আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

গড়তে চাইলে পড়তে হবে ।। মৃণাল কান্তি দাস

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৩-২১ ২০:৪১:১৭

এখন যার বয়স বিশ বছর, পাঠ্যবই ছাড়া এ যাবৎ সে কতটি বাইরের বই পড়েছে? সংখ্যাটা জানলে আপনি শঙ্কিত হবেন! মাধ্যমিক পাস করার আগ পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের নীচে ঢুকিয়ে লুকিয়ে আমরা বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসের বই পড়েছি। আজ বলতে দ্বিধা নেই অনেকবার বাবা-মায়ের হাতে মারও খেয়েছি। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার আগে প্রকাশ্যে উপন্যাস পড়ার কোনো অনুমতি আমার অন্তত ছিলো না। ওটাকে আমার অভিভাবকরা সর্বদা সময় নষ্ট করা ‘অকাজ’ হিসেবে গন্য করে এসেছেন। তখন মাঠে ধান ক্ষেতের ভেতরে বসে বই পড়েছি, গরু রাখতে রাখতে বই পড়েছি। তবুও পড়েছি। সমবয়সী যে কোনো ছেলেমেয়ে যেকোনো ক্ষেত্রে ভালো কৃতিত্ব দেখালে মা-বাবা যখন আফসোস করেছেন, আমাকে নিয়ে ব্যাপক হতাশায় ডুবে যখন গালমন্দ করেছেন আমি তখন বই পড়েছি। জেদ করে বই পড়েছি, রাগ করে বই পড়েছি, দুঃখ পেয়ে বই পড়েছি, আনন্দিত হয়ে বই পড়েছি।

কোনো ক্লাসে কোনো বৃত্তি আমি পাইনি, যদিও আমার বৃত্তি না পাওয়ার কোনো কথা ছিলো না। তবুও না পাওয়ায় বাবা-মায়ের চেহারায় হতাশার বেদনা ভর করলেও আমি সর্বদা বড় উচ্ছলই ছিলাম। কারণ আমি বারবার ভেবেছি- কেউ না জানুক, কেউ না মানুক, ট্যালেন্টপুলের তালিকায় আমার নাম জ্বলজ্বল না করুক, সমবয়সীদের মত সাময়িক কৃতিত্ব আমার না আসুক তাদের চেয়ে বেশি বই আমার পড়া হয়েছে ওটাই আমার কৃতিত্ব। আজ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি- ওটাই সত্যিকারের কৃতিত্ব ছিলো। হয়তো আমি অনেক বড় কিছু হতে পরলাম না, হয়তো আমি নামী-দামী লেখক হয়েও ওঠতে পারলাম না এবং হয়তোবা কোনোদিন হয়েও ওঠবো না তাতেও কী এসে যায়! কিন্তু আমার চরম বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি সাফল্যে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সেই ‘অকাজ’-ই সবচেয়ে কাজের হয়ে এসেছে এবং আসছে। সেই বই পড়া আমার আত্মাকে নির্মল শান্তি দিয়েছে।আমাকে শান্ত করেছে, আমাকে ধন্য করেছে। জীবনে আর কী হলাম-নাহলাম, পেলাম-না পেলাম সেটার চেয়ে আত্মার শান্তি অধিক আবশ্যক। সুস্থতার জন্য সর্বাগ্রে আত্মার শান্তি দরকার হয়। বই আমাকে সুস্থতা দিয়েছে।

আজকাল স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বাইরের বইয়ের প্রতি ততটা টান আর বোধ করছে না। বইয়ের নীচে লুকিয়ে তারা ফেইসবুকে চ্যাট করছে, হোয়াটসআপ চালাচ্ছে। অবসর বলতে কোনো সময় এখন আর তাদের জন্য নেই। যোগাযোগটাই এখন তাদের কাছে অন্যতম বিনোদন! কেউ কেউ ভেবে থাকেন- আমাদের নতুন প্রজন্ম আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির জ্ঞানকে ধারণ করে বেড়ে উঠছে। সুতরাং তাদের বই পড়া ততটা আবশ্যক নয়! বইয়ের গুরুত্ব এখন কমে গেছে! বই পড়ে যা পাওয়ার তা এখন ইন্টারনেট ঘেটে পাওয়া যাচ্ছে! তাই বই না পড়লেও জীবন চলে। হ্যাঁ, চলে! পঙ্গুর মতো চলে, অসুস্থ কিংবা প্রাণহীনের মতে চলে। বই পড়ে যা শেখার সেটা কোনো যুক্তি কিংবা প্রযুক্তি দিয়ে পূরণ একেবারেই অসম্ভব। আসলেই বই পড়ার গুরুত্ব নতুন করে ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। সেটা সকল বিজ্ঞজনই জানেন এবং মানেন। কিন্তু আমাদের বোধের সাথে বাস্তবতার সমন্বয়টা যথাযথ না হওয়ার বইবিমুখ একটা প্রজন্ম ক্রমেই বেড়ে উঠছে যা পুরো জাতির জন্য এক চরম অশনিসংকেত।

এমতাবস্থায় যেকোনো কৌশলে প্রথমে আমাদের স্কুলের শিশু-কিশোরদের কাছে বইকে নেশায় পরিনত করে তুলতে হবে। আমাদের প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোরদের পাঠাভ্যাস গড়তে অভিভাবক, শিক্ষক এবং অধিদপ্তরের বিশেষ সমন্বিত ভুমিকা অপরিহার্য। তবে আশার কথা হলো- এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্তাব্যক্তিদের সুদৃষ্টি এবং বেশ কিছু কার্যক্রম বর্তমান আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র দেশের ৬৪ টি জেলার ২৫০টি উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ১২০০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি ২০১০ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করছে। যদিও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৮৪ সাল থেকে উন্নত জাতি গড়ার উদ্দশ্যে মানুষকে বই পড়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন তথাপি একেবারে মাঠ পর্যায়ে সেসব কার্যক্রমকে আরো জোরদার এবং যথাযথ করতে হবে। বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের প্রচেষ্টার সাথে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক অধিদপ্তর এবং শিক্ষক-অভিভাবকদের যথাযথ সমন্বয় ঘটাতে হবে। কেননা, একটা জাতির ভবিষ্যৎ নির্মানে বইকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে না নিয়ে আসতে পারলে কোনো প্রযুক্তিতে সে জাতির কল্যানে আসে না। কোনো উৎকৃষ্টতম উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হতে পারে না।

লেখক :: শিক্ষক ও কবি
২১ শে মার্চ, ২০১৮

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন