Sylhet View 24 PRINT

পিতার কবরে পুত্রের প্রার্থনা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৮-২২ ০০:৩৮:৪৮

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম :: ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক। রাত পোহালেই খুশির ঈদ। ঈদুল আজহা শুধু আনন্দের নয়, এ ঈদ ত্যাগ ও জিঘাংসা থেকে মুক্তির। মুসলমানরা লাখো কোটি পশু কোরবানি করবে। পশুর রক্তে দুনিয়ার মাটি লাল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। কিন্তু কোরবানির মর্ম— অন্তরের জিঘাংসা কোরবানি করে কজন পূতপবিত্র হতে পারবে? দয়াময় প্রভুর প্রতি, রব্বুল আলামিনের প্রতি কজন সর্বস্ব উৎসর্গ করতে পারবে সে শুধু দয়াময় জগৎ স্রষ্টা আল্লাহই জানেন। তবু কামনা করি দেশের জনসাধারণ ঈদের খুশিতে অবগাহন করুক, তাদের অন্তরের পশুকে চিরতরে বিদায় দিয়ে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতো পূতপবিত্র হোক। আগস্ট আমার জীবনের এক মর্মন্তুদ বেদনা ও নিরন্তর রক্তক্ষরণের মাস। কবি কাজী নজরুলের ‘সকাল বেলার আমির রে ভাই, ফকির সন্ধ্যাবেলা’ যথাযথ হতো ‘সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা’র জায়গায়- ‘সন্ধ্যাবেলার আমির রে ভাই ফকির সকালবেলা’ হলে আমার জীবনের চরম সত্য বলে বিবেচিত হতো। ’৭৫-এর ১৪ আগস্ট রাতেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ১৪ কেন বলব, ১৪ তারিখ রাত ১টা ৪০ মিনিটে তার কাছ থেকে এসেছিলাম। সে তো ১৫ তারিখই বলা চলে। মুয়াজ্জিন মুসলিম জাহানকে ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ বলে যখন ঘুম থেকে জাগাচ্ছিলেন তখন পিতার প্রাণহীন দেহ ৩২-এর সিঁড়িতে পড়েছিল। যাঁর জন্য কোটি মানুষ আল্লাহর কাছে দোয়া করেছে, যাঁর জীবন ভিক্ষা চেয়েছে, যাকে পাকিস্তানিরা হত্যা করতে পারেনি তাঁকে দেশীয় কিছু কুলাঙ্গার সপরিবারে এমন নির্দয়ভাবে হত্যা করতে পারে, যার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। নেতা ও পিতার মৃত্যু সমস্ত দেশ-জাতিকে এতিম করে দিয়েছিল। দেশবাসীর সঙ্গে আমি ও আমার পরিবার নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলাম। আজ আমাকে নিয়ে, আমাদের নিয়ে যেসব অমানবিক খেলা হয় বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে অথবা তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হলে এসবের কিছুই হতো না। কেউ এমন কিছু করার সাহস পেত না। মাঝে মাঝে ভাবী, কেন অন্যদের মতো করে জীবনকে নিতে পারলাম না। এক অন্ধ ভালোবাসায় আমার জীবন অপূর্ণই থেকে গেল। নেতাকে পেয়ে পিতাকে পেয়ে দেশপ্রেমে মজেছিলাম। যে প্রেম ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু উপলব্ধি করা যায় সেই প্রেমে মজে জীবন পাত করে গেলাম। সন্তান-সন্ততিদের কোথায় রেখে যাচ্ছি, কী করবে তারা, কেমন থাকবে, তাদের জন্য এই মাতৃভূমি নিরাপদ হবে, না নিরাপত্তাহীনতায় জীবন কাটাবে— দৃঢ়ভাবে কিছুই বলতে পারি না। সেদিন বসেছিলাম, কিছু সময় হাতে কোনো কাজ ছিল না। আমার ছোট মেয়ে কুশি সারা দিন মোবাইল নিয়ে টিপাটিপি করে। তাকে মা ছাড়া কিছু ভাবী না, তাই জোর দিয়ে কিছু বলতেও পারি না। ওকে দেখে দেখে আমারও অভ্যাস হতে চলেছে কিনা জানি না, আমিও ট্যাব নিয়ে টিপাটিপি করছিলাম। ভালোমন্দ অনেক কিছুই তাতে আছে। হঠাৎ ইউটিউবে হাসানুল হক ইনুর এক সাক্ষাৎকার দেখলাম। যেটা তিনি বিলাতের চ্যানেল ফোরকে দিয়েছিলেন। কত বছর আগের কথা শুনলে গা জ্বলে ওঠে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এমন নির্মম মিথ্যাচার এমন নগ্ন গালাগালির পরও তারা বঙ্গবন্ধুর কন্যার মন্ত্রিসভার সম্মানিত সদস্য। নীরব থাকার চেষ্টা করি, ভুলে যেতে চাই অতীত গৌরব-ত্যাগ-তিতিক্ষা। এই স্বাধীনতায় আমিও যে রক্ত ঝরিয়েছি। রাজধানীর বাইরে একমাত্র আমার হাত থেকে হানাদারদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া অস্ত্র নিতে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন। আমি ইচ্ছা করলে মুক্তিযুদ্ধের সেই অস্ত্র হাতে বা কাঁধে দিতে পারতাম। তার মাথায় দিলেও না করতেন না। বরং খুশিই হতেন। কোনো ভূত-ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে তার এক কথায় সব অস্ত্র দিয়ে দিয়েছিলাম। প্যারেড কমান্ডার জাহাজমারা মেজর হাবীব, কাদেরিয়া বাহিনীর অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমের হাতে আমার প্রথম ব্যবহৃত পুলিশের ব্যাটাগানটি প্রতীক হিসেবে তুলে দিলে সেটা দুই হাতে বুকের সামনে মেলে ধরে মেরুদণ্ড সোজা করে কয়েক পা এগিয়ে আমার হাতে দেন। অস্ত্রটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি নিচে বসে নেতার পায়ের সামনে বিছিয়ে দিয়েছিলাম। এক মুহূর্ত আগেও তিনি ভাবতে পারেননি কাদেরিয়া বাহিনীর কাছ থেকে ওইভাবে তাকে অস্ত্র নিতে হবে। কয়েক মুহূর্ত আগে টাঙ্গাইল শিবনাথ হাই স্কুল মাঠে তাকে যে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছিল সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি ‘আপনি’ সম্বোধন করে বক্তৃতা করেছিলেন। বক্তৃতা শেষে বলেছিলাম, আলাদা আলাদা আমিও দু-চার জনকে ‘আপনি’ সম্বোধন করি। কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে তাদের কখনো ‘আপনি’ বলি না, ‘তুমি’ সম্বোধন করি। আপনি নেতার নেতা জাতির পিতা, আপনি ‘আপনি’ বললে আমাদের মর্যাদা থাকে? মনে হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, এই উপমহাদেশে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধুর মতো দক্ষ নেতা দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। কত আর হবে ২০-২৫ মিনিট আগে কাদেরিয়া বাহিনীর হাজার যোদ্ধাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করেছিলেন। সেই নেতা এবং পিতা তার পায়ের কাছ থেকে অস্ত্র তুলে আমাকে দুকথা বলতে বলেছিলেন। আমাকে কিছু বলতে হবে সে রকম ইচ্ছা ছিল না। আমার যা বলার পার্কে বলতে চেয়েছিলাম। তাই আমি যখন কিছু বলতে নেতার সামনে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়েছিলাম তখন তিনি বলেছিলেন, ‘তুই বল’। নেতার হুকুম কোনো দিন ফেলিনি, সেদিনও না। দু-চার কথা বলে নেতাকে মাইক্রোফোন দিলে তিনি বলেছিলেন, ‘টাঙ্গাইলের মানুষ টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধারা যা করেছে বিশ্বের ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। আমার ৩০০ বছরের পুরনো বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় যাইনি। আমি টাঙ্গাইলের মানুষকে সম্মান জানাতে, কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধাদের সম্মান জানাতে, কাদেরকে সম্মান জানাতে সবার আগে টাঙ্গাইলে এসেছি। তোমরা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছ তা কেউ ভুলতে পারবে না। তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তোমাদের নেতা তোমাদের কমান্ডার কাদেরকে আমি মায়ের পেট থেকে পড়তে দেখেছি। আমি সরকারি কর্মচারীদের কথা শুনব না, তোমরা যা বলবা আমি তাই শুনব। আমি তিন বছর তোমাদের কিছু দিতে পারব না। আরও তিন বছর যুদ্ধ হলে তোমরা যুদ্ধ করতা না?’ হাজার হাজার কাদেরিয়া বাহিনী ও লাখো জনতা গগনবিদারী আওয়াজ তোলে ‘করতাম করতাম’। পিতা আবার বললেন, ‘মনে কর যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধ দেশ গড়ার যুদ্ধ।’



আজ কত কথা মনে পড়ে। ’৭১-এ কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধাদের এখন তালিকা করে যারা অনেকে মুক্তিযুদ্ধই জানে না। ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামে যারা জীবন দিয়েছে আহত হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের কোনো খবর নেই বরং প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নানা জন নানা কৌশলে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ৭ নভেম্বর ট্যাংকের ওপর যারা নাচানাচি করেছে, যারা চামড়া ছুলেছে, হাড্ডি দিয়ে ডুগডুগি বাজিয়েছে তারা কত নিরাপদ, কত সম্মানে। আর আমি, আমার পরিবার কত অবহেলিত-নির্যাতিত। আগস্ট আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে দিয়েছে। আত্মার জ্বলন যে কত কঠিন যে জ্বলে পুড়ে ছারখার না হয় সে বুঝতে পারে না। কতবার কতজনকে বলেছি যত্রতত্র বিয়ের আসরে, নাচানাচিতে কিংবা কুলখানিতে ৭ মার্চের ভাষণ বাজাবেন না। কে কার কথা শোনে। ১৫ আগস্ট বিকাল ৪টায় ধানমন্ডির ৩২-এর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ৪টা থেকে ৫টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত সিঁড়ির নিচে বসে বসে নফল নামাজ পড়ছিলাম আর আল্লাহকে ডাকছিলাম। ছেলেমেয়ে সহকর্মীরা বাইরে ছিল। একসময় গলা শুকিয়ে এলে স্ত্রীকে পানি আনতে বলেছিলাম। একটু পরে এক চমৎকার গ্লাসে আলমগীর পানি এনেছিল। অভ্যাসমতো জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভালো পানি তো? সে বলেছিল, হ্যাঁ বোতলের পানি। ৩-৪ ঢোক গিলেছিলাম বা পান করেছিলাম। পানিটা মিনারেল ছিল না। কারণ আজ প্রায় ৪৬ বছর কাঁচা পানি পান করতে পারি না। ৪টায় বসে কখন পৌনে ৬টা বেজেছিল জানি না। বাইরে মহিলা আওয়ামী লীগের মিলাদের মাঝামাঝি সম্বিত ফিরেছিল। এর মধ্যে কখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসেছেন, পাশের ঘর থেকে আমার দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে মিলাদের আসরে তার পাশে বসিয়েছেন কিছুই বুঝতে পারিনি। পৌনে ৬টায় উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো অনেক হয়েছে। আসরের চার রাকাত ফরজসহ ৩৮-৪০ রাকাত নফল পড়া শেষ হয়েছিল, পেটেও কিছুটা জ্বালা করছিল। তাই ৩২-এর পেছনে জাদুঘরের ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আবার অজু করে বাইরে বেরোলেই পুরুষদের আসরে নিয়ে বসিয়েছিল। ১৫ তারিখ আমার হুঁশ থাকে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি সেক্রেটারি মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন নিয়ে তার পাশে বসিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুতুলের স্বামী খন্দকার মাশরুর হোসেন উঠে এসে ‘মামা কেমন আছেন’ বলে হাত মিলিয়েছিল। আমার তেমন বোধ ছিল না। রেহানার ছেলে ববি বাচ্চা কোলে বসে ছিল। আমার দীপ এমনিতেই লাজুক স্বভাবের। সে অন্যদের সঙ্গে দরজার পাশে ছিল। কেন যেন কাছে ডেকেছিলাম। একসময় নজিবকে দেখি। সে আমাকে নিয়ে যতটা ব্যস্ত ছিল তার চাইতে অনেক বেশি ছিল ক্লাবের কাদেরকে নিয়ে। কিন্তু নজিব আগাগোড়াই যেমন সেদিনও তেমন আন্তরিক ছিল। ওর মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। ভালো লেখাপড়া জানলে দেশের অনেক কল্যাণ করতে পারত। বামে বসা মিলিটারি সেক্রেটারি বলছিলেন, ‘আপনার চিঠি পেয়েছি সব জায়গায় বলে দিয়েছি। কাল টুঙ্গিপাড়া যাবেন সেখানেও সবাইকে বলা আছে।’ কিন্তু ২৭ নম্বরের দিক থেকে ৩২-এ যাওয়ার পথে এসএসএফরা আমায় থামিয়েছিল। যেখানে সাধারণ যাত্রীরা গাড়ি থেকে নামছিল সেখানে তারা আমাকেও থামিয়েছিল। তাকে বলেছিলাম, ছেলেমেয়ে স্ত্রী আছে গেট পর্যন্ত গাড়িতেই যেতে চাই। তিনি কাকে কাকে জিজ্ঞাসা করে বললেন, আচ্ছা যান। এ কথাটাই একটু আগে যদি জিজ্ঞাসা করে রাখতেন আমার কি ভালোই না লাগত। বাড়ির সব পুরনো লোক আমায় অসম্ভব ভালোবাসে বুক উজাড় করা ভালোবাসা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যেসব এসএসএফের লোকজন ছিল তারাও চমৎকার। কর্মীদের তারা বলেছিলেন, ‘স্যার নামাজ পড়ছেন পড়ুন। আপনারা একটু পাশের ঘরে বসুন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদিক দিয়েই যাবেন।’ সত্যিই তিনি কখন আমার পেছন দিয়ে গেছেন কিছুই বুঝতে পারিনি। মিলাদ শেষে চলে আসছিলাম। স্ত্রী এবং মেয়েরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে চলে এসেছিল। মিলিটারি সেক্রেটারি ছুটে এসে বললেন, ‘স্যার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ডাকছেন।’ শুধু মেয়েদের মাঝে যেতে বাধোবাধো লাগছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার কাছে মেয়ে নন, তিনি আমার কাছে বোন, আমার কাছে মা। সামনাসামনি দেখে মুখটা অত উজ্জ্বল মনে হলো না। সাধারণ দু-একটি কথা বলে চলে এসেছিলাম। পরদিন ছেলেমেয়ে নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার কলিজা কুশিমণির বেশ কয়েকদিন স্কুল নষ্ট হয়েছে। তার পরীক্ষা। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ভাবগতি বুঝি না। তাই কোনোক্রমেই তার যাওয়া হবে না। তাকে স্কুলে নিয়ে যায় দীপ। সে না গেলে দীপেরও যাওয়া হবে না। স্কুল থেকে ফিরে সারা দিন কী নিয়ে থাকবে তাই সাথী হিসেবে বোনকে লাগবে। তাই দীপ-কুঁড়ি-কুশি কেউ যায়নি। আমরা বুড়াবুড়ি সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে মোহাম্মদপুর থেকে বেরিয়েছিলাম। মাওয়া পর্যন্ত যানজটের কারণে কোথাও দাঁড়াতে হয়নি। কিন্তু সে কি বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বিদেশি ঋণের টাকায় আমরা প্রজেক্ট করি। বিদেশিরা তাদের মতো করে প্রজেক্ট প্রাক্কলন করে। যেখানে যা প্রয়োজন নেই তাও করে। কারণ যত বিশাল প্রজেক্ট কমিশন তত বেশি। ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত এই প্রজেক্ট পুরোটাই সেতুর ওপর হলেই ভালো হতো, সেটাই সুন্দর হতো। ১০০-২০০ গজ পরপর সে কি বিশাল বিশাল উড়াল পুল কল্পনাও করা যায় না। যানজটহীন মাওয়া পৌঁছতে দুই ঘণ্টা লেগেছিল। যেখানে আগে যেতাম ৫০ মিনিটে। রাস্তায় কোনো যানজট ছিল না। ১টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর কবরে গিয়েছিলাম। বৈকুণ্ঠ ছিল, ছিল আক্কাছ। শুনলাম নির্মলও ছিল। বৈকুণ্ঠ আক্কাছরা থাকে নিচতলায়। নির্মল দোতলায়। সে আর দোতলা থেকে নিচতলায় নামেনি। বেগম ড্রয়িংরুমে বসেছিল। আমি অজু করে জোহরের নামাজ পড়ে বেগমকে নিয়ে কবর জিয়ারত করছিলাম। নানা কথা চিন্তা করে নিজের জীবনের কথা চিন্তা করে বুক ফেটে যাচ্ছিল। ’৭১-এর ১৬ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে ধলাপাড়ার মাকরাইয়ে আমার হাতে-পায়ে গুলি লেগেছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি। ১৪ আগস্ট আমার স্ত্রী নাসরীনের জন্মদিন। দিনগুলো কীভাবে সুতায় বাঁধা। মোনাজাত শেষে একাই বঙ্গবন্ধুর কবরে পায়ের দিকে বসে দোয়া-দরুদ পড়ছিলাম। দোয়া শেষে উঠে আসছিলাম কবরের নির্মাণ নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগছিল। কবরের ফ্লোরে কালো টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে। কেন যেন মনে হচ্ছিল কবরটা কালো পাথর দিয়ে ঘিরে নিচে সাদা পাথর দেওয়া যেত। কোনোক্রমেই স্মৃতিসৌধে সিরামিকের টাইলস ব্যবহার করার কোনো যুক্তি নেই। যখন আমি বেরিয়ে আসছিলাম তখন আরও প্রশ্ন জেগেছিল, কবর দেখাশোনা, ধোয়ামোছা করার কোনো স্থায়ী লোক নেই। একদিন আগে মৃত্যুবার্ষিকী গেল কবরটি সে রকম পয়পরিষ্কার নেই। একটা ছেলে গোপালগঞ্জের আলভী রাতদিন কবর ধোয়াামোছা করে, স্মৃতিসৌধের ধোয়ামোছা করে। কিন্তু তারা নিয়মিত নয়। সরকার কত কিছু করে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কবর দেখাশোনার পূর্ত বিভাগের নিয়মিত কর্মচারী নিয়োগ করতে পারে না। ছেলেগুলো প্রায় ৮-১০ বছর অনিয়মিত হিসেবে কাজ করছে। যেমন কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের তালিকাভুক্তি হয় না। জিয়া-এরশাদের সময় হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলাম বলে কাদেরিয়া বাহিনী বললেই গ্রেফতার। এখন হয় না সরকারবিরোধী বলে। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধসংগ্রামীদের খবর নেই, টুঙ্গিপাড়ার আলভী-আক্কাছের কি খবর হবে? বড় বিচিত্র ব্যাপার! প্রয়োজন মুহূর্তে আমরা প্রয়োজনীয় কাজ করি না— এটাই আমাদের স্বভাব।

ফেরার পথে গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউসে গিয়েছিলাম দুপুরের খাবার খেতে। এখন কোনো সার্কিট হাউস আর স্বাধীনতার পরের অবস্থায় নেই। এখন সব সার্কিট হাউসই প্রায় ফাইভ স্টার হোটেলের মতো। ভিআইপি রুমগুলো ফাইভ স্টার হোটেলের রুমের সঙ্গে তুলনা করা চলে। সেদিক থেকে কারও কোনো অভিযোগ করার সুযোগ নেই। তা ছাড়া আমি এমনিতেই মাটির কাছের মানুষ। বরং বেশি ঠাটবাটই আমার খারাপ লাগে। বেলা তখন আড়াইটা। টেবিলে খাবার দেওয়া ছিল। কিন্তু খাবার ঠিক ছিল না। মাংস, করলা ভাজি, ডাল। পরে শুনলাম মসলায় চেরাবেরা করা সামান্য জিওল মাছের তরকারি আছে। আমি মাংস খাই না, করলাতে বাচ্চা চিংড়ি দেওয়ায় সেটাও ছিল আমার জন্য বিষ। ডাল আর জিওল মাছ খেতে বসে জিওল মাছ কোনটা আর মসলা কোনটা আলাদা করতে পারছিলাম না। বেশ খারাপই লাগছিল। মোটেই খেতে পারিনি। গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউসের রান্নাবান্না সব সময় ভালো। নব্বইয়ের দশকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী পালনে বিএনপির আমলেও সার্কিট হাউসের অসম্ভব সহযোগিতা পাওয়া যেত। এবার যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব বলেছিলেন, ‘কোনো অসুবিধা হবে না। আপনার যাওয়ার কথা সবাইকে বলে দেওয়া আছে।’ বলে দেওয়া ছাড়াই গত বছর টুঙ্গিপাড়ায় ইউএনও, ওসি আরও অনেককে পেয়েছিলাম। গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউসে ডিসি, এনডিসি ছাড়াও বেশ কয়েকজন ছিলেন। এবার বলে দেওয়ার কল্যাণেই কিনা কাউকে পাইনি। বেগম নাসরীন সিদ্দিকীর বান্ধবী মুকসুদপুর বনগ্রামের রেণুদের বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকায় তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে ওঠায় খাবার বিল দেওয়ার কথা মনে পড়েনি। মনে না পড়ার আরও কারণ ছিল আগস্ট মাস টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সেবকের আবার সরকারি অতিথিশালায় খাবার বিল? গ্রামেগঞ্জে কারও বাড়িতে পিপাসায় পানি চাইলেও শুধু পানি দেয় না। সঙ্গে কিছু না কিছু হাতে দিয়ে পানি দেয়। তেমনি আর কি। গাড়িতে উঠতে উঠতে কে যেন বলছিল, খাবার বিল ১৯৫০ টাকা। লোক ছিলাম ছয়জন। সার্কিট হাউসে প্রতিজন খাবার দেড়-দুই শ টাকার একটা বিল আছে। যেহেতু টাকা দিয়ে আসা হয়নি তাই ডিসির নামে ১৯৫০ টাকা মানি অর্ডার করে পাঠিয়েছি। সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। সহধর্মিণী তার বান্ধবীর বাড়ি বনগ্রামে আনন্দময় সময় কাটিয়ে ঢাকার পথে রওনা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ৯টা সাড়ে ৯টায় বাড়ি পৌঁছে যাব। তা আর হয়নি। নয়ারহাট থেকে ঢাকা পর্যন্ত হেঁটে এলেও আগে আসা যেত। অনেক কষ্ট-যন্ত্রণার পর রাত ১টায় বাড়ি ফিরেছিলাম। তবু মনে কোনো কষ্ট ছিল না। কারণ টুঙ্গিপাড়ায় পিতার কবরে ফাতেহা পাঠ করেছি। দোয়া করেছি, আল্লাহ যেন তাঁকে তাঁর পরিবার-পরিজনসহ বেহেশতবাসী করেন।

লেখক : রাজনীতিক

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.