Sylhet View 24 PRINT

প্রিয় রুবানা এই স্বপ্নের মৃত্যু নেই

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১২-০৭ ০০:৪৫:৫০

পীর হাবিবুর রহমান :: প্রিয় রুবানা হক ভাবী, জানি, বিচ্ছেদ বেদনার বিষাদকাব্যের নায়িকার মতো আপনি এখন যন্ত্রণাবিদ্ধ। কিন্তু জানি না মৃত্যুর পর আমাদের সবার প্রিয় আনিসুল হক কেমন আছেন? তার কবরের মাটি এখনো শুকিয়ে যায়নি। সন্তানের  বুকে, মায়ের পাশে রহস্যময় ওই জগতে চিরঘুমে তার সব ক্লান্তি কি শেষ হয়ে গেছে? একজন তরতাজা স্বপ্ন দেখা সৃজনশীল তেজোদীপ্ত মানুষ এভাবে চলে গেলেন! যিনি হয়ে উঠেছিলেন  নন্দিত মেয়র, ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস অর্জনকারী ধীরচেতা মানবিক নেতা ও জনপ্রিয় মেয়র। তার এই অকাল মৃত্যু অবিশ্বাস্য! কিন্তু নিয়তির বিধান এভাবেই বোধহয় লিখে রাখেন বিধাতা। সম্রাট শাহজাহান বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু হচ্ছে পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। ’ আনিসুল হক ও আপনি তার ৯৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে ছুটেছেন।

প্রতিবার মনে হয়েছে এবার বোধহয় তিনি আর ফিরে আসছেন না। কিন্তু আল্লাহর কি রহমত এখনো তিনি বেঁচে আছেন। বিধাতার কি নিষ্ঠুর খেলা আনিসুল হকের অকাল মৃত্যুই তাকে দেখে যেতে হচ্ছে। আনিসুল হক নিজেও আপনার বুকভাঙা ক্রন্দন আহাজারি পেছনে ফেলে ছোট্ট ছেলে শারাফুলের লাশ কাঁধে নিয়ে বনানী কবরস্থানে শুয়ে দিয়েছিলেন, দাদির কবরের পাশে।

ধর্ম বিশ্বাসী মাতৃভক্ত স্নেহশীল মানুষ আনিসুল হক প্রায় প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর বনানী কবরস্থানে যেতেন। মা ও ছেলের কবর জিয়ারত করতেন। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ টালমাটাল রাজনৈতিক সময়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে শান্তি এবং সমঝোতার সংলাপের দরজা খুলতে ব্যবসায়ী সমাজের নেতা হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। সেই দিনগুলোতে টেলিফোন করতে গিয়ে দেখেছি মোবাইল আপনার হাতে আপনি বলছেন, তিনি বনানী করবস্থানে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাবেশে উদ্দীপনামূলক বক্তৃতায় তরুণদের ভিতরে স্বপ্ন দেখা ও তা সফল করার আগুনই জ্বালাননি, বলেছেন মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। অকপটে তিনি বলেছেন, কোন পথ পাড়ি দিয়ে কতটা সংগ্রাম শেষে গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর লড়তে লড়তে এই জায়গায় এসেছেন। একই সঙ্গে মায়ের প্রতি গভীর আনুগত্য ও ভালোবাসার বন্ধন এবং বিশ্বাস-আস্থা রাখার তাগিদ দিয়েছেন দৃঢ়তার সঙ্গে।

আনিসুল হক কোনো ধর্মযাজক বা ধর্মগুরু কিংবা বড় রাজনীতিবিদ নন, একজন সফল মানুষ হিসেবে তিনি মানুষের মধ্যে তারুণ্যের মধ্যে আইডল হয়ে উঠেছিলেন। কাজ যে ইবাদতের চেয়ে কম নয়, জীবনের যুদ্ধ যে কতটা বীরত্বের গৌরবে উজ্জ্বল সেটিই তুলে ধরেছিলেন। খোলা বইয়ের মতো নিজের জীবন মেলে ধরতে ধরতে তিনি পৃথিবীর মোহমায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। তিনি লন্ডনে অসুস্থ এই সংবাদ যখন প্রথম এলো, তখন চমকে উঠেছিলাম, আঁতকে উঠেছিলাম।

রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদকে ফোন করলে তিনি বললেন, আপনাদের প্রিয় কন্যার সন্তান হবে সেই খুশিতে আপনারা সেখানে গেছেন। আনিসুল হক কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না, বিধাতাও তাই যেনতেন অসুখ দেননি। অসাধারণ মানুষের জন্য এক বিরল রোগে আক্রান্ত করলেন। উন্নত চিকিৎসায় আপনারা লড়েছেন তার মৃত্যুর মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি নেওয়ার পরেও যখন তার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল, মানুষ তার জন্য আফসোস হাহাকার করে উঠল। মানুষ অশ্রুজলে উপলব্ধি করল আনিসুল হক তাদের হৃদয়ে কতটা আসন নিয়েছিলেন, কতটা জয় করেছিলেন মানব হৃদয়। তার সফল ব্যবসা ছিল, সোনার সংসার ছিল, বন্ধুত্বের বাঁধনে বাপ-ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল, সুন্দর বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতেই কতদিন গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছি। কখনো দু-তিনজন মিলে কখনো আপনাদের আতিথেয়তায় অনেকের সঙ্গে কাটিয়েছি মনোজ্ঞ সন্ধ্যা। আপনারা ছিলেন দুজনই মেধাবী, রুচিশীল, আধুনিক উদার সৃজনশীল, রোমান্টিক প্রেমিক যুগল। আমাদের আপন করে নেওয়ার তীব্র সম্মোহনী শক্তি ছিল দুজনের। আনিসুল হক নিজেই ছিলেন স্বপ্নের চেয়ে বড়। তার দেহের চেয়ে মনখানি ছিল আরও বেশি উদার। দিলখোলা প্রাণবন্ত আড্ডাবাজ, রোমান্টিক এ মানুষটি আপনার উচ্চসিত প্রশংসা করতেন। আপনার মেধা সৃজনশীলতাই নয়, রুচির তারিফ করতেও কার্পণ্য করেননি।

আপনার বাসভবনজুড়ে সাজিয়ে রেখেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা পুরনো মূল্যবান সামগ্রী। সেসব দেখিয়ে দেখিয়ে বলতেন এসব রুবানার সংগ্রহ। রুবানা শব্দটি তিনি যখন উচ্চারণ করতেন তখন রোমিওর মতো জগদ্বিখ্যাত প্রেমিকও পরাজিত হয়ে যেত তার ভালোবাসার কাছে। আমার ছোট্ট ফ্ল্যাটের অনেক আড্ডা আয়োজনে অনেকের সঙ্গে আলো ছড়িয়ে তিনি বসতেন। যে কোনো পরিকল্পনা বা কাজ নিয়ে তিনি ছক আঁকতেন, কিন্তু আমাদেরও পরামর্শ নিতেন। তিনি যখন শেষবারের মতো তার প্রিয় ঘরে এলেন তখন আমি বাড়ির বাইরে কঠোর নিরাপত্তা বলয় দেখে ফিরে এসেছি। কাছে গেলেও আমি তার চিরঘুমন্ত মুখ দেখতাম না। যতদিন বেঁচে থাকব আমার মনে সেই তরতাজা প্রাণবন্ত আনিসুল হকের হাসিমুখ ভরাট কণ্ঠ, শিল্পময় বাচনভঙ্গির কথাবার্তা বেঁচে থাকবে। প্রতি ঈদ ও নববর্ষে আপনাদের পাঠানো উপহার ছিল অন্যরকম। সবকিছুতেই আপনারা যে অন্যরকম সেটি ছাপ রাখতেন। শিল্পীর হৃদয় নিয়ে আপনারা যেন একে অন্যের জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। যুগলভাবেই সমাজে আলো ছড়িয়েছিলেন, মানবিক হৃদয় নিয়ে অনেকের চিকিৎসা ও লেখাপড়ার ব্যয় আপনারা বহন করেছিলেন। পেশাগত জীবনে নানা সময় তার পরামর্শ পেয়েছি, সহযোগিতা পেয়েছি।
 
এই সমাজ মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে, এই সমাজ মূল্যবোধের সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ে পতিত। রাজনীতির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা শেষ তলানিতে। আনিসুল হক রাজনীতি করতেন না, আমাদের তারুণ্যে সাদাকালো যুগের টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে হৃদয় জয় করেছেন। অসংখ্য বালিকা অনামিকার রক্ত দিয়ে ভক্ত হিসেবে তাকে চিঠি লিখেছে। তিনি চাকরি করেছেন কিন্তু স্বপ্ন দেখেছেন বড়, সেই স্বপ্নের আগুন জ্বালিয়েছেন জীবন সঙ্গিনী হিসেবে আপনি রুবানা হক। পোশাক খাতে তিনি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। আপনাদের পারিবারিক পরিবেশটিও দেখেছি বন্ধুসুলভ প্রাণবন্ত। ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তৃত করেছেন। ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে অন্য সবার চেয়ে শিল্পবোধ ও সৃজনশীল নায়কোচিত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মহিমায় নিজেকে অন্য উচ্চতায় ক্লিন ইমেজে দাঁড় করিয়েছিলেন।

কোনো দিন রাজনীতি না করলেও রাজনীতি ও সমাজসচেতন এই মানুষটিকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে চিনতে ভুল করেনি আওয়ামী লীগ। ঢাকা উত্তরের মেয়র হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল তাকে। পরিবর্তনের স্লোগান তুলে নিজের দীর্ঘলালিত স্বপ্ন তুলে ধরে পরিচ্ছন্নভাবে আপনাকে পাশে নিয়ে ভোটযুদ্ধে নেমেছিলেন তিনি। তার নির্বাচন রাজনৈতিক অঙ্গনে বা সরকারবিরোধী মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও নিজেকে তিনি সেই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রেখেছেন। গায়ে কাদা লাগতে দেননি। একজন আবেগ অনুভূতিপ্রবণ তেজোদীপ্ত মানুষ নির্ভুল অংক কষে ছক আঁকতেন। কঠোর পরিশ্রম ও প্রাণশক্তি স্বপ্ন আর পরিকল্পনার সঙ্গে দৃঢ় নেতৃত্বে এমনভাবে যুক্ত করতেন, যেখানেই হাত দিতেন সোনা ফলাতেন, যে পদক্ষেপ নিতেন সফল হতেন।

একটি রাজনৈতিক দলের মনোনীত মেয়র হয়েও তিনি রাজনৈতিক মঞ্চের গতানুগতিক নেতা হননি। সব নাগরিকের দক্ষ গণমুখী কর্মঠ সফল মেয়র হয়েছেন, ঢাকা উত্তরকে বদলে দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শক্তিতে গড়ে ওঠা এবং বছরের পর বছর অপরাধ সাম্রাজের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা তেজগাঁওয়ের অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড তুলে দিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এটি তিনি করেছিলেন। অবৈধ দখল থেকে চারযুগ পর সিটি করপোরেশনের জায়গা উদ্ধার করেছিলেন। যানজট ও দূষণমুক্ত পরিচ্ছন্ন পরিকল্পিত সবুজ নগরী গড়তে একের পর এক পরিকল্পনা নিয়েছেন। মাঠে নেমেছেন, পরিশ্রম করেছেন, গণমাধ্যমকে সঙ্গে টেনেছিলেন, আরেকদিকে গণজাগরণ ঘটিয়েছেন। নগর ভবনের টেন্ডারবাজি দুর্নীতি ভাগবাটোয়ারার সিন্ডিকেট ভেঙে নগরবাসীর আস্থা কুড়িয়েছেন। রাত-বিরাতে যেখানে দুর্ঘটনা, বিপন্ন মানুষ সেখানেই ছুটে গেছেন। মাঝেমধ্যেই তিনি ডাকতেন, পরামর্শ করতেন, অ্যাকশনে যাওয়ার আগে ফোন করে সহযোগিতা চাইতেন। তাকে বলতাম আপনি ঘুমান না, চেহারার লাবণ্য ফুরিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে দিতেন না।

বুঝতাম স্বপ্নের চেয়ে বড় একজন আনিসুল হক মেয়র হিসেবে সীমাবদ্ধতার দেয়াল ভেঙে বাইরে পা দিতে চান। অনেকে অনেক বেশি চাপ নিতেন। কত অবৈধ স্থাপনা জটিল অঙ্কের সমাধানের মতো তুলে দিয়েছেন। ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে একটি গ্রহণযোগ্য তুমুল প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে দেড় লাখ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন। সেই ব্যালট বিপ্লব আর কেউ কখনো দেখাতে পারবেন না। সেই তুমুল জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ হানিফ বার বার আকুতি জানিয়েছেন মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের জন্য। চট্টগ্রামের তিনবারের মেয়র মহিউদ্দিন চোধুরী আহাজারি করেছেন সিটি গভর্নমেন্টের জন্য। নিউইয়র্কের মেয়রের অগাধ ক্ষমতা ছিল বলেই সেই নগরীকে বদলে দিয়েছিলেন। তার ক্ষমতা এতটাই কিউবার ফিদেল কাস্ট্রোকে জাতিসংঘের অধিবেশনে আসতে দেননি। আমাদের এখানে মেয়ররা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো।

সম্যসাকবলিত নগরবাসীর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে গিয়ে পাগলের মতো অস্থির,  অশান্ত দিশাহারা হন। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মেয়র আনিসুল হক প্রমাণ করেছেন চাইলে প্রথা ভেঙে অনেক কিছু করা যায়। গুলশান, বনানী, উত্তরার চেহারা বদলে দিয়েছেন। এটুকু পেরেছেন তার সততা, দক্ষতা, সাহস, কমিটমেন্ট আর হৃদয়জুড়ে থাকা স্বপ্নের জন্য। তিনি যদি ক্ষমতা পেতেন বিপ্লব ঘটাতে পারতেন।

প্রিয় রুবানা হক, কত লেখক-সাহিত্যিকের আকুতি কচ্ছপের জীবন যেখানে সাড়ে তিনশ বছর মানুষের জীবন সেখানে এত ছোট কেন। এ ছোট্ট জীবনে আপনারা ছিলেন প্রেমিকযুগল, আপনাদের দাম্পত্য জীবন ছিল ভালোবাসায় পূর্ণ, সমঝোতায় প্রস্ফুটিত। সামাজিক জীবনে উজ্জ্বল ভাবমূর্তির দুজন দুজনকেই নয়, সমাজকেও ভালোবাসার সুতায় বেঁধেছিলেন। যে সম্পর্কে উপচেপড়া প্রেম, আবেগ, অনুভূতি ও আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর এবং তীব্র সেখানে খুনসুটি অভিমান ঝগড়া বিরোধ মাঝেমধ্যে দেখা দেয়। হয়তো আপনাদেরও ছিল কিন্তু একটি ভালোবাসার সুস্থ জীবনে আপনারা ছিলেন সুখী দম্পতির আইডল। এ জুটি ভেঙে দিয়ে অকালে চলে যাওয়া আনিসুল হক আপনার জন্য বিরহ যাতনা অন্তহীন হাহাকার ও নিঃসঙ্গতা হয়ে থাকবেন।

কিন্তু এ দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিগুলো উজ্জ্বল হয়ে সুখ দিয়ে যাবে আর অকালে চলে যাওয়া একজন আনিসুল হকের অসুস্থতাজনিত সময়ে যখন আপনি নিয়তির সঙ্গে লড়ছেন তখন একদল ঈর্ষাপরায়ণ মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনিসুল হককে ষড়যন্ত্রের খলনায়ক বানাতে চেয়েছে। চোখে রক্ত নেই, পর্দা নেই বিবেকবোধহীন এসব নষ্ট রাজনীতির মানুষেরা তার বিরুদ্ধে একজন মৃতপ্রায় মানুষকে নিয়ে কুৎসা রটিয়েছে। তখন আপনাদের মানসিক অবস্থা কতটা কষ্ট ও যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছিল সেটি আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এ যেন ‘কবিগুরুর কাদম্বরী দেবী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’ অবস্থা!

আনিসুল হককেও যেন মৃত্যুর স্বাদ নিয়ে প্রমাণ করতে হলো তিনি বিরল রোগে আক্রান্ত ছিলেন, কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ছিলেন না। বরং তার বিরুদ্ধেই নির্লজ্জ বেহায়ারা নোংরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারা আজ কি অনুশোচনায় ভুগছে? যারা তার প্রবল সাহস, সততা, আত্মপ্রত্যয়ের মধ্যদিয়ে ভুবন জয় করা চিরসত্যকে মেনে নিতে পারেনি। তার শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হচ্ছিল।

প্রিয় রুবানা ভাবী, তার অকাল মৃত্যু আপনাকে অকাল বৈধব্য দিয়ে গেলেও আপনি কি দেখেছেন তাকে শেষ বিদায় জানাতে কত অচেনা অজানা মানুষ দল-মত নির্বিশেষে অশ্রুজলে এক মোহনায় মিলিত হয়েছিল। তার কথা মনে পড়লে আমাদের অনেকের বুকভাঙা কান্না আসে। সেখানে আপনার মানসিক অবস্থা কতটা ভঙ্গুর সেটা বুঝতে পারছি। মানুষের এ সমবেত স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা যেন হাশরের ময়দানে এ মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে, আনিসুল হক একজন ভালো মানুষ ছিলেন। নিরহংকারী সৎ সাহসী এ নগরপিতা ইমানের সঙ্গে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ইবাদতের মতো পবিত্রভাবে পালন করে গেছেন। আল্লাহ তাকে অকালে নিয়ে গেলেও সম্মান দানে কার্পণ্য করেননি। মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে। প্রিয়তমা স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু স্বজন, অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর বাড়ি, অঢেল টাকা কিছুই তার সঙ্গে যায়নি। তার কাজের কীর্তি তাকে অমরত্ব দিয়েছে, সঙ্গে গেছে লাখ লাখ মানুষের দোয়া ও ভালোবাসা। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে যাদের সঙ্গে তার কখনো দেখা হয়নি একজন ভালো মানুষ আনিসুল হকের জন্য তারাও দোয়া করেছেন, মোনাজাত করেছেন, ফাতেহা পাঠ করেছেন, নামাজ আদায় করেছেন। এ বিচ্ছেদ আপনার জন্য বিরহ কাব্য হলেও এ মৃত্যু সম্মান ও গৌরবের। যে মৃত্যু অভিষিক্ত হয়েছে মানুষের করুণ কান্না আফসোস আহাজারি আর নিখাদ ভালোবাসায়।

প্রিয় রুবানা হক, ক্যান্সার আক্রান্তু শিশুসন্তানকে বাঁচাতে কী লড়াই না করেছেন। কাছের মানুষেরা তা দেখেছে। প্রিয়তম আনিসুল হককে বাঁচানোর জন্য সাড়ে তিন মাস যমের সঙ্গে কী যুদ্ধ করেছেন দেশবাসী দেখেছে। হয়তো আপনি হেরে গেছেন। নির্বোধ অনুভূতিহীন মানুষকে জীবনযুদ্ধের মোকাবিলা করতে হয় না। নিয়তির কাছে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয় না। আপনার জীবন সৃষ্টিশীলতার, এখানে সুখের অন্বেষণ থেকে জীবনের পূর্ণতা লাভে প্রতিটি পরতে পরতে কঠিন সংগ্রামের ভিতর দিয়ে একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষ হিসেবে চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে আপনি উঠে এসেছেন। দুই জোড়া চোখের স্বপ্ন নিজেদের এবং পরিবারকেই আলোকিত করেনি, দেশ এবং সমাজকেও আলোকিত করেছিল। একজন আনিসুল হকের মৃত্যুতে মানুষের মধ্যেই সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে গেছে।   আনিসুল হকরা যেমন যুগে যুগে জন্মায় না তেমনি তাদের স্বপ্নের মৃত্যুও হয় না।   তিনি অমরত্ব পাবেন তার কর্মে, আর আপনি ও আমরা বেঁচে থাকব তার স্বপ্নে। আল্লাহ আপনাদের এ শোক সইবার তৌফিক দিন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.