Sylhet View 24 PRINT

ভিসির হাতে ঝাড়ু : শিক্ষকদের লাথি-ঘুষি

মোস্তফা কামাল

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১১-১৪ ০১:০৯:১১

সংবাদ হিসেবে চমৎকার। ছবিটিও একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখার মতো। কলাভবনের বারান্দায় ঝাড়ু দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুই মাসের পরিচ্ছন্নতা অভিযান উদ্বোধন করেছেন ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। এর আয়োজক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। উদ্বোধনী বক্তব্যে ভিসি বলেন, পৃথিবীর বুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটি একটি জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সে লক্ষ্যেই এ বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও সৌন্দর্যের মানদণ্ডে একটি মডেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অংশ হিসেবে এই কর্মসূচি। আর তিন বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ উদ্যাপন করবে। একই বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করা হবে। সেটা এখন পর্যন্ত ভবিষ্যতের ব্যাপার। কিন্তু বর্তমানের কী দশা? এভাবে চলতে থাকলে সুবর্ণজয়ন্তী পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি?

ভিসি যদি এই ঝাড়ুর কাজটা আরেকটু সম্প্রসারণ করতেন! ঝাড়ু দিয়ে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মারামারির সিরিয়ালটা বন্ধের উদ্যোগ নিতেন। ঝাড়ু দিয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ও আঙ্গিনার ময়লা-আবর্জনা সাফসুতরো কতটা লাভ হবে? এতে কি দাঙ্গাবাজ শিক্ষকদের চরিত্র পাল্টাবে? বাইরের চেয়ে তাদের ভিতরে ময়লা আরও বেশি।

ময়লার এই ভাগাড়ের দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। ঝাড়ুতে ক্যাম্পাসটা হয়তো ফকফকা হলোই। তাতে কি ফল আসবে? দলদাস, পাণ্ডা শিক্ষকরা কি বদলাবেন? তারা তো থেকেই যাবেন। নমুনায় বলে, তারা আবার মারামারি-হাতাহাতি করে নাক ফাটাবেন। কিছুদিন পর শিক্ষকদের দা-কুড়াল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মারামারি করেন, করতে পারেন। শুনতে কষ্ট লাগলেও চোখকে অবিশ্বাস করা যায় না। তাও আবার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে গর্ব করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারা। লাথি-উষ্ঠাসহ মস্তানিতে পারদর্শিতা শিক্ষকতায় বিশেষ যোগ্যতার পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতি করতে পারেন কিনা এ মতভেদ কেটে গেছে কবেই। সেটা তারা আচ্ছামতোই করে চলেছেন। রাজনীতির নামে ছাত্র সংগঠনগুলোর মতো তারা প্রকাশ্যে মারামারিও করছেন। মারামারিতে এক্সপার্টদের আলাদা কদরও তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকদের মধ্যে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতার কাছে ‘অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়া’ প্রভাষক মতিয়ার রহমান এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তো এই গুণেই। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মতিয়ার রহমানের ‘অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়া’ একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ছবিসহ সংবাদটি তখন দেশে ঝড় তোলে। ছি ছি রব ওঠে। মনে করা হয়েছিল তার কিছু একটা হবে। হ্যাঁঁ হয়েছে উল্টোটা। এতে তার উন্নতি হয়েছে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদায়ন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক। প্রভাষক হিসেবে যোগ দেওয়ার আট মাসের মাথায় সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি! ষণ্ডামি-পাণ্ডামির পুরস্কার। থোতার জোরে বলা যাবে এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। গোটা শিক্ষকসমাজের চিত্র নয়। কিন্তু আংশিক বা বিশেষ চিত্র কি নয়? তাহলে কী দাঁড়িয়েছে অর্থটা? শিক্ষকতার মহান পেশায় এরাই এখন মানানসই। আকাট মূর্খরাও বলবে, এটা হতে পারে না। অথচ বাস্তবে তাই ঘটে চলেছে। অকল্পনীয় হাতাহাতির কাণ্ড সেদিন দেখিয়ে দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ ও বাম ঘরানা সমর্থিত নীল দলের শিক্ষকরা। সাধারণ সভায় এক শিক্ষকের বক্তব্যের মাঝখানে অন্য এক শিক্ষকের তির্যক মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে শুরু হয় হট্টগোল। এরপর হাতাহাতি। আর টুকটাক লাথিউষ্ঠা। হল দখল, চর দখলসহ দস্যুপনার দৃশ্যের মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কোনো ধরনের আলোচনা বা সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় সভা। ওই ঘটনার পর জামাল উদ্দিনকে আহত অবস্থায় নেওয়া হয় ভিসির বাসভবনে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার থেকে চিকিৎসক এনে জামাল উদ্দিনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসাপত্র হাতে নিয়ে গভীর রাতে ভিসির বাসা থেকে বেরিয়ে নিজের বাসায় যান জামাল উদ্দিন। এর আগে, গত মে মাসে সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্ধারণে নীল দলের প্যানেল চূড়ান্ত করতে ডাকা হয়েছিল সভা এবং সেখানেও দফায় দফায় হট্টগোল হয়েছিল।

এ নিয়ে শিক্ষকদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। কে আগে মেরেছে এ নিয়ে মতভেদ আছে। সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সমর্থক অধ্যাপক আ খ ম জামাল উদ্দিন বলেছেন, প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী ও তাদের পক্ষের আরও দুই শিক্ষক এ হামলা করেছেন। আঘাতে তার নাক দিয়ে বেশ রক্ত ঝরেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এ ঘটনায় প্রক্টর রব্বানীকে পদচ্যুত করার দাবি জানিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন নীল দলের আহ্বায়ক আবদুল আজিজ। মারামারির পর অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের চমৎকার বায়স্কোপ। নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুল আজিজ বলেছেন, তিনি স্তম্ভিত; এ ধরনের ঘটনা তিনি জীবনে কোথাও দেখেননি। জীবনে তো তিনি আরও কত কিছুই দেখেননি। এখন দেখছেন। আরও দেখতেই থাকবেন। আর স্তম্ভিত হবেন। আমরা হব হতভম্ব, লজ্জিত। বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকরা যে নানা বর্ণে বিভক্ত হয়ে দলীয় রাজনীতি করছেন, এখন আর কেউ এ নিয়ে প্রশ্নও তোলে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নেই। কিন্তু শিক্ষক সমিতি, সিন্ডিকেট আছে। এ সমিতি ও সিন্ডিকেটের নির্বাচনও হয়ে আসছে যথারীতি। অথচ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের গরজ বোধ করেন না শিক্ষকরা। বরং কিছুদিন আগে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে তারা নিজেদের বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ব্যাপারটা আচানকও বটে।

মারামারি ছাড়াও শিক্ষকদের আরও কিছু কাণ্ডকীর্তি মোটেই শিক্ষাসুলভ নয়। তা রীতিমতো ভদ্রতাপরিপন্থী। এটা অযোগ্যতারও লক্ষণ। পৃথিবীর কোনো দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এভাবে গুণ্ডা-পাণ্ডার মতো আচরণ করেন না। বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য রক্ষার অন্যতম দায়িত্ব পালনকারীরাই যখন মারামারি করেন, তখন বাকি থাকল কী? শিক্ষকসমাজের মাথায় ধরা এই পচনের দ্রুত চিকিৎসা দরকার। সেটা ঝাড়ফুঁকে নয়। অবশ্যই সার্জিক্যাল কেস।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.