Sylhet View 24 PRINT

সাইফুরের আরিফ ছিল, মুহিতের কেউ নেই

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৩-২৮ ১১:১০:০৪

পীর হাবিবুর রহমান :: বহুদিন পর সিলেট এসেছি। এসেছি মানে তিন-চার দিনের জন্য এসেছি। অনেকের সঙ্গে অনেক বছর পর দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। কথাবার্তা হয়েছে। দীর্ঘদিন পর সিলেট শহরটা ঘুরেও দেখেছি। অনেকের সঙ্গে উন্নয়ন ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে কথাবার্তাও বলেছি। অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। অনেক প্রশ্নের মুখেও পড়েছি। তাহেরা সালসাবিল চৌধুরী তৃষা ট্রাস্ট ব্যাংকে জব করে। আমার ভাগ্নি, ছোট আপার একমাত্র মেয়ে। তার বিয়েতে এলেও সংবাদকর্মীর অনুসন্ধিত্সু মন ও চোখ চারদিকের খবরাখবর জানা ও দেখার চেষ্টা করেছে। নগরবাসী এক কথায় বলেছেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সিলেটের উন্নয়নে কার্পণ্য করেননি। দুই হাতে ঢেলেছেন বরাদ্দ। উন্নয়ন নিয়ে তার কাছে গিয়ে কেউ কখনো ফিরে আসেননি। কিন্তু সাইফুর রহমানের উন্নয়নের জন্য যে আকাশছোঁয়া ইমেজ একদিন ছিল, বিএনপি জমানায় চারদিকে তার যে জয়ধ্বনি ছিল, ছিল প্রশংসার স্তুতিবাক্য তা মুহিতের কপালে জোটেনি।

অনেকের কাছে সরাসরি প্রশ্ন করেছি উন্নয়নের জন্য বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমানের নাম মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হলেও বিগত নয় বছরে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত এত উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়ার পরও কেন তার নাম মানুষের মুখে মুখে নেই। কেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে উচ্চারিত হচ্ছে না জীবনের পড়ন্ত বেলায় একসময়ের জাঁদরেল আমলা, ভাষাসৈনিক থেকে মুক্তিযোদ্ধা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নাম? সবাই বলছেন বললে ভুল হবে, বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীরা বলেছেন সাইফুর রহমানের ইমেজ আকাশছোঁয়া করেছিলেন তার দলের নেতা-কর্মীরা। বিশেষ করে সেদিন সাইফুর রহমানের ডান হাত হিসেবে সিলেটের রাজনীতিতে আজকের সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তদারকিই করেননি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর কৃতিত্ব মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সব উন্নয়নে কৃতিত্বের মুকুট পরিয়েছিলেন সাইফুর রহমানের কপালে।

কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দুর্ভাগ্য দলীয় মেয়র কামরানের জমানা থেকে আরিফের জমানা পর্যন্ত মাঝখানে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার আমলেও তিনি যত বরাদ্দ দিয়েছেন, উন্নয়ন করেছেন, তার কৃতিত্ব তার তহবিলে জমা দেননি কেউই। কামরান যখন উন্নয়ন করেছেন মুহিতের বরাদ্দের আলোচনা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়নি। কামরানকে পরাজিত করে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে মেয়রের আসনে বসলেও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় আসামি হিসেবে টানা প্রায় আড়াই বছর জেলে থাকতে হয়েছে। সেই সময় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার জমানায় মুহিতের বরাদ্দ বন্ধ থাকেনি। কিন্তু সেই উন্নয়নের কৃতিত্ব মুহিতের পক্ষে কেউ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়নি।

আরিফ উচ্চ আদালতের নির্দেশে কারামুক্ত হন, মেয়রের পদবিও ফিরে পান। দায়িত্ব পেয়েই মিস্টার অ্যাকশন হিসেবে পরিচিত আরিফুল হক চৌধুরী রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সাহসী ভূমিকা রেখে নতুন করে নিজের ইমেজ উজ্জ্বল করছেন। একদিকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আরিফের কারাদহন সিলেটবাসীকে তার প্রতি সহানুভূতিশীল করেছে, অন্যদিকে বেরিয়েই উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে তার পদচারণ প্রশংসিত করেছে। মেয়র হিসেবে আরিফ যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন তার বিশাল বরাদ্দ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দিচ্ছেন। কিন্তু মানুষ বলছে আরিফুল হক চৌধুরী ব্যাপক উন্নয়ন করছেন। সিটি করপোরেশনের উন্নয়নের কৃতিত্ব নিচ্ছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। উপজেলার উন্নয়নের কৃতিত্ব নিচ্ছেন উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ। অর্থমন্ত্রীর ডান হাত-বাম হাত হিসেবে সিলেটের মাঠে-ময়দানে পরিচিত রাজনীতিবিদরা কেউ অর্থমন্ত্রীর সিলেটের উন্নয়নে যে আন্তরিকতা ও বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছেন তার প্রচার যেমন মানুষের মধ্যে নিয়ে যেতে পারেননি তেমনি মুহিতের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে পরিচিত মাঠে-ময়দানের মুখগুলোও ব্যর্থ হচ্ছেন। মাঝখানে নিজেদের কীর্তির বিতর্কের বোঝা অর্থমন্ত্রীর ঘাড়ে তুলে দিচ্ছেন।

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নেমে শহরে যেতে যেতে সফরসঙ্গী ও দুবারের নির্বাচিত জনপ্রিয় কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদ দেখালেন রাস্তাঘাটের পাশে অবৈধ স্থাপনা এমনকি চার-পাঁচ তলা ভবন পর্যন্ত ভেঙে দিয়ে কীভাবে সরকারি জায়গা দখলমুক্ত হচ্ছে। জানালেন এই সড়ক সামনে চার লেন হচ্ছে। রিকাবিবাজার থেকে মীরের ময়দান হয়ে সুবিদবাজার পর্যন্ত সড়কটি শুধু প্রশস্তই হয়নি, দৃষ্টিনন্দনও হয়েছে। নেপথ্যে মুহিত,  মাঠে আরিফ, উন্নয়নের শোভাবর্ধনে আলোকিত হচ্ছেন সিলেট নগরবাসী। জলাবদ্ধতা নিরসনেও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে। ছড়া-খাল উদ্ধারে আরিফকে ২৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ছড়া-খাল খননের পাশাপাশি চলছে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ। মুহিত যা চেয়েছেন, আরিফ তা পারছেন। কিন্তু মুহিতের প্রশংসায় আলোচনায় পঞ্চমুখ হচ্ছে না মানুষ।

সিলেটের বাদাঘাটে আধুনিক জেলা কারাগারের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এটা সিলেটবাসীর বহুদিনের প্রত্যাশা। শত বছর পর নতুন করে মুহিতের হাত ধরে সিলেট সদর ও দক্ষিণ সুরমায় দুটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯০৩ সালে। সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের। সাইফুর রহমানের আমলে নির্মিত সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিকমানের ক্রিকেট স্টেডিয়ামেই পরিণত করা হয়েছে। এর স্থাপত্যশৈলী ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সারা বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।

গভীর রাত পর্যন্ত সাইফুর রহমানের বরাদ্দে আরিফুল হকের তদারকিতে কিন ব্রিজের দুই পাশে সুরমার তীর যেভাবে নান্দনিক সৌন্দর্যে সাজানো হয়েছিল সেখানে নগরবাসীকে আড্ডায় আড্ডায় সময় কাটাতে দেখা যায়। বিকাল হলেই ঢল নামে সুরমার পাড়ে। সুরমা নদীর ওপর কাজিরবাজার সেতুর কাজ সাইফুর রহমান শুরু করলেও মুহিত সমাপ্তি টেনেছেন। সবখানেই সব পথেই ডানে-বাঁয়ে তাকালেই মুহিতের বরাদ্দের ছোঁয়া পাওয়া যায়; কেবল পাওয়া যায় না তার অবদানের কৃতজ্ঞচিত্তে মানুষের স্বীকৃতি।

সিলেটের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে আওয়ামী লীগ আগামীতেও মেয়র পদে প্রার্থী করতে চায়। আবুল মাল আবদুল মুহিত ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন বয়সের কারণে অবসরে যেতে চান। তিনি আর নির্বাচন করতে চান না। তার ভাই ড. এ কে আবুল মোমেন দীর্ঘদিন থেকে মাঠে-ময়দানে ভাইয়ের সঙ্গে মঞ্চে মঞ্চে আসন নিয়ে বসছেন। তিনি প্রার্থী হতে চান। কিন্তু মুহিতের বিকল্প হিসেবে দলের ভিতরে বাইরে জনপ্রিয়তার বিচারে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী হিসেবে এখনো নিজেকে সে উচ্চতায় দাঁড় করাতে পারেননি। সাবেক মেয়র কামরানও চান মুহিত প্রার্থী না হলে সিলেট-১ আসনে তিনি ভোট করবেন। তার অনুসারীরা মনে করেন মেয়র পদে ভোট লড়াই কামরানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে ভোটযুদ্ধ তার জন্য হবে শাপেবর।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ছাত্রজীবন থেকে জেল-হুলিয়া খেটে রাজনীতিতে পথ হেঁটে এলেও ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখেন সব দলেই তার সঙ্গে রাজনীতি করা বা অনুজরা এমপি হয়ে গেছেন অনেক আগে। তার কপালে এখনো মনোনয়ন জোটেনি। মুহিতের বিকল্প হিসেবে তিনি নিজেও সিলেট-১ আসনে দলীয় মনোনয়ন দাবিদার।

এই লেখা যখন লিখছি তখন সিলেট নগরীতে আরেকটি লাশ পড়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও শিক্ষকের সহোদর মাহিদ আল সালাম অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার সময় রাতের নগরীতে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে করুণ মৃত্যুকে বরণ করেছেন। ঠিক এক দিন আগেই হলের রুম দখল নিয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতার ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে গেছেন আরেক নেতা। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত জঙ্গির আক্রমণে আহত ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের রক্ত ঝরলেও ক্যাম্পাসে শান্তি আসেনি। সিলেট নগরীতেও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ আধিপত্যের লড়াইয়ে এক বছরে চার কর্মী খুন হয়েছেন। মায়ের বুক খালি হয়েছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হয়েছে। একদা শান্তি ও সম্প্রীতির শহর সিলেট তার গৌরবের উত্তরাধিকারিত্ব হারিয়েছে।

সিলেটের রাজনীতিতে একজন আদর্শিক রাজনীতিবিদ হিসেবে জাসদের মশাল এখনো জ্বালিয়ে রেখেছেন লোকমান আহমদ। সিলেট ডায়াবেটিক হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডা. এম এ রকিব সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। লোকমান আহমদ দীর্ঘদিন থেকে ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সন্ধ্যার পর থেকে ডায়াবেটিক হাসপাতালে গভীর রাত পর্যন্ত তাকে পাওয়া যায়। একসময় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল সময়ে রাজনীতিতেই নয়, স্থানীয় ইস্যুতেও সব আন্দোলনে সংগঠক ও প্রিয়মুখ ছিলেন তিনি। ঢাকা থেকে সংবাদ কুড়াতে আসা সংবাদকর্মীদের আশ্রয়ের জায়গাও ছিলেন লোকমান আহমদ। বহুদিন পর তার সঙ্গেও দেখা হলো। আক্ষেপ করে বললেন, সিলেটের রাজনীতিতে নেতৃত্বের সংকট। বিশেষ করে স্থানীয়ভাবে মানুষের মধ্যে সর্বজনশ্রদ্ধেয় হিসেবে যারা মুরব্বির দায়িত্ব পালন করতে পারতেন তাদের শূন্যতা সাধারণ মানুষই নয়, তারাও উপলব্ধি করেন। মরহুম রাজনীতিবিদ দেওয়ান ফরিদ গাজী, এম এ হামিদ, আবদুন নূর মাস্টারের নাম আলোচনায় আসে। তাদের জায়গা অপূরণীয় রয়েছে।

সিলেটে এত উন্নয়ন, সিলেটের রাজনীতি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে ঢেউতোলা বরেণ্য মানুষদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় করে রাখার কোনো উদ্যোগ নেই। কেন নেই আমার মাথায় আসে না। বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের পর উপমহাদেশে জাতিসংঘের ৪০তম অধিবেশনের সভাপতি, দক্ষিণ এশিয়া কাঁপানো কূটনীতিক সাবেক স্পিকার মরহুম হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে শেখ হাসিনার সরকার এবার স্বাধীনতা পদক দিলেও সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সেনাশাসক এরশাদের কাছ থেকে আদায় করা এই মানুষটিকে স্থানীয়ভাবে বরণীয় করে রাখার কোনো উদ্যোগ নেই। তার নামে দক্ষিণ সুরমার রাস্তার একটি চত্বর রাখা হলেও কোনো সেতু, কোনো স্টেডিয়াম বা বিশ্ববিদ্যালয় হলের নামকরণ হয়নি। একই অবস্থা উপমহাদেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম আবদুস সামাদ আজাদের বেলায়ও। রাজনীতির পবিত্র পুরুষ বাম নেতা পীর হবিবুর রহমানের নামে সিলেটের পৌর পাঠাগার ও একটি চত্বর করা হলেও তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নামে কোনো নামকরণ এখনো হয়নি।

মরহুম সাইফুর রহমান জীবিতকালে কিছু স্থাপনা তার নামে নামকরণ করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী মুহিতের আমলে সাইফুরের অনেক নামকরণ মুছে দেওয়া হয়েছে। তার নিজের নামে ‘আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স’ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর নামে সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নামকরণটি এরশাদ জমানায় হয়েছিল। সে সময়ে না হলে পরবর্তীতে কেউ করতেন কিনা জানি না। ইতিহাসের সন্তানদের মূল্যায়ন করতে কার্পণ্য কেন তাও বুঝি না।

সিলেটে আসতে না আসতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম এবং পড়লাম অভিনেতা মোশাররফ করিমের মন্তব্য ও তা নিয়ে তার ক্ষমাপ্রার্থনা ঘিরে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করতে গিয়ে একটি গোষ্ঠীর আক্রমণের মুখে পড়েন মোশাররফ। মোশাররফ করিমকে অনেক বছর আগে থেকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। আড্ডার আসরে সাদা মনের এই তুখোড় অভিনেতা সবাইকে মন খুলে হাসাতে পারেন। তার প্রখর হিউমার সেন্স সবাইকে মুগ্ধ করে রাখে। কারও আগে পিছে না থাকা কারও সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদে না জড়ানো আনন্দ-আড্ডা আর অভিনয়ে ডুবে থাকা একজন মোশাররফ করিম হৈচৈ পড়ে যাওয়ার মতো কথা বলেননি। তিনি মন্তব্য করেছিলেন ‘ধর্ষণের জন্য যদি পোশাক দায়ী হয় তবে পাঁচ বছরের শিশু, বোরখা পরা মেয়েরাও কেন ধর্ষিত হয়? মূলত পোশাক নয় ধর্ষণের জন্য কামুক পুরুষের অসুস্থ মানসিকতাই দায়ী।’ মোটা দাগে এই মন্তব্য করেছিলেন মোশাররফ। এ নিয়ে এত আপত্তি আক্রমণ কেন বুঝলাম না।

মোশাররফ নীতিগত অবস্থান থেকে ভয় পেয়ে কেন সরে গিয়ে ক্ষমা চাইলেন তাও আমার উপলব্ধিতে আসেনি। আমি মনে করি মোশাররফ সঠিক কথা বলেছেন। হিজাব পরা মেয়ে তনু কেন ধর্ষিত হলো? তার পোশাক, চালচলনে কোনো উগ্রতা ছিল না। এমনকি ছয় মাসের শিশুরাও ধর্ষিত হচ্ছে। সম্প্রতি একজন ইমাম গ্রেফতার হয়েছেন চার বছরের শিশুকে ধর্ষণ করতে গিয়ে। দিনের পর দিন ধর্ষণকারী একজন মাদ্রাসার শিক্ষক কয়েক দিন আগে আটক হয়েছেন। সেই মেয়েটি তার কাছে হিজাব পরেই পাঠ নিতে গিয়েছিল। ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ। মাদ্রাসার কোনো কোনো শিক্ষক ছাত্রীকে নয়, ছাত্রদের পর্যন্ত ধর্ষণ থেকে রেহাই দিচ্ছেন না। এটা হচ্ছে মানসিক বিকারগ্রস্ততা। এটা হচ্ছে যৌনবিকৃত কামুক পুরুষের লালসা। এই লালসা কেবল মাদ্রাসা শিক্ষক নয়, কেবল মসজিদের ইমাম নয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে স্কুলশিক্ষকই নয়, শিক্ষিত সমাজের কর্মক্ষেত্র থেকে গার্মেন্ট সেক্টর পর্যন্ত ঝরছে। বিকৃত যৌন লালসার আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে সবখানে মেয়েরা। ঘর থেকে শিক্ষাঙ্গন, কর্মক্ষেত্র, পথেঘাটে— এর জন্য পোশাক কখনো দায়ী হতে পারে না। যারা ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের বিপরীতে অপরাধীর শাস্তি না চেয়ে ধর্ষিতার পোশাককে দায়ী করেন কার্যত তারা ধর্ষককেই বাঁচাতে চান, নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ধর্ষকের মুখোশটি উন্মোচন করেন।

পশ্চিমা দুনিয়ায় স্বল্পবসনায় চলাফেরা করা নারীদের দিকে যৌন দৃষ্টিতে তাকানোই অন্যায়। সভ্যসমাজে কেউ তাকায় না। অসভ্য সমাজে হিজাব বা বোরখা পরা মেয়েরাও বিকৃত পুরুষের যৌন দৃষ্টির আক্রমণ থেকে মুক্তি পায় না। এমন হিংস্র দৃষ্টিতে তাকায় যেন মনে হয় তার চোখ মেয়েটিকে ধর্ষণ করছে। একজন মানুষ কী পরবে না পরবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। ঐতিহ্যগত দিক থেকেই আমাদের দেশে কী নারী কী পুরুষ উন্মাদ না হলে কেউ উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করে না। কথায় কথায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষের মুখোমুখি ধর্ষকের অপরাধকে আড়াল করতে পোশাকতত্ত্ব নিয়ে যারা বিতর্ক তুলছেন তারা ধর্মীয় জীবনাচার কতটা পালন করেন জানি না। তবে এটা বুঝতে পারি ধর্মের নামে একটা উগ্রতার জিকির তুলে একটি শক্তি পোশাকতত্ত্ব নিয়ে ধর্ষকদেরই আড়াল করতে চাচ্ছে না, সমাজটি জঙ্গিবাদের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছে।

সমাজের সব ক্ষেত্রে তারুণ্যের শক্তিকে এসব শক্তির বিরুদ্ধে যুক্তির লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার এখনই সময়। রাজনৈতিক শক্তিকে উপলব্ধি করতে হবে যেখানে কারও পোশাক নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে না সেখানে ধর্ষকদের হয়ে পোশাকতত্তের বিতর্ক সৃষ্টির ঔদ্ধত্য কোন ধর্মান্ধ শক্তি দেখাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সর্বশেষ মুসলিম মডারেট দেশ বলেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা হারিয়েছে রাষ্ট্র অনেক আগে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর আঘাত এসেছে বার বার। পোশাক বিতর্কের নামে মডারেট মুসলিম দেশের চরিত্রও কি হারাতে বসেছি?

লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিম বিডিডট নিউজ

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.