আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

হযরত শাহজালাল (রহ)-এর লাকড়ি ভাঙ্গা উৎসব

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৭-১২ ২৩:৪৩:১৫

আলী ফজল মোহাম্মদ কাওছার :: শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও আভিজাত্যের গৌরব ধ্বংসের শিক্ষা নিয়ে প্রায় সাত’শ বছর ধরে সিলেটে এ উৎসব উদযাপন করা হয়।

সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রহ)-এর স্মৃতি বিজড়িত এ উৎসব হিজরী বর্ষের ২৬ শে শাওয়াল পালন করা হয়। এ উৎসব উপলক্ষ্যে দরগা-ই-হযরত শাজালাল প্রাঙ্গন থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে হাজার হাজার শাহজালাল ভক্তের বর্ণাঢ্য মিছিল লাক্কাতোড়া চা বাগানের নির্দিষ্ট পাহাড়ের দিকে ছুটে যায়। সেখান থেকে সংগ্রহ করা হয় লাকড়ি।
সেই লাকড়ি কাঁধে নিয়ে পুনরায় মিছিল দরগা প্রাঙ্গনে ফিরে আসে। যা এ উৎসবের ২১ দিন পর অনুষ্ঠিতব্য হযরত শাহজালাল (রহ)-এর বার্ষিক উরশ শরীফের শিন্নী রান্নায় ব্যাবহার করা হয়। প্রায় সাত শ বছর ধরে চিরাচরিত প্রথায় এ উৎসব পালন হয়ে আসছে।

এই মিছিল ছুটে চলে হযরত শাহজালাল (রঃহঃ) এর ঐতিহ্যবাহী লাকড়ি তোড়া বা লাকড়ি ভাঙ্গার উৎসবে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া এ মিছিলের শুরু যখন গন্তব্যে পৌঁছে তখনো এর শেষ অংশ থাকে দরগা প্রাঙ্গনে। কোনো প্রচার-প্রচারণা ছাড়া প্রতি বছর বিশ থেকে ত্রিশ হাজার মানুষের জমায়েত হয়। পুণ্য লাভের মূলা ঝোলানো মাইকিং নেই, উদ্ভোধক নেই, প্রধান অতিথি নেই, এক মুষ্টি ডাল-চালের খিচুরী ছাড়া পেট চুক্তি কোনো খাবারও নেই; তবুও প্রতি বছর এই জনপদের সব চাইতে প্রাচীন ‘লৌকিক ও অসাম্প্রদায়িক’ এ লাকড়ি তোড়ার (ভাঙ্গার) মেলা’ বা ‘লাক্কাতোড়ার উরস’ উদযাপিত হয়ে আসছে চিরাচরিত প্রথায়।

এ উৎসব হঠাৎ করে শুরু হয়নি। প্রাচীন এই উৎসবের সাথে জড়িয়ে আছে সুলতানুল বাঙাল হজরত শাহ্জালাল (র.হ.)-এর স্মৃতি। প্রায় সাতশত বছর ধরে হিজরি বছরের ২৬ শাওয়াল এই ‘লাক্কাতোড়ার মেলা’ বা ‘লাকড়ি ভাঙ্গার উরস’ উদযাপিত হয়ে আসছে। এই দিনটি হলো হজরত শাহজালাল (র.হ.) কর্তৃক সিলেট বিজয়ের দিন। ৭০৩ হিজরী’র ২৬শে শাওয়াল অত্যাচারী রাজা গৌড়গোবিন্দকে পরাজিত করে প্রাচিন শ্রীহট্র নগরী সুফি সাধক হযরত শাজালাল (রহ)-এর হাতে বিজিত হয়। তাই এদিন ‘শ্রীহট্ট বিজয় দিবস’ নামেও পালিত হয়। আবার এ দিনেই ৭২৫ হিজরীতেঁ হযরতের মামা ও মুর্শিদ হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহঃ)-এর ওফাত হয়।

পিতৃ-মাতৃহীন হযরত শাহজালাল (রহঃ) শৈশবকাল মামা হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহঃ)-এর কাছে লালিতপালিত হয়েছিলেন। তিনি ভাগনেকে শুধু লালন-পালনই করেননি আধ্যাত্মিক শিক্ষায়ও শিক্ষিত করেন। কামালিয়াতের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় তিনি ভাগনেকে ইসলামের দাওয়াতে নিয়োজিত করেন। মক্কা শরিফের এক মুঠো মাটি দিয়ে বলেন এই মাটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানেই তাঁর দাওয়াতি মিশন সমাপ্ত করতে। হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহঃ) ছিলেন জগত বিখ্যাত সুফিসাধক হযরত জালালুদ্দিন সুররুখ বুখারী (রহঃ) এর পুত্র ও হযরত মাখদুম জালালুদ্দিন জাহানিয়ান জাহানগাস্ত বুখারী (রহঃ)-এর পিতা। ২৬ শাওয়াল হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহঃ) পাঞ্জাব প্রদেশের ভাওয়াল জেলার উচ নগরীতে ইন্তেকাল করেন। তাই এইদিনটি শাহজালাল (রহঃ) এর মুর্শিদের পবিত্র উরস শরীফ হিসাবেও উদযাপন করা হয়।

লাকড়ি ভাঙ্গা উৎসবের সম্পর্কে যে কিংবদন্তী প্রচলিত আছে তা হজরত শাহ্জালাল (রহ.) এর সাথে ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্কিত। রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করার পর হজরত শাহ্জালাল (রহ.) তাঁর সঙ্গী সাথিদের এই অঞ্চলের নানা প্রান্তে ইসলাম প্রচারে প্রেরন করলেন। তাঁর সঙ্গীদের তিনি ছিলেন নেতা বা মুর্শিদ। তাই প্রতি বছর সিলেট বিজয়ের এই দিনে সঙ্গীও আউলিয়াগন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসতেন মুর্শিদের কাছে। মুর্শিদের সান্ন্যিদ্ধে এসে সিলেট বিজয়ের এই গৌরবের জন্য আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জানাতেন। সিলেট বিজয়ের পর প্রায় প্রতি বছর এ বিজয় দিবস মহাসমারোহে উদযাপিত হতো। নানা অঞ্চল থেকে আউলিয়ারা আসতেন হযরত শাহজালালের (রহঃ) এর দরবারে। এরূপ এক বছর বিজয় দিবস উদযাপনের কিছুদিন পূর্বে হযরতের কাছে এক নও-মুসলিম কাঠুরে এক ফরিয়াদ নিয়ে এলো। কাঠুরের ফরিয়াদ হল- তাঁর বিবাহযোগ্যা ৫ মেয়ে আছে। কিন্তু সে অত্যন্ত দরিদ্র ও নিচু জাতের মানুষ বলে মেয়েদের জন্য কোনও বিবাহ আলাপ আসেনা। কাঠুরে হযরতের কাছে এ দুর্ভাবনার প্রতিকার চান। হযরত কাঠুরের ফরিয়াদে অত্যন্ত বেদনাহত হলেন। তিনি কাঠুরেকে কিছুদিন পরে ‘সিলেট বিজয়ের দিন’ এর প্রতিকার করবেন বলে আশস্থ করলেন।

সিলেট বিজয়ের দিন বরাবরের মতো সবাই সমবেত হলে সঙ্গীগণসহ হযরত শাহজালালের (রহঃ) জোহরের নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে তিনি কুড়াল হাতে করে পাহাড়-টিলা ব্যষ্টিতো (বর্তমান লাক্কাতোড়া চা বাগানের নির্ধারিত টিলা) উত্তর প্রান্তের গভীর জঙ্গলের দিকে যেতে থাকলেন। সঙ্গিরা তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। এক জায়গায় এসে তিনি নিজ হাতে লাকড়ি সংগ্রহ করতে লাগলেন। মুর্শিদের অনুশরন করতে থাকলেন শিস্যরা। প্রত্যেকেই সংগ্রহ করলেন লাকড়ি। লাকড়ি সংগ্রহের পর হযরত মোরাকাবায় (ধ্যান) বসলেন। মোরাকাবা শেষে হযরত শাহজালালের (রহঃ) উপস্থিত সবাইকে অশ্রুসিক্ত নয়নে জানান কিছু সময় পূর্বে ‘উচ শরিফে’ তাঁর মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (রহঃ)-এর ওফাত হওয়ার কথা। তিনি সমবেতদের নিয়ে স্বীয় মুর্শিদের জন্য ফাতেহা পাঠ করেন। এরপর লাকড়ি কাধে করে নিয়ে সঙ্গিদেরসহ ফিরে আসেন নিজ আস্তানায়। লাকড়ি এক জায়গায় স্তূপ করে রেখে দেয়া হয়। এরপর সমবেতদের নিয়ে আসর নামাজ আদায় করেন।

নামাজ শেষে তিনি সঙ্গিদের কাছে জানতে চাইলেন, আজ আমরা কি কাজ করেছি ? উপস্থিতরা বলেন, হযরত আমরা আজ লাকড়ি ভেঙ্গেছি। তিনি তখন বলেন যারা লাকড়ি ভাঙ্গে তারা যদি কাঠুরে হয় তবে আজ থেকে আমরাও কাঠুরে কারন আজ আমরাও লাকড়ি ভেঙ্গেছি। এরপর তিনি সমবেতদের কাছে ইসলামের সাম্যের বানী ও শ্রমের মর্যাদার কথা তুলে ধরেন ও গরিব কাঠুরের ফরিয়াদের কথা জানান। তখন সমবেতদের মধ্য থেকে অনেকেই কাঠুরের কন্যাদের বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কাঠুরে এবার আগ্রহিদের মধ্য থেকে উপযুক্ত পাত্র বাছাই করেন। এই বিজয় উৎসব পালনের ২১ দিন পর হজরত শাহজালাল (রহ.) এর ওফাত হয়। মুর্শিদের দেহান্তরের সংবাদে দূরদূরান্ত থেকে মুরিদ ও ভক্তরা সমবেত হতে থাকলেন। এই সমবেত মানুষের খাবার রান্নায় এই লাকড়ি ব্যবহার করা হয়। এই স্মৃতির ধারাবাহিকতায় শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও আভিজাত্যের গৌরব ধ্বংস করার জন্য এই ‘লাকড়িতোড়ার প্রথা’ পালন করে যাওয়া অব্যাহত থাকে।

সিলেট বিজয়ের ফলে যে ‘শাহজালালের’ মাধ্যমে এই অঞ্চলে ইসলামের বিজয় নিশান উড়েছে সেই ‘শাহজালালের’ ওফাতের পর হঠাৎ করে কেউ তাঁর নামে এমন একটি অনুষ্ঠান শুরু করবে এটা ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য নয়। হয়তো তখন যা সুশৃঙ্খল কুচকাওয়াজ ছিলো এখন তা হাজার মানুষের মিছিল। তখনো কুচকাওয়াজের রীতিতে যে ‘নাকাড়া’ বাজতো এখন তাঁর সাথে যুক্ত হয়েছে ঢোল-ডঙ্কা। তখন সেই কুচকাওয়াজে অংশ নিতো শুধু তাঁর সঙ্গী আউলিয়া ও সৈনিকরা। এখন নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের লাকড়ি সংগ্রহের সুযোগ থাকে এই উৎসবে। পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই উৎসবে পুলিশ বাহিনীর ব্যন্ড পার্টির জাকজমকপূর্ণ অংশ গ্রহণ ছিলো। কোনরূপ প্রচার প্রচারণাবিহীন প্রতি বছর এতো মানুষের সতস্ফুর্ত অংশগ্রহনে এই লাকড়ি তোড়ার (ভাঙ্গার) মেলা’ বা ‘লাক্কাতোড়ার উরস’ প্রাচীন এক লৌকিক উৎসবে সিলেট নগরীর রাজ পথকে বর্ণিল করে তোলে। এই লাকড়ি তোড়ার (ভাঙ্গার) মেলা’ বা ‘লাক্কাতোড়ার উরস’ এ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল শাহজালাল (রহ:)-এর ভক্তদের অংশ গ্রহণ থাকে। এই লৌকিক ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব সিলেটের ঐতিহ্যময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির। তপ্ত দুপুরে প্রখর রৌদ্রের মাঝে ছুটে চলা এ মিছিল যখন লাক্কাতোড়া বাগানের নির্দিষ্ট পাহাড়ে পৌঁছে তখন তৃস্নার্ত ভক্তদের জন্য কুয়া থেকে তুলে আনা ঠান্ডা জল নিয়ে অপেক্ষায় থাকে বাগানের সাঁওতাল-ওড়িয়া ছেলে বুড়োরা।

প্রতি বছর চিরাচরিত প্রথায় পালন করা এ উৎসবের কোনো উদ্বোধক নেই, প্রধান বা বিশেষ অতিথি নেই, মিছিলের সামনে দাড়ানো নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা আম্বরখানা-মজুমদারি-খাসদবির- চৌকিদেখি পাড়ি দিয়ে লাক্কাতোড়া চা বাগানের নির্দিষ্ট পাহাড়ে পৌঁছে প্রথমে অনুষ্ঠিত হয় ফাতেহা-খানি। অতঃপর সবাই যার যার মতো করে সংগ্রহ করে লাকড়ি। সেই লাকড়ি কাঁধে নিয়ে আসর নামাজের পূর্বেই ফিরে আসে দরগা প্রাঙ্গনে। লাকড়ি কাঁধে নিয়ে হাজার হাজার মানুষ যখন রাজপথ ধরে শহরে ফিরতে থাকে তখন দূর থেকে দেখে মনে হয়, অরণ্য বুঝি নগরের দিকে হেঁটে আসছে। দরগায় পৌঁছে এ লাকড়ি প্রথমে দরগা পুকুরে ধুয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় সব জমা করে রাখা হয়। লাকড়ি ভাঙ্গার এই উৎসবের ২১ দিন পর অনুষ্ঠিত হয় হজরত শাহ জালাল (রহ:)-এর পবিত্র উরস শরীফ। এই দিন থেকে উরস শরিফের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে যায়। প্রতিবছর উরসের শিন্নি রান্নায় ব্যবহার করা হয় এই লাকড়ি।

লেখক: বিএ অনার্স (ইতিহাস), এমএ(ইতিহাস), এমসি কলেজ, সিলেট।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন