আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

আমি নিজেই আজ ক্যানভাসার

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০২-২৮ ০০:৩৪:১১

জুয়েল আইচ :: ছোটবেলায় পিরোজপুরের ইরা টকিজের সামনে সকাল দুপুর বিকেলে ওরা আমায় ঠায় দাঁড় করে রাখতো।

আমার আশা: কোনো ক্যানভাসার যদি তার প্রতিজ্ঞা মত দু'একটা জাদু দেখায়।

ভাগ্যে খুব কমই শিকে ছিঁড়তো। তবে শিশুমন সেই বয়সেই ক্যানভাসারদের বেশ ভালোভাবে চিনে ফেলেছিল।

বিক্রির লোভে মানুষ কি পরিমাণ মিথ্যে লোভ দেখাতে পারে। অসহায় অসুস্থ মানুষকে কি নিষ্ঠুরভাবে প্রতারণা করে পয়সা হাতিয়ে নিতে পারে!

ওদের ওষুধ (!) মলম, বড়ি, তাবিজ, গাছড়া, তেল পড়া, পানি পড়া নিমেষে সারতে পারে না এমন কোনো রোগ পৃথিবীতে নেই। এমন দাবি ওদের।

সেই থেকে ক্যানভাসারদের প্রতি আমার অথৈ ঘৃণা। অথচ গতকাল আমি নিজেই একজন ক্যানভাসার হয়ে এলাম।

অনেক দিন পরে গতকাল বই মেলায় গিয়েছিলাম। মরহুম ওস্তাদ বাবু রহমান আমায় বাধ্য করেছেন।

বিকেলের মেলায় মানুষের স্রোত। এক দিকে উঁচু একটা ছোট্ট মঞ্চ। সাদামাটা কিন্তু শক্ত। পিছের খাড়া স্ক্রিনে আদর্শলিপি হরফে লেখা,
নতুন বই
মোড়ক উন্মোচন

মঞ্চের ওপরে এবং নিচের তিন দিকে মানুষে ঠাসা।ওপরে ঠাসা সব বিশেষজ্ঞ লেখক, কবি, সমালোচক, পুলিশের বড় অফিসার, শিল্পী, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক, রাজনৈতিক নেতা, এমপি, মন্ত্রী,.. .. মাইক হাতে উপস্থাপক;
কাঁধে-স্ট্যান্ডে টিভি ক্যামেরা, আরো কতো কী।
সবাই বিশিষ্টজন। তবু ঠেলাঠেলি। একদল নামছেন তো তিন দল উঠছেন। আমাকেও কয়েক জন টেনে হিঁচড়ে মঞ্চে তুলে ফেললো। মঞ্চের সবাই বই-ক্যানভাসার।

উপস্থাপক ঘামছেন স্রোতের মত। তাঁর ও সহকারীদের হাতে শত শত বই এর বোঝা।
এক এক বিশিষ্টজনের বলার সময় মাত্র তিন মিনিট করে নির্ধারিত। কিন্তু এইসব বিশাল মাপের ক্যানভাসাররা হাতে একবার মাইক পেলে তার ওষুধের, থুরি বই'র গুনাগুন বর্ণনা আর শেষ হতে চায় না। এভাবে এত বস্তা বস্তা বইর বর্ণনা চলতে থাকলে আমার পালা আসতে তো এ বছরের বইমেলা শেষ হয়ে যাবে। এখন উপায়?

কয়েক জন আমার মুণ্ডুটা উপস্থাপকের চোখের সামনে নিয়ে ঝুলিয়ে ধরলো। অমনি তাঁর গলা ফেটে চিৎকার বেরিয়ে এলো,
--- এবার বই নিয়ে আসছেন, বিশ্বনন্দিত জাদুশিল্পী .. .. ।

অমনি হুড়মুড় করে অসংখ্য দর্শক, শ্রোতা,ক্রেতা, প্রকাশকের দল কোত্থেকে যেন সামনে ছুটে এলো। কিন্তু তাঁরা সবাই সুশৃঙ্খল।

বেশি দর্শক দেখলে আমার দেহ মনে আনন্দ উথলে ওঠে। কিন্তু মাত্র তিন মিনিটেই সব বলতে হবে।

--- সঙ্গীতের ওস্তাদ বাবু রহমান কয়েক দিন আগে মারা গেছেন, আপনারা জানেন?

--- হ্যাঁ।
অনেক দর্শকের চিৎকার।

--- যে মানুষটি কেবলই চলে গেল তাঁর একটা বই'র ক্যানভাসার হয়ে আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি। শুনবেন?

--- হ্যাঁ হ্যাঁ বলেন বলেন ।

--- বইখানার নাম,
'কণ্ঠশ্রী স্বাস্থ্যশ্রী'

আমি জানি বাংলা ভাষায় এমন বই আর একখানাও প্রকাশিত হয়নি। ইংরেজিতেও না ।

আমার নিজের প্রায় দুঃসাধ্য গবেষণা আছে বলেই আমি এত জোরের সঙ্গে কথাগুলো বলতে সাহস করছি।

আপনারা কি মিষ্টি করে গান গাইতে চান? সঙ্গীত শিখতে চান? বইটি আপনাদের জন্য লেখা।

আপনারা কি কেউ সঙ্গীত শিক্ষক? আবৃত্তি শিল্পী? বক্তা? অভিনেতা? উপস্থাপক? গলবিল বিশেষজ্ঞ (Laryngologyst)? থেরাপিস্ট? নেশাসক্ত?

তাহলে বইটি অবশ্যই সংগ্রহে রাখুন। বাবু রহমান আমার কোনো ওস্তাদ না। বন্ধু। অসংখ্য আনন্দ স্মৃতির সাথে এক সঙ্গে সঙ্গীত চর্চা, বিজ্ঞান মনস্কতার জন্য কিছু মিষ্টি তর্ক, আমাকে এখনো কাঁদায়।

নিখাদ প্রগতিশীল মানুষটির যে পুত্র কাল আমায় মঞ্চে টেনে তুলেছিল তার নাম, 'বৃহস্পতি চার্বাক চারু'। এমন নাম বাবু রহমানের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব।
যেমন সম্ভব হয়েছে এই অসম্ভব বইটি লেখা।

"সর্ব রোগের মহৌষধ" এর মত গুণকীর্তন শুনে এতক্ষণে আমাকে আপনারা একজন ক্যানভাসার শ্রেণির মানুষ ভাবতেই পারেন।

সঙ্গীত পাগল, মানবতাবাদী এই মানুষটি জেনেশুনে কখনো মিথ্যা বলতো না বলেই আমাদের মধ্যে এত ভালবাসা।

ভালবাসা এত তীব্র কারণ আমরা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আহা বাবু, এমন অসময়ে আমায় ফেলে চলে গেলে!

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন