আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

আউশের সম্ভাবনাময়ী জাত ‘ব্রি ধান৮২’ ও ‘মতিলতা’র অজানা গল্প

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২১-০৪-২৪ ০২:১৮:১৩

:: এ. কে. আজাদ ফাহিম ::

জনসংখ্যা বহুল আমাদের প্রিয় বাংলাদেশেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে আউশ মওসুমেও ধান উৎপাদন বাড়াতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে করতে হবে চাষাবাদ।

আউশ মওসুমের আবাদ এরিয়া বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছেন দীর্ঘ দিন থেকে। তার মধ্যে প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচী অন্যতম।

কৃষি বিজ্ঞানীরা নিত্য নতুন উপযোগি ও লাগসই জাতের উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সম্ভাবনাময়ী জাত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তাদের কর্মযজ্ঞে উপযোগি জাত গুলো কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করে তুলছেন। কৃষকরা লুফে নিচ্ছেন তাদের প্রয়োজন মতো উপযোগি ও লাভজনক জাত। ধারাবাহিকভাবে আউশ মওসুমে আবাদ এরিয়া বেড়েও চলেছে। উৎপাদনও সমান তালে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিউটের একটা জাতের পর আরেকটা জাত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে নিজস্ব স্বকীয়তায়। বিজ্ঞানীরা কৃষক ও দেশের চাহিদা মাথায় রেখে কাজ করে চলেছেন।

আজকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিউটের উদ্ভাবিত আউশের জাত ব্রি ধান৮২ নিয়ে আলোচনা করবো সে সাথে এ জাতের উদ্ভাবক প্রয়াত ড. তমাল লতা আদিত্য স্যারের এজাত সংশ্লিষ্ট কিছু স্মৃতিচারণ করবো।

ব্রি ধান৮২ রোপা আউশ মওসুমের খুবই সম্ভাবনাময়ী একটি জাত। বিএডিসি কতৃক উগান্ডা থেকে আমদানীকৃত নেরিকা ১০ থেকে বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন করে পরবর্তীতে শীষ থেকে সারি পদ্ধতির মাধ্যমে এ জাতটির উদ্ভাবন করা হয়। ব্রি-র বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয় এবং কৃষকের মাঠে ২ বৎসর ফলন পরীক্ষার পর ২০১৭ সালে জাতীয় বীজ বোর্ডের মাঠ মূল্যায়ন দল কর্তৃক কৃষকের মাঠে ফলন পরীক্ষা মূল্যায়নে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়ায় কৃষকের মাঠে রোপা আউশ মওসুমে চাষাবাদের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ড ২০১৭ সালে জাতটি ছাড়করণ করে।

২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট গাজীপুরে একটি সাত দিনে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার সুযোগ হয়। সে প্রশিক্ষণে  ব্রি-র গবেষণা বিভাগের পরিচালক ড. তমাল লতা আদিত্য স্যারের সাথে পরিচয় হয়। তাঁর প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে বুঝতে পারি বাঙলার ধানকন্যা খ্যাত এই কৃষি বিজ্ঞানী যেন এক জীবন্ত তথ্যকোষ। সে প্রশিক্ষণে তিনি প্রসঙ্গত সদ্য রিলিজ হওয়া ব্রি ধান৮২ নিয়ে কথা বলেন।

তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী মহোদয়ের নেরিকা জাতের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিলো। তার আগ্রহের কারনে নেরিকার একটি জাত থেকে ব্রি ধান৮২ উদ্ভাবন করা হয়। এজাতটা নিয়ে খুবই আত্মবিশ্বাসী ও আশাবাদী ছিলেন উদ্ভাবক তমাল লতা আদিত্য। তিনি বলেন, ব্রি ধান৮২ কে ‘মতিলতা’ও বলতে পারো। মতিয়া দিয়েছেন নেরিকা সেটাকে সমৃদ্ধ করে লতা দিয়েছে ব্রি ধান৮২। কথা গুলো হাসতে হাসতে বলছিলেন তমাল লতা আদিত্য স্যার। তিনি আবার বলেন, তোমরা আবার সত্যি সত্যি ‘মতিলতা’ বলতে যেওনা।

একটা জাত উদ্ভাবনে যেমন তিনি খুবই যত্নশীল তেমনি সে জাতটি সম্প্রসারণেও ছিলেন খুব কৌশলী। ওই প্রশিক্ষণের ৩০ জন অংশগ্রহণকারী থেকে আগ্রহী ৪ জনকে তিনি ৪ কেজি ব্রি ধান৮২ বীজ দিয়ে ছিলেন। সকলকে উনার নাম্বার দিয়ে ফলন জানানোর জন্য বলে ছিলেন। আমিও ১ কেজি বীজ পেয়ে ছিলাম। সে বীজ আউশ মওসুমে একজন কৃষককে দিয়ে চাষ করিয়ে ছিলাম। অনেক ভালো ফলন হয়েছে। নমুনা শস্য কর্তন করে স্যারকে ফোন করে ছিলাম। স্যার ফোন তুলতে পারেননি। তবে পরবর্তীতে তিনি আমাকে ফোন ব্যাক করলে আমি পরিচয় দিই। আমার কাছে তিনি ধানের ফলন কেমন হয়েছে জানতে চান। আমি নমুনা শস্য কর্তন অনুযায়ী ৫ টন ফলন হয়েছে বলে জানাই। শুনে অনেক খুশি হয়ে ছিলেন তিনি।

ব্রি ধান৮২ এর ফলন দেখে ওই এলাকার কৃষকরা খুব আগ্রহী হন। ওই কৃষককে দিয়ে আমি সব গুলো বীজ সংরক্ষণ করাই যা পরবর্তীতে নির্বাচিত কৃষকদের মাঝে বিনিময়ের মাধ্যমে বিতরণ করি। ব্রি ধান৮২ বিভিন্ন জায়গায় সম্প্রসারণের চেষ্টা করি। যেখানে যে কৃষক ব্রি ধান৮২ চাষ করেছেন সবাই খুশি হয়েছেন। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম ব্রি ধান৮২ তে স্বয়ং উদ্ভাবক কেন এতটা প্রত্যয়ী ছিলেন এ জাতের জন্য।

ব্রি ধান৮২ কিছু জরুরি তথ্য জেনে আসি :-
ফসল : ধান
জাতের নাম : ব্রি ধান৮২
গড় জীবনকাল প্রায় (দিন): ১০৫
ফলনের গুণগত বৈশিষ্ট্য : চালে আমাইলেজ ২৭ % ও প্রোটিন ৭.৬%। দানার আকৃতি মাঝারি মোটা ও ভাত ঝরঝরে।
জাতের ধরণ : উফশী
জাতের বৈশিষ্ট্য : ডিগ পাতা সামান্য হেলানো ও শিষগুলো উপরে থাকে ।
উচ্চতা (ইঞ্চি) : ৪৩
রোপণের সময় চারার বয়স : ১৫ দিন - ২০ দিন
লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব (ইঞ্চি ) : ৮
চারা থেকে চারার দূরত্ব (ইঞ্চি) : ৬
শতক প্রতি ফলন (কেজি) : ২০ - ২২
হেক্টর প্রতি ফলন (টন) : ৫
উপযোগী মাটি : দোআঁশ
উৎপাদনের মৌসুম : আউশ
বপনের উপযুক্ত সময় : ১-১৫ এপ্রিল, (৮ চৈত্র-২ বৈশাখ)
ফসল তোলার সময় : ২-১৮ শ্রাবণ, (১৮ জূলাই থেকে ২ আগস্ট)

এ জাতের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা :
ব্রি ধান৮২ স্বল্প জীবনকালীন জাত। জীবনকাল স্বল্প হওয়ায় রোপা আউশ মওসুমে এ ধান আবাদ করার পর আমন ধান আবাদের সুযোগ তৈরী হবে এবং এই ধান আবাদে পানি সাশ্রয় হবে।

বর্তমান সময়ে আউশের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান৪৮। আমি আশা করি ব্রি ধান৮২ এর জনপ্রিয়তা ব্রিধান৪৮ কে ছাফিয়ে যাবে। ড. তমাল লতা আদিত্য স্যার আজকে আমাদের মাঝে নেই তবে  ধান প্রজননবিদ হিসাবে  এই বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত ধানের জাত গুলো কৃষি ও কৃষকের মাঝে বেঁচে থাকবে যুগান্তর।

উল্লেখ্য, ড. তমাল লতা আদিত্য ২০২০ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর।

লেখক: উপসহকারী কৃষি অফিসার, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ শাদিআচৌ-০২

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন