ণ ইংলিশ মিডিয়াম) প্রিন্সিপাল হিসেবে অনেকটা বাধ্য হয়েই যোগদান করতে হয়েছে; যওি দু’/তিন জায়গা থেকে ভিসি বা অন্য পদের অফারও এসেছে। ইংলিশ-স্কুল-কলেজই আমি বেছে নিয়েছি,কারণ, ইংলিশ আমার পেশা,যদিও এটা অবশ্যই আমার ‘ভালবাসা’ নয়।  

কিন্তু সময় পেলেই শাহজালাল-ক্যাম্পাসে যেতে হয় এবং যাইও। আর, প্রায়ই দেখি, দলে দলে কিছু ছাত্র-ছাত্রী এতিমের মত ক্যাম্পসের কোনায় কোনায়, রাস্তায় রাস্তায়, বৃক্ষরাজির ছায়াতলে ঘুরছে। হঠাৎ সামনে পড়ে গেলে, “স্যার, আমাদের জীবন তো শেষ হয়ে গেল, না পারি বাড়িতে যেতে, দেখলে মা-বাবার কষ্ট হয়; আর না পারি হলে থাকতে, মেসে গাদাগাদি করে থাকি, দু’একটা টুইশনিও করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হলেই বোধ হয় ভাল থাকতাম, হত-দরিদ্র পিতা-মাতার আশা-ভরসার স্থলই ছিলাম আমরা, এখন সবই গুড়েবালি…...ইত্যাদি, ইত্যাদি”। এ ভাবেই তারা বলে, আর, কারো কারো চোখে পানিও ছল ছল করতে দেখা যায়। এ রকম কথা সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেলায়ও সমভাবে প্রযোজ্য। সাহস-আশ্বাস দিলেও কোন কাজ হবে না বুঝে, নিজে বোকার মত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঐ স্থান দ্রুত ত্যাগ করার চেষ্টা করি।

মাঝখানে একবার ভার্সিটি খুলেছিল, অনেকগুলো পরীক্ষাও নেয়া হয়েছে। আবার বন্ধ। শাহজলালের মাননীয় উপাচার্যসহ, অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল মাননীয় উপাচার্য মহোদয়গণের উদ্যোগে, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মন্জুরি কমিশনের পরামর্শক্রমে যদি কিছু করা যায়, এ রকম চিন্তা আপনাদের সকলের অবশ্যই রয়েছে। আমি এ ক্ষুদ্র শিক্ষক বড়জোর এ কথাই বলতে পারি। এবার কয়েকটি বিনীত প্রস্তাব, তিন বছর আগেই এ রকম শিখেছি শাহজালালের বর্তমান মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের নিকট থেকে:
১/ যখনই বিশ্ববিদ্যালয় খুলুক, দু’মাসের মধ্যে সিনিয়রদেরকে সার্টিফিকেট দিয়ে বের করে দেয়া যায়। আর, জুনিয়রদের ক্ষেত্রে একই ফলো-আপ প্রযুজ্য করা যায়; কারণ, এদের অধিকাংশই কৃষকের সন্তান। আর, আমাদেরকে স্নরন রাখতে হবে – একমাত্র সুনামগণ্জের কৃষকরাই দেশের ২০% মানুষকে খাওয়ায়।
২/ সরকার প্রয়োজনে বছরে বছরে বিশেষ বিশেষ একাধিক বিসিএস এবং নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহন করে সবার চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে। কারণ, আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষর্থীগণ প্রকৃতপক্ষেই মেধাবি – আমি তো বিদেশের একটিমাত্র দেশে মোট ১৪ টি দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়েছি। অধিকন্তু, আমাদের দেশের সকল অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় হাজার হজার পোস্ট শূণ্য পড়ে আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উৎপাদিত গ্রাজুয়েটরা অমেধাবি, খারাপ, এ যুক্তি কেউ দিলে উনার উচিৎ হবে, প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উঠিয়ে দেয়া, ব্যস্, সব সমস্যা শেষ; এবার সকলে মিলে একসাথে প্রতিবন্ধী হয়ে বসে থাকতে পারি।
“বন্ধু গো, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে/দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি/তাই, যাহা আসে কই মুখে” – জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমার শেষ কথাঃ ব্যক্তি গরীব হতে পারে, কিন্তু সরকার কখনো গরীব হয় না।

লেখক : প্রিন্সিপাল, ক্যামব্রিজ গ্রামার স্কুল এণ্ড কলেজ, হাউজিং এস্টেট, পূর্ব পীরমহল্লা, সিলেট।
সাবেক (প্রতিষ্ঠাকালীন) বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন