Sylhet View 24 PRINT

দান কিংবা যাকাত নিয়ে কিছু কথা

আলী ফজল মোহাম্মদ কাওছার , সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৪-১৫ ১৯:০৮:২৮

আলী ফজল মোহাম্মদ কাওছার :: আমাদের জীবনের সবকিছুতে আল্লাহ ও আল্লাহর হাবীব সারওয়ারে কাওনাইন রহমতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সন্তুষ্ঠির লক্ষে সব কাজ করতে হবে, কোন ব্যক্তিকে দান কিংবা সমাজকে কিছু দিতে হলে চিন্তা করতে হবে আল্লাহ ও উনার হাবীবের সন্তুষ্ঠি ।

গোপনে দান করার ফযীলতঃ গোপন-প্রকাশ্যে যে কোনভাবে দান করা যায়। সকল দানেই ছওয়াব রয়েছে। আল্লাহ বলেন:

إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ

”যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকীর-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে এটা বেশী উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন।” (সূরা বকারা- ২৭১)

গোপনে দানকারী কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া লাভ করবে: নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “কিয়ামত দিবসে সাত শ্রেণীর মানুষ আরশের নীচে ছায়া লাভ করবে। তম্মধ্যে এক শ্রেণী হচ্ছে:

وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ

“এক ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে বাম হাত জানতেই পারে না।” (বুখারী ও মুসলিম)

যারা মালিকে নিছাব বা ছাহিবে নিছাব, তাদের উপর যাকাত ফরয। আর মালিকে নিছাব বা ছাহিবে নিছাব বলতে বুঝায়, যে মুসলমান স্বাধীন, বালেগ বা বালেগার নিকট ‘হাওয়ায়েজে আছলিয়াহ (নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, মাল-সামানা) বাদ দিয়ে কর্জ ব্যতীত নিজ মালিকানাধীনে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্য বা তার সমপরিমাণ মূল্য পূর্ণ এক বছর থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয। অর্থাৎ নিম্ন বর্ণিত দশ প্রকার গুণ সম্পন্ন লোকের উপর যাকাত ফরয-

(১) মুসলমান হওয়া। (২) বালেগ হওয়া। (৩) জ্ঞানবান হওয়া। (৪) স্বাধীন হওয়া। (৫) নিছাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া (৬) পূর্ণ নিছাবের একক মালিকানা থাকা। (৭) নিছাব করজমুক্ত হওয়া (৮) নিছাব পরিমাণ মাল হাওয়ায়িজে আছলিয়ার অতিরিক্ত হওয়া। (৯) মাল বর্ধনশীল হওয়া। (১০) নিছাবের মালের বৎসর শেষ হওয়া ।

(দলীলসমূহ : আলমগীরী, আইনুল হেদায়া, বাহরুর রায়েক, ফতওয়ায়ে আমিনীয়া।

যাকাত দেওয়া ধনীদের জন্য ফরজ কিন্তু বর্তমান সমাজে দেখা যায় যাকাত কিংবা দান করার সময় মঞ্চ বানানো হয়, প্যান্ডেল বানানো হয়, মাইক ভাড়া করে আনা হয়, অনেক সময় যাকাত নিতে গিয়ে ভিড়ে পড়ে অনেক মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, এটা কি ইসলাম সমর্থন করে??

যাকাতের কাপড় বলে এক ধরণের কাপড় দোকানে পাওয়া যায়, এটা কি ইসলাম সমর্থন করে, যাকাত দাতাদের উদ্দোশ্যে বলি আপনারা আপনাদের উপর ফরজ গরীবদের দিচ্ছেন আর ফলাও করে দানবীর সাজার চেষ্ঠা করতেছেন ।

এছাড়া অনেক লোক আছেন যারা ব্যক্তি কিংবা সমাজে অনেক কিছু দান করেন তা আবার ফলাও করে প্রচার করেন, এটা কি ইসলাম কি সমর্থন করে, এতে লোক দেখানো হচ্ছে কিনা??

রিয়া বা লোক দেখানো ‘ইবাদাত তিন প্রকার। যথা:-

(১) কোন নেক কাজ (‘ইবাদাত) মূলত: শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র গায়রুল্লাহ্‌কে (আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাউকে) দেখানোর উদ্দেশ্যে বা মানুষের প্রশংসা লাভের উদ্দেশ্যে করা, এবং বাহ্যিকভাবে লোকজন যেন তার কাজটা দেখে আল্লাহ্‌র ‘ইবাদাত বলেই মনে করে, এমন মনোভাব পোষণ করা।

যদিও এতে আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কাউকে অংশীদার বা সমান করা উদ্দেশ্য না হয়ে থাকে তথাপি এ জাতীয় ‘ইবাদাত হলো শিরকের (শিরকে আসগারের) অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের ‘ইবাদাত আল্লাহ্‌র নিকট আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কোন মু’মিন ব্যক্তি এরূপ ‘ইবাদাত করতে পারে না।

আর যদি ‘ইবাদাতে গায়রুল্লাহ্‌কে আল্লাহ্‌র (0) একক প্রাপ্য ও অধিকারে শামিল বা অংশীদার করা উদ্দেশ্য হয়, কিংবা মুল কাজটাই যদি আল্লাহ 0 ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়, তাহলে তা শিরকে আকবার বলে গণ্য হবে।

হাদীছে ক্বোদছীতে রাছূল ১ থেকে বর্ণিত, আল্লাহ ০ ইরশাদ করেছেন:-

أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي، تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ

অর্থাৎ- আমি অংশীদারদের অংশীদারিত্ব থেকে সম্পূর্ণ প্রয়োজন মুক্ত (আমার সাথে কেউ অংশীদার বা শরীক হোক এ ধরনের কোন প্রয়োজন আমার আদৌ নেই)। যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করে যাতে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে, আমি তাকে ও তার অংশীদারকে প্রত্যাখ্যান ‍করি।২

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, রিয়া সাধারণত শিরকে আসগার তথা ছোট শির্‌কের পর্যায়ভুক্ত হয়ে থাকে। তবে মনের ভাব ও নিয়্যাতের ভিত্তিতে কখনো তা শিরকে আকবার অর্থাৎ প্রধান শিরকের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়।

(২) কোন ‘ইবাদাত মূলত: একমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই শুরু করা, তবে ‘ইবাদাত করাকালীন বা চলাকালীন মধ্যবর্তী সময়ে অন্য কেউ তা দেখে ফেললে বা অবহিত হয়ে গেলে তাতে আনন্দিত ও উল্লাসিত হয়ে লোক দেখানোর জন্য ‘ইবাদাতকে আরো সুন্দর করার চেষ্টা করা কিংবা পরবর্তী অংশটুকু লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে করা। এ অবস্থায় ‘আমাল বা ‘ইবাদাতটি যদি এমন হয় যে, তার এক অংশ অপর অংশের উপর নির্ভরশীল নয় বরং তার প্রতিটি অংশ পৃথক পৃথক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাহলে সেই ‘আমাল বা ‘ইবাদাতের যে অংশটুকু রিয়া মিশ্রিত হবে, শুধুমাত্র সে অংশটুকু বাত্বিল হয়ে যাবে, তবে তার সম্পূর্ণ ‘আমাল বাত্বিল হবে না। যেমন- কোন ব্যক্তি একমাত্র মহান আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে দু‘শত টাকা ফক্বীর-মিছকীনদের দান করতে শুরু করল, ইতোমধ্যে একশত টাকা দান করার পর হঠাৎ করে সে দেখল যে, অনেক লোক তার দিকে চেয়ে আছে, তাকে বাহবা দিচ্ছে এবং তার প্রশংসা করছে, এতে করে তার মনের মধ্যে রিয়া বা লৌকিকতার ইচ্ছা দেখা দিল এবং অবশিষ্ট একশত টাকা সে মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে কিংবা আরো বেশি করে তাদের বাহবা ও প্রশংসা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে দান করল। এমতাবস্থায় তার দানকৃত প্রথম একশত টাকা আল্লাহ্‌র (0) নিকট মাক্ববূল (গৃহীত) হবে এবং পরবর্তীতে দানকৃত একশত টাকা আল্লাহ্‌র (0) নিকট বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত বলে গণ্য হবে।

আর যদি ‘আমালটি এরকম না হয় বরং তার প্রথম অংশ শেষ অংশের উপর বা এক অংশ অপর অংশের উপর নির্ভরশীল হয় অর্থাৎ ‘আমালের এক অংশ অপর অংশের সাথে এমনভাবে জড়িত হয়ে থাকে যে, এর প্রতিটি অংশ একটি অপরটি ব্যতীত পূর্ণতা লাভ করতে পারে না, তাহলে এর দুই অবস্থা-

(ক) ‘আমাল বা ‘ইবাদাত একমাত্র আল্লাহ্‌র (0) সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে শুরু করার পর ‘ইবাদাত করাকালীন মধ্যবর্তী সময়ে যদি লোক দেখানোর (রিয়া’র) ইচ্ছা মনের মধ্যে দেখা দেয় এবং এমতাবস্থায় সে ব্যক্তি যদি লৌকিকতার এ মনোভাব তার অন্তর থেকে দূর করার এবং ‘আমালকে রিয়ামুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রেখে ‘আমাল সম্পন্ন করে, তাহলে তার সেই ‘আমাল বা ‘ইবাদাত বাত্বিল হবে না।

উদাহরণ স্বরূপ যেমন- কোন ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নামায পড়তে শুরু করল। এমতাবস্থায় নামাযের দ্বিতীয় রাক‘আতে তার অন্তরে রিয়া‘র উদ্রেক হলো। সাথে সাথে সে তার অন্তর থেকে এই কুমন্ত্রণা ও কুমনোভাব দূর করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যেয়ে নামায সম্পন্ন করল, তাহলে এই রিয়া তার ‘আমালে কোন প্রভাব ফেলবে না এবং আল্লাহ চাহেতো তার এই নামায বাত্বিল হবে না।

(খ) যদি সে ব্যক্তি তার অন্তরের এই কুমন্ত্রণা দূর করার এবং ‘আমালকে রিয়ামুক্ত করার চেষ্টা না করে, বরং রিয়া তথা লোক দেখানোর উদ্দেশ্য অন্তরে পোষণ করেই ‘আমাল সম্পন্ন করে থাকে, তাহলে তার এই ‘আমাল সম্পূর্ণ বাত্বিল ও বিনষ্ট হয়ে যাবে।

এ সম্পর্কে রাছূল 1 বলেছেন:-

مَنْ صَلَّى يُرَائِي فَقَدْ أَشْرَكَ، وَمَنْ صَامَ يُرَائِي فَقَدْ أَشْرَكَ، وَمَنْ تَصَدَّقَ يُرَائِي فَقَدْ أَشْرَكَ.

অর্থ:- যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ল সে শির্‌ক করল, যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে রোযা পালন করল সে শির্‌ক করল, যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে দান-সাদাক্বাহ করল সে শির্‌ক করল।

৩। আল্লাহ্‌র জন্যে পূর্ণ নিষ্ঠা ও ইখলাসের সাথে কোন ‘আমাল আরম্ভ ও সম্পন্ন করা। তবে ‘আমাল সম্পন্ন হওয়ার পর অন্তরে রিয়া‘র উদ্ভব হওয়া। যেমন- লোকজনের মুখে এ ‘আমাল সম্পর্কে নিজের প্রশংসা শুনে নীরবে আত্মতৃপ্তি ও গর্ববোধ করা। এ জাতীয় রিয়া, সম্পাদিত সেই ‘আমাল ও ‘ইবাদাতে কোনরূপ প্রভাব ফেলে না এবং এর দ্বারা ‘ইবাদাত বাত্বিল বা বিনষ্ট হয় না। কেননা তা ‘ইবাদাত সম্পন্ন তথা সমাপ্ত হওয়ার পর প্রকাশ পেয়েছে।

আল্লাহপাক আমাদের প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার তৌফিক দান করুন, এবং আল্লাহর ও উনার হাবীবের সন্তুষ্ঠি অর্জনের তৌফিক দান করুন, নামে মুসলমান না হয়ে প্রকৃত মুসলমান হওয়ার তৌফিক দান করুন-আমিন

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী এমসি কলেজ, সিলেট।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.