আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বিশ্বজুড়ে ছন্দপ্রভা ছড়িয়ে দিলো ছান্দসিক

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৯-০৩ ০১:১৫:১৯

‘ছন্দপ্রভা ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বপ্রাণে’ এই শ্লোগান নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর রবিবার লন্ডনের ব্রাডি আর্ট সেন্টারে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, আবৃত্তি সংগঠন ছান্দসিকের আয়োজনে, আন্তর্জাতিক আবৃত্তি উৎসব ২০১৯। শুধু আবৃত্তি নিয়ে এমন আয়োজন মুগ্ধ করেছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের।

কিংবদন্তি সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অনলাইনে উৎসবের উদ্বোধনী ঘোষণা করেন।

দুপুর সাড়ে তিনটা থেকে শুরু হওয়া উৎসব চলে রাত ১১ টা পর্যন্ত। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সুলতান মোহাম্মদ শরীফ, মুক্তিযোদ্ধা খলিল কাজী এমবিই, লোকমান হোসেন এবং বাংলাদেশ হাই কমিশনের কমার্শিয়াল সেক্রেটারী এস এম জাকারিয়া হক প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে আবৃত্তি উৎসবের শুভ সূচনা করেন। ছান্দসিক সম্মাননা ২০১৯ প্রদান করা হয় আবৃত্তি শিল্পী সাংবাদিক উদয় শংকর দাশকে। যুক্তরাজ্যের আবৃত্তি শিল্পীদের পাশাপাশি উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেন বাংলা আবৃত্তিতে হালের ক্রেজ বলা যায় তাঁকে, মুনমুন মুখার্জী, অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যার আবৃত্তি লাখ লাখ ভিউ হয়। ছিলেন কলকাতার আরেক গুণি শিল্পী সুজাতা চৌধুরী, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ, আমেরিকা থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন নজরুল কবীর। সূচনাপর্বে উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকের উন্মোচন করেন অতিথিরা। ছান্দসিক নামীয় উৎসব স্মারকটি সম্পাদনা করেছেন অপূর্ব শর্মা ও মুনিরা পারভীন।

প্রেম বিরহ দ্রোহের কবিতার পাশাপাশি কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ও আবৃত্তি শিল্পীরা বাংলাদেশকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সতত সুপ্রিয় যখন ভারতের বাবরী মাসজিদ ভাঙা পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে আবৃত্তি করেন পুরো গ্যালারী নিস্তব্দ হয়ে যায়। মুনমুন মুখার্জী যখন আশীষ মুখোপাধ্যায়ের ভাগ মানি না দাগ মানি না, কবিতাটি আবৃত্তি করেন, তখন মনে হয়, কাটাতারে দেশ ভাগ হলেও আসলেই তো আকাশ মেঘ, পাখিদের কি দেশ হয়? ভাষার কি কোন দেশ হয়?

কলকাতার আমন্ত্রিত আরেক গুণি আবৃত্তি শিল্পী সুজাতা চৌধুরী একে একে শোনান রবীন্দ্রনাথের আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে। তার নিজের লেখা বরাকের কোলে জন্ম আমার, সহ বেশ কিছু কবিতা।

নজরুল কবীর শহীদ কাদরীর প্রবাস জীবনের হাহাকার নিয়ে যখন চুড়ুই দেখে কবির বাংলাদেশের আকুলতা বিলাপ করেন প্রবাসী দর্শকদের বুকটা কেমন মোচড়ে উঠে, সেই চুড়ইয়ের জন্য।

মুনিরা পারভীন পাঠ করেন অপূর্ব শর্মার বীরাঙ্গনা কথা থেকে আমি প্রভা রানী বলছি। ‘আমাকে গ্রামের লোক এখনো পাঞ্জাবীর বউ বলে, আমার ছেলে কাজলকে বলে পাঞ্জাবীর ছেলে...’

নাম ধরে ধরে ঠিকানা পরিচয় দিয়ে যখন ধর্ষক রাজাকারদের বিচার না হওয়ার, অপবাদ লাঞ্চনার কষ্টের বর্ণনা করেন, সেই ব্যার্থতা দর্শকদের পোড়ায়। অনুষ্ঠানের লাইভ দেখে এক দর্শক মন্তব্য করেন, এই আবৃত্তির পর অনুষ্ঠানটি বিরতি দেয়া উচিত ছিল কিছু সময়। চোখের পানি মোছার সময়টুকো অন্তত দরকার ছিল।

উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে, সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলেন, বিলেতে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক আবৃত্তি উৎসব নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। অস্থির সময়ে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধই বলা যায় এই উদ্যেগকে। কবিতা প্রেমের কথা বলে, সাম্যের কথা বলে, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা বলে। আবৃত্তিশিল্পীরা তাঁদের কণ্ঠ শৈলীতে তা হৃদয়গ্রাহী করে তোলেন। কবিতার প্রসারে এবং প্রচারে এই ধরণের উৎসব আমাদেরকে আশাবাদী করে। নতুন প্রজন্মের ইতিহাস বিমুখতা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি যে উদাসীনতা নিয়ে আমারা ভীত। সেই ভীতিকে দূর করবে এই উৎসব। বিলেতে এমন বৃহৎ আয়োজন, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী আবৃত্তি শিল্পীদের এক মঞ্চে নিয়ে আসার মত দুঃসাহসী কর্মটি জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী মুনিরা পারভীনের নেতৃত্বে সম্পাদন করছে ‘ছান্দসিক’ তাঁদের প্রতি আমার ভালোবাসা ও আশীর্বাদ রইল। বাংলাকে, বাংলা ভাষাকে প্রবাসে বাঁচিয়ে রাখবে এমন আয়োজন। তাদের এমন শৈল্পিক প্রয়াস দীর্ঘস্থায়ী হউক। এই শুভকামনা।

আহাকাম উল্লাহ বলেন, আমাদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারাকে প্রবহমান রাখতে প্রবাসীদের ভূমিকা কোনও অংশেই কম নয়। চেতনার স্বপ্নিল আকাশকে বহুবর্নিল করতে তাদের সময় উপযোগি বিভিন্ন উদ্যোগ বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের স্বতন্ত্রতাকে উদ্ভাসিত করে চলেছে। বাঙালীয়ানার গর্ব ও গৌরবকে ব্রিটেনে বসবাসকারী বাঙালীরা ঠিক যেভাবে ধারণ ও লালন এবং প্রচার করে চলেছেন তা এক কথায় অনন্য। এখানে দেশের মতোই প্রতিটি উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় অত্যন্ত নান্দনিকতায়। বাঙালির প্রতিটি দিবসই পালন করা হয়ে থাকে সাড়ম্বরে। নাট্য উৎসব যেমন হয়, তেমনিভাবে আয়োজন করা হয় সংগীত উৎসবের, হয় বইমেলা। সাহিত্য সভা এবং আবৃত্তিচর্চাও হয় নিয়মিত। আলোচনা অনুষ্ঠান আর নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সারা বছরই মুখর থাকেন বিলেত প্রবাসীরা। যুক্তরাজ্যে সব ধরণের উৎসবের আয়োজন হলেও আবৃত্তি উৎসব হয়নি কখনও। এই বন্ধ্যাত্ব দূর করতে আবৃত্তি সংগঠন ছান্দসিক এগিয়ে এসেছে। ছন্দপ্রভাকে বিশ্বপ্রাণে ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে সংগঠনটি প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক বাংলা আবৃত্তি উৎসবের। যা অনেক আগেই হতে পারতো। দেরিতে হলেও এই উদ্যোগ গ্রহণ করায় ছান্দসিককে আমি মুগ্ধচিত্তে সাধুবাদ জানাচ্ছি। এমন আয়োজনে আমি গভীরভাবে আপ্লুত।

বাঙালিয়ানাকে বিশ্বময় উদ্ভাসিত করতে এ ধরণের উদ্যোগের কোনও বিকল্প নেই। এমন একটি সময়ের প্রাক্কালে এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যে সময়টা নানা কারনেই তাৎপর্যপূর্ণ। এ অনুষ্ঠানের তিনমাস পর আমরা পালন করবো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে আমরা উদযাপন করবো স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী। বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ এ দু’য়ের সাথেই ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ব্রিটেন। একাত্তরে জাতির পিতাকে গ্রেফতারের পর করাচিতে দীর্ঘ কারাভোগ শেষে প্রথম তিনি জনসমক্ষে আসেন এই ব্রিটেনেই। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিরা যে ভূমিকা রেখেছেন তা এক কথায় অতূলনীয়। সেই ভূমিতে ছান্দসিকের এই আয়োজন একদিক থেকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই ঐতিহাসিকও বটে।

চতুর্থত প্রজন্মের প্রতিনিধি শিশু শিল্পী তাজরিয়া রহমান, নাশিতা নূর আফরা খন্দকার আবৃত্তি দিয়ে শুরু হয় আবৃত্তি পর্বের মূল অনুষ্ঠান। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে আবৃত্তি করেন, উদয় শংকর দাশ, তানজীনা নূর ই সিদ্দিকী, সৈয়দ রুম্মান, সোমা দাশ, মিছবাহ জামাল, মহুয়া চৌধুরী, মঈনুল হোসেন মুকুল, সুস্মিতা সাবরিনা এনি, জেবতিক রাজীব, ড: আনোয়ারুল হক, কাজী রাহনুমা আক্তার, হাসিনা আক্তার, ফকরুল আম্বিয়া, পপি শাহনাজ, রাজ দাশ, সোমাভা বিশ্বাস, বুলবুল হাসান, সাঈদা সায়মা আহমেদ, লুৎফুন নাহান বেবী, সতত সুপ্রিয় রায়, নজরুল ইসলাম অকিব, রওশন সিমি, প্রিয় জ্যোতি বাবু, তাহেরা চৌধুরী লিপি, স্মৃতি আজাদ, ফয়জুল ইসলাম ফয়েজ নূর। শহীদুল ইসলাম সাগর, উর্মি মাজহার, সমর সাহা, আরফুমান চৌধুরী, শতরূপা চৌধুরী, জিয়াউর রহমান সাকলাইন, রিজওয়ান মারুফ, মুনিরা পারভীন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন রেজোয়ান মারুফ।

উৎসবের একদম শুরু থেকেই বসে ছিলেন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরী, রাত ১১ টায় ফেরার পথে চুপিচুপি যখন বলেন, অনুষ্ঠানের লাইভ লিংকটা একটু দিও, আবার শুনবো, প্যারিস থেকে ,বাংলাদেশ থেকে, আমেরিকা থেকে,কানাডা থেকে সবাই অনলাইন জুড়ে যখন আফসোস করছেন এমন অনুষ্ঠানে থাকতে না পারার, তখন উৎসবের সফলতা নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকেনা। দর্শক গ্যালারীরে স্থান সংকুলান করতে না পেরে সামনে বাড়তি চেয়ারের সারি দিয়ে ও সামলানো যায় নি। অনেকেই হলের বাহিরে অপেক্ষায় থাকেন।

ছান্দসিকের প্রতিষ্ঠাতা ও উৎসব আহবায়ক মুনিরা পারভিন ব্রিটেনের দর্শক, শুভাকাঙ্ক্ষী স্পন্সর, গণমাধ্যমকে অনুষ্ঠানের সাফল্যের কৃতিত্ব দেন, তিনি বলেন, আমরা হয়তো সাহস করে উদ্যোগ নিয়েছি, কিন্তু সার্বজনীন যে সহযোগিতা পেয়েছি সবার কাছ থেকে, সত্যি আমি অভিভূত। প্রথম আয়োজনের ভুলত্রুটি নিয়ে আমার যে ভয় ছিল সেটি কেটে গেছে। পুরো বাঙালি কমিউনিটির কাছে আমরা ছান্দসিক পরিবার ঋণী থাকলাম। এবং আগামীর দায় কাঁধে নিলাম। শুধু সংস্কৃতির চর্চা নয়, আমাদের চতুর্থ প্রজন্মকে শিকড় মুখী করতে আমাদেও প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এখন থেকে নিয়মিত এই উৎসবের আয়োজন করা হবে। তিনি উৎসবের আন্তর্জাতিক সমন্বয়ক অপূর্ব শর্মাকেও বিশেষ ধন্যবাদ দেন, বাংলাদেশে বসে যিনি যাবতীয় প্রকাশনাসহ দেশে-বিদেশে যোগাযোগ ও সমন্বয় ঘটিয়ে উৎসবকে সফল করেছেন।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন

সাম্প্রতিক যুক্তরাজ্য খবর

  •   ফিলিস্তিনে হামলার প্রতিবাদে ব্রিটেনে বিক্ষোভ
  •   রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে ইউরোপের ১১ দেশের প্রবাসী নাগরিক সমাজের বিবৃতি
  •   রয়েল টাইগার স্পোর্টস ক্লাবের স্পনসরশিপের এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত
  •   টাওয়ার হ্যামলেটসের আবারো স্পিকার হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আহবাব
  •   যুক্তরাজ্যের নর্থাম্পটনে পাঁচ বাঙালি কাউন্সিলর নির্বাচিত
  •   সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের নি:শ্বর্ত মুক্তির দাবীতে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের মানবন্ধন
  •   রো‌জিনার মু‌ক্তির দাবী‌তে লন্ড‌নে সাংবা‌দিক‌রা রাজপ‌থে
  •   ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে ব্রিটেনের নর্থাম্পটনে বিক্ষোভ
  •   ২২দিনে দৌঁড়ে লন্ডনে পৌঁছালেন আফরোজ মিয়া
  •   ৩১৩ কিলোমিটার দৌড়ে ৮ মে লন্ডন পৌঁছাবেন সিলেটের আফরোজ মিয়া