আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

স্বাস্থ্য: গলা ভাঙ্গা অবহেলা করবেন না

১৬ এপ্রিল বিশ্ব কণ্ঠ দিবস

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৪-১৬ ১২:০৮:০৪

ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী :: ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশে বিশ্ব কণ্ঠ দিবস পালিত হয়। সারা বিশ্বে ২০০২ সাল থেকে বিশ্ব কণ্ঠ দিবস পালিত হচ্ছে। আমরা কণ্ঠস্বর সম্পর্কে সচেতন নই। বিশ্ব কণ্ঠ দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, কণ্ঠ ও কণ্ঠনালির সমস্যা এবং সেই সঙ্গে কীভাবে কণ্ঠকে সুস্থ রাখা যায় তা জনগণকে জানানো।

পারস্পরিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলো কণ্ঠ বা কথা বলা। প্রত্যেকেরই নিজস্ব কন্ঠস্বর রয়েছে। কারো গলার স্বর মোটা, ভারী আবার কারো মাঝারী ধরণের কিংবা চিকন। ভিন্নতা লক্ষ করা যায় নারী ও পুরুষের কণ্ঠস্বরে। আমরা কন্ঠস্বর সম্পর্কে খুব একটা সচেতন নই। যাদের জোরে জোরে এবং প্রচুর কথা বলতে হয় তাদের প্রায়ই গলা বসে যায়, কণ্ঠস্বর প্রায় বন্ধ হয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজ বেরোয়। নেতা, মঞ্চ অভিনেতা, গায়ক-গায়িকা, ফেরিওয়ালা এবং এমনকি অনেক সময় শিক্ষকেরাও প্রায়ই এই সমস্যায় ভোগেন।তাই পেশাগতভাবে কন্ঠস্বর ব্যবহারকারীদের শব্দ যন্ত্র এবং Vocal Cord ব্যবহারে যতœবান হতে হবে।

শব্দযন্ত্র (Larynx) এবং কথা বলা :
আমাদের গলার সামনের দিকে শব্দযন্ত্র (Larynx) অবস্থিত। শব্দযন্ত্রে দুটি কন্ঠনালী (Vocal Cord) থাকে। এই নালী দুটির কম্পনের মাধ্যমে শব্দ তৈরী হয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দিনে ১০ লাখ বার কন্ঠনালী দুটির স্পর্শ ঘটে। এই কন্ঠনালী বিপুল ঘর্ষণে জর্জরিত হয়ে আঘাত প্রাপ্ত হলে প্রদাহ ঘটে। অতিরিক্ত জোর প্রয়োগের কারণে স্বরতন্ত্রীতে সমস্যা হলে গলার স্বর ভেঙ্গে যায়। তখন স্বরতন্ত্রী ফুলে যায়, আশপাশে পানি জমে (ইডিমা) এবং কখনো ছোট গোটা বা নডিউলের মতো হতে পারে।
 তাই সুস্থ কন্ঠস্বর দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ।

কন্ঠনালীর সমস্যার লক্ষণ :
কন্ঠনালীর অসুখের লক্ষণ হলো গলা ব্যথা, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন (Hoarseness of Voice); ফ্যাস ফ্যাস শব্দ; কাশি; কিছু গিলতে অসুবিধা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন বা গলা ভাঙ্গা তীব্র হতে পারে আবার দীর্ঘ মেয়াদী হতে পারে। যদি ঘন ঘন কন্ঠস্বরের পরিবর্তন বা গলা ভাঙ্গার সমস্যা হয় অথবা দুই সপ্তাহে ভালো না হয়, তবে নাক-কান-গলা রোগের চিকিৎসক দেখাতে হবে। নাক-কান-গলা রোগের চিকিৎসকরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভোকাল কর্ড বা কন্ঠনালী পর্যবেক্ষন করে থাকেন। পদ্ধতি গুলো হচ্ছে: ইনডাইরেক্ট ল্যারিংগোসকপি, ডাইরেক্ট ল্যারিংগোসকপি, ভিডিও ল্যারিংগোসকপি।

তীব্র কন্ঠনালীর প্রদাহ এবং করণীয় :
তীব্র কন্ঠনালীর প্রদাহের (Acute Laryngitis) প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া।  ভাইরাস প্রদাহে কন্ঠনালী (Vocal Cord) ফুলে গিয়ে কম্পনের সমস্যা সৃষ্টি করে, ফলে স্বর পরিবর্তন হয়। প্রচুর পরিমান পানি পান করলে এবং কন্ঠনালীকে বিশ্রাম দিলে এটা ভালো হয়ে যায়। সাধারণত গলাবসায় এক থেকে দুই সপ্তাহ কণ্ঠস্বরকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দিন। যথাসম্ভব কম কথা বলুন। ফিসফিস করেও কথা বলা যাবেনা বরং এটি আরও ক্ষতি করবে। কারণ তীব্র প্রদাহ অবস্থায় যদি কেউ জোরে কথা বলে তা কন্ঠনালীর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। ব্যাকটেরিয়া জনিত কন্ঠনালীর প্রদাহে এ্যান্টিবায়োটিক এর প্রয়োজন হয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সাথে steroid জাতীয় ঔষধ দিয়ে থাকেন। স্বরনালী বা Vocal Cord  কে বাস্পস্নাত করতে বাস্প প্রবাহ শ্বাসের সঙ্গে টানা যেতে পারে। মেনথল ইনহেলেশন ভোকাল কর্ড কে কিছুটা আদ্রতা দিবে। একটি বাটিতে গরম পানি নিয়ে সেই পানিতে এক চিমটি মেনথলের দানা নিয়ে তারপর বাস্পটুকু শ্বাসের সঙ্গে টেনে নিতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী কন্ঠনালীর প্রদাহ /Chronic Laryngitis:
তীব্র প্রদাহ ঠিকমতো চিকিৎসা না করা হলে, দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ (Chronic Laryngitis) হতে পারে। ধূমপান, অতিরিক্ত গরম পানীয়, খুব গরম চা দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহের জন্য দায়ী। চিকিৎসা সত্ত্বেও যদি কারও অনেকদিন ধরে গলা ভাঙ্গা থাকে, ওজন কমতে থাকে, কাশির সঙ্গে রক্ত গেলে এবং ধুমপানের ইতিহাস থাকলে সাবধান, কেননা তাহলে শব্দযন্ত্রের ক্যান্সার (Carcinoma Larynx) সন্দেহ করা হয়।

কণ্ঠনালির ক্যান্সার:
আমাদের দেশে গলার ক্যান্সার বা কণ্ঠনালির ক্যান্সারের প্রকোপ বেশি।ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপান কণ্ঠনালির ক্যান্সারের অন্যতম কারণ!স্বরের পরিবর্তন ১৫ দিনের মধ্যে ভালো না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। ব্যক্তির রোগের ইতিহাস, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গলার ক্যান্সার বা কণ্ঠনালির ক্যান্সারকে মোটেও অবহেলা করা উচিত নয়। কণ্ঠনালির ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। এ রোগের সব ধরনের চিকিৎসা, যেমন-সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি আমাদের দেশেই রয়েছে।

কন্ঠনালীর অপব্যবহার করবেন না :
জনসমাবেশ / কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে জোরে কথা না বলা। ঘাড় ও কানের মধ্যে ফোন চেপে ধরে কথা বললে ঘাড় ও শব্দযন্ত্রের মাংস পেশিতে টান লাগে। কারণ আমরা যখন কথা বলি, কন্ঠনালীর সঙ্গে আশে-পাশের মাংস পেশীরও সাহায্য লাগে। চিৎকার করে কথা না বলা। জনসমাবেশ বা বড় লেকচার গ্যালারীতে ব্যবহৃত মাইক ছাড়া জোরে কথা বললে কন্ঠনালীর উপর বেশি চাপ পড়ে। গলার স্বরভাঙ্গাকে কখনই অবহেলা করবেন না।

লেখক-
চিকিৎসক,এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার
নাক, কান, গলা বিভাগ
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ
E-mail: drhafiz_33@yahoo.com

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন