আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মুছে গেছে সব রঙ, ধূসর রাশিয়া

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৭-০৮ ২৩:০২:৫৭

আমিনুল ইসলাম রোকন :: প্রখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী ছিলেন না। জীবনের বড় একটি অংশ নাস্তিক ভাবেই কাটিয়েছেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন বদলে গেলেন সারাবিশ্বে জনপ্রিয় এই রম্য লেখক। আমিরেকার আরিজোনা অঙ্গরাজ্যের বিখ্যাত গিরিখাত গ্রান্ড ক্যানিয়ন দেখতে গেছেন তিনি। অপরূপ গ্রান্ড ক্যানিয়ন সারাবিশ্বের পর্যটকদের তীর্থস্থান। এক মাইল গভীর গিরিখাত পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের তথ্য গ্যান্ড ক্যানিয়ন এমন এক স্থান যেখানে হ্যালিকপ্টার আকাশে না উড়ে নীচের দিকে নামে।

নয়নাবিরাম এই গ্যান্ড ক্যানিয়ন দেখেই মনের অজান্তে মার্ক টোয়েন বলে উঠেন-হায় ইশ্বর “এমন সুন্দর কিভাবে তুমি সৃষ্টি করতে পারো”। মুহূর্তেই টোয়েন আবিস্কার করে ফেলেন তাঁর হৃদয়ে ইশ্বরের অস্তিত্ব। ফিরেই তিনি ঘোষণা দেন- ঘোর নাস্তিকও যদি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যায় তাহলে সেও ইশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে উঠবে।

বিশ্বকাপ নিয়ে লিখতে বসে এই গল্প কেন-বুদ্ধিমানরা হয়তো ধরে নিয়েছেন নিশ্চয়ই। এ প্রশ্নের উত্তর অরেকটু পরিস্কার করতে প্রথমে  তাকাতে হবে বেলজিয়াম-জাপান ম্যাচে। এর পরই ব্রাজিল-বেলজিয়াম। এই দুই ম্যাচ যারা দেখেছেন মার্ক টোয়েনের মতো তারাও হয়তো মত পাল্টে ফেলেছেন। ওসব ভাগ্যটাগ্য বলে কিছু নেই-এমন ভাষন দিয়ে এতদিন যারা নিজেকেই ইশ্বর ভাবতেন তারা এখন হয়তো বলতে বাধ্য হবেন-ইশ্বরই সব। জীবনের অনেক রঙ বদলে দেয় ভাগ্যও।

জাপানের সাথে বেলজিয়ামের ম্যাচটাই দেখুননা। প্রথমার্ধে কে ভেবেছিলো জাপানকে বিদায় করে দেবে ২ গোল খেয়ে বসা বেলজিয়াম। কিন্তু সব ওলট পালট করে দিলো ভাগ্য। ভাগ্য এ জন্য বললাম-মধ্য বিরতির পর জাপানের জালে যেভাবে বেলজিয়ামের গোল ডুকেছে তা দেখে খুদ ফুটবল বুদ্ধারাও বলছেন ‘জাপানের বাক্সে বেলজিয়ামের গোল গুলো ছিলো ইশ্বরের উপহার’। ৩ জুলাই এই ম্যাচের গল্প এক নিদারুণ ইতিহাস হয়েই থাকবে। ঠিক যেন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ফুটবল ভার্সনই বলা চলে। হিরোসীমা-নাগাসাকির যে ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে জাপানের মানুষ-ঠিক তেমনি বেলজিয়ামের সাথে শেষের কয়েক সেকেন্ডে হেরে যাওয়াটাও অনেকদিন পুড়াবে তাদের, এমনকি এশিয়াকেও। ঠিক পরের ম্যাচ ব্রাজিলের সাথেও একই রঙ্গে বেলজিয়াম। ঠিক যে দৃশ্যকে বলা হয় ইশ্বরের আশির্বাদ তাই যেন করে দেখালো তারা। “বেলজিয়াম”এ আর কেমন দল। ব্রাজিলের সাথে ওরা কি খেলবে-এমন তাচ্ছিল্য ভাষায় খেলার আগমুহূর্তে যারা নাকে তেল দিয়ে নেইমারদের হাতে বিশ্বকাপ তুলে দেয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন, হৃদয়ে হলুদ রঙ মেখে যারা সাম্বার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তারা টের পেয়ে গেছেন ‘ভাগ্য বলে একটা ব্যাপার আছে’। আর তা সহায় হলে হাতে থাকা রুমালও জ্যান্ত কবুতর হয়ে যায় নিমিষেই।

শুধু কি ভাগ্য? দুর্ভাগ্যও কি এভার রাশিয়ায় শেষ করে দেয়নি সব। এবার বিশ্বকাপের সব উজ্জল রঙ-ই তো বেদনায় ধুসর করে দিয়েছে দুর্ভাগ্য। আকাশী, নীল, হলুদ, লাল- রংধনুর সব রঙ-ই তো এবার ভ্যানিস।

রাশিয়া বিশ্বকাপ ঘিরে সব বিষাদ যেন ধারণ করে আছে পুরো বিশ্ব। লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা, নেইমার-ব্রাজিল, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল, সুন্দর ফুটবলের স্পেন, চ্যাম্পিয়ন জার্মানি কউ নেই। আর কেউ নেই মানেই কিছুই নেই। ভাবতেও অবিশ্বাসের মতো লাগে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি কিংবা ইতালি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নেই । যা কিনা ইতিহাসে এই  এই প্রথম। ইতালি তো এবার চূড়ান্ত পর্বেই উঠতে পারেনি। এই ইতালিকে দিয়েই অঘটন রেখা উদয় হয়েছিলো বিশ্বকাপ  শুরুর আগেই। সেই অঘটনই এবার বিষাদ ছড়ালো। কাজান নামের মৃত্যুপুরী শোকে বিহব্বল করে দিলো উন্মাদনার বাংলাদেশকেও। দু দলে বিবক্ত বাংলাদেশ। ঘর কিংবা অফিস, হাট,ঘাট, মাঠ সবখানে বাক যুদ্ধ। কেউ অর্জেন্টিনা কেউ ব্রাজিল। ঘরে ঘরে চালে উড়ছে প্রিয় দলের পতকা। গায়ে মেসি কিংবা নেইমারের জার্সি। আজ আর্জেন্টিনা জিতে গেছে তো ‘নিস্তব্ধ রাত জেগে উঠেছে উৎসবের উপলক্ষ হয়ে’। হেরে গেছে তো খুঁচাখুচির শুরু। ব্রাজিলিয়ানদের সামনে পড়লেই কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগায়-এই অবস্থা। আবার ব্রাজিল হেরে গেলে-‘কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কবু আশিবিষে-ধ্বংশেনি যারে’ ব্রাজিলিয়ানদের  কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ওই কবিতাই যেন মনে করিয়ে দেয় আর্জেন্টাইনরা। এ সবই ছিলো উৎসবের উপলক্ষই। কিন্তু এখন সবই বিষাদ। বাংলাদেশে বিশ্বকাপ শেষ বলেলেই চলে। যেখানে সব উন্মাদনা ছিলো আকাশী সাদা আর হলুদ রঙকে ঘিরে। আর হবেই বা না কেন? লিওনেল মেসি কিংবা নেইমার জুনিয়র-এরা তো বাঙালীর উন্মাদনারই প্রতিচ্ছবি। বর্তমান পৃথিবীর সেরা খেলোয়াড় তারা। সেই মেসি নেইমাররা বিশ্বকাপে নেই।

আর্জেন্টিনা সবসময়ই বাংলাদেশের দর্শকদের উন্মাদনার বড় ক্ষেত্র। কিন্তু এবার মূল থেকে বলা হয়েছিলো দলটি বড্ড মেসি কেন্দ্রিক। শুধু লিওনেল মেসির জন্য এবার বিশ্বকাপে অনেকে ফেবারিট ছিলো  আর্জেন্টিনা। কিন্তু দলটির কোচ হোর্হে সাম্পাওলি শিষ্যদের গুছিয়ে নিতে পারেননি। বিশ্বকাপের আগে ১১ ও বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচসহ মোট ১৫ ম্যাচে আর্জেন্টিনার এই কোচ নিজের পছন্দের একাদশ ঠিক করতে পারেননি। প্রতি ম্যাচেই মাঠে নামিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন একাদশ। পাওলো দিবালার মতো খেলোয়াড়কে সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছেন সাম্পাওলি। মেসিনির্ভর দল বানানোর ভুলে তিনিও পা দিয়েছেন। গোলপোস্টের নিচে সার্জিও রোমেরোর অনুপস্থিতিও টের পেয়েছে আর্জেন্টিনা। গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তোলা কোচ আলেজান্দ্রো সাবেলা রক্ষণকে দিয়েছিলেন বিশেষ গুরুত্ব। আর এবার সাম্পাওলির আর্জেন্টিনা ৪ ম্যাচে ৯ গোল হজম করেছে। এরপর আর আশা থাকে! একজন কোচ একটি দলকে টেনেও তুলতে পারেন, ডোবাতেও পারেন। আর্জেন্টিনা সমর্থকদের চেয়ে এ কথা আর কে ভালো জানে!  আর তাই শুধু এক খেলোয়ার দিয়ে বিশ্বকাপ নেয়া যায়না-আর্জেন্টিনাকে এমন ভবিষ্যৎ দিয়ে রেখিছিলেন ফুটবল বুদ্ধারা।

কিন্তু ব্রাজিল? ব্রাজিল বরাবরের মতো এবারও ফেবারিট ছিল। বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন, নেইমার-কুতিনহোরা এবার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবেন। কিন্তু শেষ আটের লড়াইয়ে তাঁদের ছিটকে ফেলেছে বেলজিয়াম। হ্যাজার্ড, ব্রুইনারা যেভাবে খেলেছেন, তাতে সবাই মুগ্ধ। গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়ার বীরত্বও মনে রাখার মতো। তবু ব্রাজিল পারল না কেন—এই প্রশ্নটা এসেই যায়। বেলজিয়ামের সঙ্গে কাসেমিরোর অভাব হারে হারে টের পেয়েছে ব্রাজিল। তাঁর বিকল্প যে ফার্নান্দিনহো হতে পারে না, সেটা বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যাচেই প্রমাণিত। বিশ্বকাপের ঠিক আগমুহূর্তে চোটের কারণে দানি আলভেজের ছিটকে পড়াও বড় ধাক্কা ব্রাজিলের জন্য। দানিলো কিংবা ফ্যাগনার ব্যর্থ হয়েছেন আলভেজের অনুপস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাতে। অনেকে অবশ্য আলভেজের বিকল্প হিসেবে ফ্যাবিনহোর অন্তর্ভুক্তির আশা করছিলেন। ব্রাজিল দলে সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গা মধ্যমাঠ। তবে পাওলিনহোর সঙ্গে কাসেমিরো রসায়ন কাজে দিয়েছে বেশ। কিন্তু কাসেমিরোর নিষেধাজ্ঞার সুযোগটা খুব ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে রবার্তো মার্তিনেজের শিষ্যরা। হ্যাজার্ড আর লুকাকুকে দুদিকে খেলিয়ে মধ্যমাঠ নিজের দখলে রেখেছিলেন ডি ব্রুইনা একাই। আর তাতেই বিদায় ‘সেলেসাও’দের।

বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানির বিদায় এবার সবচেয়ে বড় অঘটন। দলের খেলোয়াড়দের প্রতি বেশি সৎ থাকতে গিয়ে একাদশ নির্বাচনে ভুলের খেসারত দিয়েছেন জার্মান কোচ জোয়াকিম লো। মেক্সিকোর বিপক্ষে মনে হয়েছে, জার্মান দলটা বুড়ো হয়ে গেছে। খেদিরা-ওজিলের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বিশ্বাস, বোয়েটেংদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ জার্মানির বিদায় নিশ্চিত করে।

ছোট দলগুলো বেশ কিছু বিষয় বুঝে বড় দলগুলোর ভুলের সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমন দলের ব্যাপারে প্রস্তুতিটা তারা আগেই সেরে রেখেছিল। আর কার কোথায় দুর্বলতা, সেটাও খুঁজে খুঁজে বের করেছে। বড় দলগুলো ধরেই নিয়েছিল, তাদের কোনো না কোনো তারকা জিতিয়ে মাঠ ছাড়বে, কিন্তু সে রকম কিছু আর ঘটেনি। অন্যদিকে ছোট দলগুলো খেলেছে কৌশল ঠিক করে। বড় দলগুলোর বিদায় নেওয়ার অন্যতম কারণ, প্রতিপক্ষ ফন্দি এঁটে মাঠে নামছে তা উপলব্ধি করতে না পারা।
সব মিলিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগেছে বড় দলগুলো। এই দুর্বলতা সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছে ছোট দলগুলো। তাতে কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে ‘ছোট দল’ ধারণাটার বিলুপ্তি ঘটেছে। কারণ, তথাকথিত বড় দলগুলো তো সব ছিটকে পড়েছে। আর এতে ভ্যানিস হয়ে গেছে সব। চার দিকে এখন কেবলই শুণ্যতা। আগামী চার বছর এই শুণ্যতার অতল গহব্বরে ডুবে থাকতে হবে ফুটবল পাগলদের। আর নতুন রঙের অপেক্ষায় থাকতে হবে ২০২২ কাতারকে ঘিরে।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন