আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং

কঠিন পরীক্ষায় সিলেট আওয়ামী লীগ ও বদরউদ্দিন কামরান

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৬-২৫ ০১:৪০:০০

সুজাত মনসুর :: বদরউদ্দিন আহমদ কামরান আবারও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন। শুক্রবার, ২২শে জুন গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিষয়ক পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়া একইদিন রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও প্রার্থীতা চুড়ান্ত করা হয়। রাজশাহীতে জাতীয় চারনেতার অন‍্যতম শহীদ কামরুজ্জামানের ছেলে, সাবেক মেয়র, গত নির্বাচনে পরাজিত খায়রুজ্জামান লিটন এবং বরিশালে যিনি প্রার্থী হয়েছেন তিনি বরিশালের ঐতিহাসিক সেরনিয়াত পরিবারের সন্তান সাদেক আব্দুল্লাহ সেরনিয়াবাত। এই তিনজনই মনোনয়ন পাবেন তা অনেক আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, শুক্রবার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হল মাত্র।

যে তিন প্রার্থী নৌকা নিয়ে লড়াই করার সুযোগ পেলেন তাদের মধ্যে কামরান ও লিটন আগে মেয়র ছিলেন, আবার গত নির্বাচনেও হেরেছেন। জনাব সেরনিয়াবাত নতুন হলেও, রাজনীতিতে নতুন নন। বলা যায়, বাংলাদেশের যে ক'টি পরিবার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত, তাদের পরিবার অন‍্যতম। অবশ‍্য এর বিশেষ কারণ রয়েছে, যা ব‍্যাখ‍্যা করার দরকার নেই। জনাব কামরান ও জনাব লিটনের গত নির্বাচনে পরাজয়ের বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন‍্যতম কারন ছিল দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এছাড়া রাজশাহীতে আরেকটি বিষয় নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ভুমিকা রাখে, তাহলো স্থানীয় সাংসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার ইমেজ ও ভোট ব‍্যাংক। কিন্তু এবার রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ আগের চেয়ে ঐক‍্যবদ্ধ। যার প্রমাণ তারা দিয়েছে এককভাবে খায়রুজ্জামান লিটনকে প্রার্থী হিসেবে বাছাই করে। এরফলে নির্বাচনে বিজয়ী হবার শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া গেলেও একটি ইতিবাচক প্রভাব যে পড়বে তা নিশ্চিত করেই বলা যায় ‌। সিলেট বা বরিশালে কিন্তু একক প্রার্থী বাছাই সম্ভব হয়নি। সিলেট থেকে দলীয়ভাবে ৫জনের নাম মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার জন্য ঠিক করা হলেও শেষ পর্যন্ত চারজন ও একজন ব‍্যবসায়ী কাম ক্রীড়া সংগঠক মনোনয়ন পত্র জমা দেন। অন‍্যতম মেয়র প্রার্থী আজাদুর রহমান আজাদ শেষ পর্যন্ত জমা দেননি। বরিশাল থেকেও ৫জন দলীয় মনোনয়নের জন্য ফরম জমা দেন। বিষয়টি তেমন গুরুত্ববহ না হলেও রাজশাহীর মত একক প্রার্থী বাছাই করতে পারলে আমরা অন্তত একথা বলতে পারতাম আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে ঐক‍্যবদ্ধ। গুরুত্ববহ নয় বলছি এ কারণে যে, নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে ঐক‍্যের আসল ইমানী পরীক্ষা হবে আগামী ৩০শে জুলাই।

সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে খুবই সিরিয়াস ছিলেন তিনজন। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, আসাদ উদ্দিন ও আজাদুর রহমান আজাদ। যদিও আজাদ শেষ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেননি। বাকি দুজন ফয়জুল আনোয়ার ও জাকির হোসেন সিরিয়াস প্রার্থী ছিলেন বলে মনে হয় না। অন্ততঃ জাকির হোসেনের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলতে পারি। পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন নামটি প্রার্থী তালিকায় দেখি তখনই ফোন করে হঠাৎ করে তাঁর প্রার্থী হবার বিষয়টি জানতে চাই ‌। জাকিরের বিষয়ে আমার আগ্রহের কারণ হলো, আমি সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে থেকেই আমাদের চিন্তা-চেতনায় অনেক মিল এবং এখনো সেই মেলবন্ধন অটুট রয়েছে। ফলে আমরা আদর্শিক কর্মী তৈরিতে বেশ কয়েকটি প্রজেক্টে একসাথে কাজ করছি। জাকির আমাকে বলেছে, সে শুরু থেকেই কেন্দ্রের কাছে একজন প্রার্থীর নাম পাঠানোর পক্ষে ছিল। এমনকি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ যখন কেবলমাত্র মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম পাঠানোর প্রস্তাব করেন তখনো সমর্থন করে। কিন্তু বাকিরা নাম প্রত্যাহার না করায় মহানগর আওয়ামী লীগের অন‍্যান‍্যরা তাঁর নামটিও প্রার্থী তালিকায় রাখার দাবি জানান।

যাইহোক, যা হবার কথা ছিল তাই হয়েছে, বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের কাঁধেই দলীয় হাইকমান্ড হারানো মুকুট ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করার গুরুত্ব দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। বিষয়টি একাধারে কঠিন আবার সহজও। কঠিন এ কারণে যে, গত নির্বাচনের মতো এবারও নেতাকর্মীদের মধ্যে যদি. ‘আমরা এমনিতেই জিতে যাবো‘ এই রিল্যাক্স ভাব বিরাজমান থাকে এবং উপদলীয় কোন্দলে বহুধা বিভক্ত ভাই-দাদাদের স্নেহধন্য ও ভক্ত নেতাকর্মীরা যদি ভাই-দাদাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়। আরেকটি বিষয় এ নির্বাচনে নৌকার বিজয়ের ক্ষেত্রে কঠিনতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে তাহলো জনাব কামরানের ইমেজ যা ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে তাঁর বিজয়ী হবার অন‍্যতম কারণ ছিল, আবার গত নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ স্বাধীনতা উত্তর প্রথম পৌরসভা নির্বাচনে কমিশনার নির্বাচিত হবার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বদরউদ্দিন আহমদ কামরান যে একটি ভালো ইমেজ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, অনেকেরই মতে তিনি তা ধরে রাখতে পারেননি। যার অন্যতম কারণ হলো অতিমাত্রায় ভোটের রাজনীতির কারণে আদর্শহীন আপোষকামিতা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এখনো তিনি সেই ইমেজ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তারপরও দলীয় হাইকমান্ড বদরউদ্দিন কামরানকে বেছে নিয়েছেন সিলেট-১ এর মতো অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সেনসেটিভ আসন নিয়ে গঠিত সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদটি পুনরুদ্ধারের জন্য। যার ফলাফল আগামী সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনের ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কেননা, এই মুহূর্তে ভোটের ময়দানে জনাব কামরানের বিকল্প তৈরি হয়নি।

যতই কঠিন হোক দলীয় হাইকমান্ড ও হাজারো নেতাকর্মীর নৌকাকে বিজয়ী করার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করাও সম্ভব। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন উপদলীয় কোন্দল নিরসন করে দায়িত্বশীল নেতাদের সত‍্যিকারের ইমানী ঐক‍্য। এছাড়া প্রার্থীর নিজের হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধার। যদিও বিষয়টি এত সহজ নয়। কিন্তু চেষ্টা করলে পুরোপুরি না হলেও, অনেকটাই সম্ভব। আর নেতাদের ঐক‍্যের বিষয়টি নির্ভর করবে তাদের মানসিকতা ও নিজস্ব এজেন্ডা দলীয় স্বার্থে কতটুকু ছাড় দিতে পারবেন। আরেকটি বিষয় সক্রিয় বিবেচনায় নেয়া দরকার বিশেষ করে জেলা ও মহানগর নেতৃবৃন্দের, দলীয় হাইকমান্ড এবার সামান্যতম গাফিলতিও ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন না, বিশেষ করে সিলেটের ক্ষেত্রে। অনেকে হয়তো গোয়েন্দা নজরদারিতেও থাকতে পারেন।
সুতরাং এবারের সিটি নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে অনেকেরই আগামীতে রাজনৈতিক ভাগ‍্য নির্ধারিত হবে। কোনো কারণে যদি নির্বাচনে নৌকা পরাজিত হয়, তাহলে শুধু বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের রাজনৈতিক ভাগ‍্য বিপর্যয় ঘটবে না। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের অনেক দায়িত্বশীল নেতারই ভাগ‍্য বিপর্যয় ঘটতে পারে।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক, কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন