আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং
মুনজের অাহমদ চৌধুরী :: মৌলভীবাজারের বন্যা নিয়ে লন্ডনের বাংলা টিভি চ্যানেল গুলোতে লাইভ টিভি অাপিলের ভিক্ষাবৃত্তি শুরু হয়েছে। উদ্যোগটির নিহিত চেষ্টা মহৎ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর এখনকার প্রক্রিয়া অার বর্তমান বাস্তবতার সাথে ব্যাক্তিগতভাবে অামি কোনভাবেই একমত নই।
প্রতিটি অনুষ্টানে অামাকে যুক্ত থাকার জন্য অনুরোধ করা হলেও অামার নিজের কাছে মনে হয়েছে, মৌলভীবাজারের বন্যার সাথে দেশের অন্যান্য দুর্যোগ ও অার্ন্তজাতিক সংকটের ফারাক রয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে তো এখানে সারা বছর জুড়ে নানা ইস্যুতে রাতভর টাকা তুলেন চ্যারেটি অাপীলের মাধ্যমে। অামি চ্যারেটি অাপিলের বিরোধীতা করছি না। কিন্তু কমিউনিটির ধর্নাঢ্য নেতারা নেতারা যখন রাতভর টিভিতে বসে সারাদেশের প্রবাসীদের কাছে মৌলভীবাজারের মানুষের জন্য সাহায্য চান,একেবারে বন্যার শুরুতেই... তখন লজ্জা লাগে, মৌলভীবাজারী হিসেবে। মানুষ হিসেবে জন্মমাটির প্রতি প্রতিটি ব্যাক্তির ও তো কিছু দায় থাকে।
কিন্তু, দেশের সবচেয়ে বেশি প্রবাসীবহুল জেলা মৌলভীবাজারের একজন প্রবাসী হিসেবে অামার কাছে মনে হয়েছে অামাদের এখানে নিজেদের কিছু করার রয়েছে। ব্যাক্তিগত দায় থেকে যায়। নিজে এখানকার একটি টিভি চ্যানেলের বার্তা সম্পাদক হিসেবে তিন বছর কাজ করেছি। কিন্তু,গত সাড়ে সাত বছরের প্রবাসী জীবনে কখনো কোন লাইভ টিভি চ্যানেলে চ্যারিটি অাপিলের কোন ধরনের প্রক্রিয়ায় সচেতনভাবে নিজেকে যুক্ত করিনি।
কারন,অন্তত যুক্তরাজ্যে অামরা যারা মৌলভীবাজারের অাছি, তাঁদের সবার এলাকার বন্যার্ততের জন্য অন্তত দু-তিনশ পাউন্ড করে ব্যাক্তিগত সহযোগীতার সামর্থ অাছে। কিন্তু,নিজের সামর্থ থাকার পরও সেটি না করে বন্যার্ত মৌলভীবাজারবাসীর জন্য সদগাহ, লিল্লাহ সংগ্রহ করার যুক্তিগুলি অামার কাছে যুক্তিহীন মনে হয়। অন্তত মৌলভীবাজারের অনেকে এখানে অাছেন, যাদের সামর্থ্য অাছে বছরে কয়েক কোটি টাকা অসচ্ছল মানুষকে সহযোগীতা করবার। অার বন্যার্ত প্রতিবেশীকে সহযোগীতা প্রতিবেশীর হক। প্রতিবেশীর হক অার লিল্লাহ কিন্তু এক জিনিস নয়।
নিজে সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবেশীর হক অাদায় করা উচিত প্রথমে। কিন্তু, তা ব্যক্তিগতভাবে না করে শুরুতেই লিল্লাহ সংগ্রহের যুক্তিগুলি অামার কাছে মনে হয় নিজের সাথে কানামাছি খেলা।
বন্যার পানি কমার পথে। অার মৌলভীবাজারের মানুষ অন্যের লিল্লাহ কেন খাবে? যেখানে প্রতিবেশী সামর্থ্যবান ও প্রতিবেশীর হক বিদ্যমান। দেশে একটি সরকার বিদ্যমান। সে সরকারের দুর্যোগ ও ত্রান মন্ত্রী ও সচিব সোমবার সরেজমিন মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতি দেখে সরকারের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের সর্বচ্চো সহযোগীতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সে প্রতিশ্রুতিতে সন্তুষ্ট অাপনি না হতে ই পারেন। সামর্থ্য থাকলে নিজে উদ্যোগ নিন। তারপরও যদি মনে হয়, পরিস্থিতিতে অারো ত্রান দরকার তখন নিজেরা মিলে এলাকার মানুষের জন্য টাকা তুলে সেটি এলাকায় বন্যার্তদের কাছে পৌছেঁও দিতে পারেন। তাতেও যদি মনে হয় মানুষের অারো সাহায্যের দরকার, যা নিজেদের পক্ষে অসম্ভব বা প্রয়োজনীয় সরকারী সহযোগীতা অাসছে না,তখন শেষ মুহুর্তে হতে পারে টিভিতে চ্যারিটি অাপীল।
কিন্তু বন্যা যে রাতে অাঘাত হানল মৌলভীবাজার শহরে, পরদিনই টিভিতে বসে চ্যারেটি অাপীল করে লিল্লাহ সংগ্রহ কেন যে অপরিহার্য হয়ে উঠে, অামি বুঝি না। দুদিনে অামার জনপদের বহু তরুনরা, প্রবীনরা নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু নিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাড়িয়েছেন।
মৌলভীবাজারের সন্তান হিসেবে, মৌলভীবাজার অামাকে শিখিয়েছে, এ জেলার মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি ঘৃনা করে। এ জনপদের মানুষ অাত্মমর্যাদা নিয়ে বাচঁবার জন্য নিজের সবটুকু বাজি রাখতে পারে।
পুনশ্চঃ অনেকে হয়ত প্রশ্ন তুলবেন, মৌলভীবাজারের বন্যা,মানুষ বানভাসী- এ পরিস্থিতিতে অামি কি করেছি? অামি অার্থিকভাবে বিত্তবান নই সেটা সবার জানা। তারপরও অামার অগ্রজ সাংবাদিক অাহমদ বখত চৌধুরী রতন ও অামি মিলে সোমবার এক ট্রাক অতি সামান্য ত্রান অনুজ সাংবাদিকদের মাধ্যমে পৌছেঁ দিয়েছি। মৌলভীবাজারের অনুজ সংবাদ ও সমাজকর্মী এমদাদ,অারিফ,মুবিন, বদরুল, সোহেল, মোজাহিদ, তানজিম, তানিম, ফাহিম, সপ্নিল, মিঠুন প্রমুখ তা পৌছেঁ দিয়েছেন। অার কোনভাবেই এটা সাহায্য নয়,এটা অামার প্রতিবেশীর পাওনা হক। মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে মানুষের ক্ষমতা নেই মানুষকে সাহায্য করার। বন্যার্তদের সাহায্যের মালিক করুনাময়।
পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ও ত্রানের প্রয়োজন থাকা পর্যন্ত এ ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। প্রয়োজনে, কিছুদিন নিজের খরচ কাট-ছাট করবো। যা করবো অামি ও রতন ভাই দুজনের পকেট থেকে করবো। (নিজেদের অতি ক্ষুদ্র চেষ্টার বিষয়টি বাস্তবতার প্রয়োজনে উল্লেখ করতে হওয়ায় ক্ষমাপ্রার্থী, লজ্জিত।)
পাদটীকা-অাপনার সামর্থ্য বা ইচ্ছা না থাকতেই পারে। সেটা অাপনার ব্যাক্তিগত বিষয়। কিন্তু, মৌলভীবাজারের মানুষের নাম দিয়ে বন্যার প্রথম রাতেই ভিক্ষা তোলবার সমাজসেবার দায়িত্ব কেউ কি কাউকে দিয়েছে? কে দিয়েছে দায়ভার অাপনাকে ভিক্ষাবৃত্তির সমাজসেবার ? ভিক্ষা করে অার যাই হোক,সমাজসেবা হয় না। ফটোরাজনীতি হয়।
খারাপ লাগে,অামার-অামাদের গায় লাগে। কারন, বাড়ী মৌলভীবাজার। ব্রিটেনে এখন মৌলভীবাজারীর চতুর্থ প্রজন্ম চলছে। এ কমিউনিটির জন্ম মৌলভীবাজারীর হাতে,শত বছর অাগে। মৌলভীবাজার এখনো সারাদেশের মধ্যে অন্যতম একটি সচ্ছল মানুষবহুল শহর। সে শহরে বন্যার প্রথম দিন অামাদের কিছু লোকই কি-না টিভিতে জেলাবাসীর নামে মুষ্টিবদ্ধ ভিক্ষা তোলেন। তাও ব্রিটেনের মতো দেশে।
খুব লাগে, ভেতরে বাজে, কষ্ট লাগে।
বন্যার প্রথম রাতে চ্যারিটির নামে লিল্লাহ তোলবার মতো কি এতটাই অক্ষম অামরা ? প্রথম দিনটাও মৌলভীবাজারের অন্তত প্রবাসীরাও পাশে দাড়াতে পারলাম না নিজ এলাকার মানুষের। অন্য এলাকার মানুষের সাহায্য চাইতে টিভিতে লিল্লাহ সংগ্রহে বসতে হয় মৌলভীবাজারের বিলিয়নিয়ার ( ! ) ব্যবসায়ীদের।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক