Sylhet View 24 PRINT

বাবার জন্যে ভালোবাসা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৬-১৭ ২২:১৭:৩২

মাধ্যমিকে পড়ার সময় একবার ‘প্রিয় ব্যক্তিত্ব’ রচনা লিখতে গিয়ে অনেকটা অবচেতন মনেই বাবাকে নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম যদিও পুরোমাত্রার প্রস্তুতি ছিল ভিন্ন এক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে লেখার। তথাপি পরীক্ষার মহামূল্যবান খাতায় কলম বসানোর ঠিকঠিক প্রাক্কালেই মাথায় চাপল, বাবাই আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব আর তাই বাবাকে নিয়েই লিখব।

বাবা আমার প্রথম শিক্ষক, বাংলা বর্ণমালা আর বর্ণমালার প্রতিটা অক্ষর দিয়ে শব্দ তৈরি করা ইত্যাদি বাবার কাছেই প্রথম শেখা। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় পানে যাত্রাশুরুর অনেক পূর্বেই বিদ্যাশিক্ষার জগতে বাবার হাত ধরেই অনুপ্রবেশ। পড়াশোনা ব্যাপারটা যখন ভয়ংকর কিছু একটা মনে হত, বাবার সাবলীল উপস্থাপনা-বাচন ভঙ্গি-শিক্ষাদান পদ্ধতি-নিখুঁত তদারকি তখন পড়াশোনাকে অনেকটাই সহজ করে তুলেছিল।

সমান অবস্থা আরবী শিক্ষার ক্ষেত্রেও, মক্তবে (মসজিদে) ভর্তির বেশ আগেই আরবি হরফ (বর্ণমালা) পরিচিতি, উচ্চারণ, মুখস্তকরণ ইত্যাদির হাতেখড়ি বাড়িতে বসে বাবার কাছেই। বাড়ির বারান্দায় কিংবা উঠোনে ফুটবলের প্রথম সঙ্গীও বাবা আর সময়ের প্রেক্ষিতে উত্থাপিত বিভিন্ন বায়না বা দাবি মিটিয়ে মুখে হাসি ফুটানো ব্যক্তিটিও বাবা।

তবে, কথায় বলে ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে’, বাবা সোহাগ তো করেনই, তাই শাসন করার ভারটাও তার উপরে অনেকাংশেই বর্তায়। বাবার চোখ রাঙানো দেখেই ঝড়ের আভাস পেতাম আর দুষ্টুমি বেয়াদবিতে রূপান্তরিত হওয়ার পূর্বেই থেমে যেতাম।

তখন মনে হত, বাবার এত রাগ কেন? শাসনের মাত্রা কমিয়ে সারাক্ষণ খেলার সাথী হলেই বা দোষের কি? তবে এখন বুঝি, বাবার ঐ শাসন আর চোখ রাঙানো ছিল বলেই আজ মানুষ হয়েছি। বাবা সর্বাগ্রে কোন কাজ দিয়ে পাঠাতেন এদিক ওদিক, খানিক দূরে কিংবা কাছে। তখন মনে মনে বলতাম, একা আমাকে না পাঠালেই হত, বাড়িভর্তি লোক; সাথে কাউকে দিলেই পারতেন। তবে এখন বুঝি, এভাবে পাঠাতেন বলেই আজ দুনিয়া চষে বেড়াতে পারি নির্দ্বিধায়। পড়াশোনা করছি কিনা, তার জন্যে বাবার খবরদারি দেখে তখন ভাবতাম, এমন কি হয় আরো একটা ঘন্টা খেলতে দিলে বা উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে দিলে। তবে এখন বুঝি, ঐ খবরদারির জন্যেই আজ বিদ্যাশিক্ষার উচ্চপর্যায়ে আরোহন করছি।

বাবা সদাই বলেন, “অবহেলায় কার্য নষ্ট, কুল নষ্ট কুবচনে আর বুদ্ধি নষ্ট নির্ধনে”, এমন অনেক উপদেশমূলক কথার মাঝেই জীবনের অর্থ বুঝিয়ে দেন বাবা।

বাবার বয়স আশি পেরিয়েছে। সনদধারী শিক্ষিত না হলেও বাবার জ্ঞানের স্পৃহা ব্যাপক, অসাধারণ। এখনো শেখার আগ্রহ প্রবল, বাংলা-আরবি কিংবা অন্য যে কোন বিষয়ে বাবা এখনো মনেপ্রাণে সাহিত্যের ছাত্র, পড়েছেন হাজার খানেক গল্প, কবিতা আর উপন্যাসের বই। নিজেও লিখেছিলেন অনেক কবিতা, ছড়া, গজল আর ছোট গল্প। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভীষিকার গর্ভে হারিয়ে গেছে তার সিংহভাগই, বাকিগুলো অাছে সযতনে।

আমরা পাঁচ ভাই, তিন বোন। সবাইকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা আর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করাই বাবার একমাত্র লক্ষ্য ছিল। বাবা সফল হয়েছেন। আমাদের শিক্ষা সনদগুলোই বাবার সম্পদ। তবে বাবা এখনো বলেন, সনদপ্রাপ্তি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা আর স্বীকৃতির নামান্তর, মন থেকে জানা, বুঝা বা শেখাই হলো শিক্ষা আর এটা যে আজীবন ধরে রাখতে পারে, সেই প্রকৃত শিক্ষিত।

আপাদমস্তক ধার্মিক বাবাকে কখনো নামাজ ছাড়তে দেখিনি, একটি দিনও দেখিনি যে দিন বাবা কমপক্ষে ঘন্টাখানেক কোরআন তেলাওয়াত করেননি। নিজ হাতে মসজিদ ঝাড়ু- দিতে বাবাকে কখনো হীণমন্যতায় ভুগতে দেখিনি বরং প্রফুল্লচিত্তে তা করেছেন বছর বছর। এখনো শেষ রাতে মুয়াজ্জিনের আগেই জেগে উঠেন আর সময়মত নামাজ আদায় করেন। বাবাকে নিয়ে গর্ব হয়, গর্ব করার মতই একজন তিনি, নিভৃতচারী।

বাবার থেকে নিয়েছি অনেক, দেয়া হয়নি কিছুই; দেয়া হবেও না কখনো কারণ কিছু সম্পর্কের কোন প্রতিদান হয় না। ও বলাইতো হয়নি, সেদিন পরীক্ষার সময় শেষ হওয়ার ঘন্টা বেজে উঠেছিল কিন্তু বাবাকে নিয়ে লেখা ‘প্রিয় ব্যক্তিত্ব’ রচনার উপসংহারে পৌছুতে পারিনি, আসলে পারবও না কোনদিন।

লেখক : এডভোকেট শাকী শাহ ফরিদী
আইনজীবী, জজ কোর্ট, সিলেট।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.