আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন ‘বুর্জ খলিফা’র অজানা ইতিহাস

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১০-০২ ২০:৪৮:০৩

জসিম উদ্দিন, দুবাই থেকে ফিরে :: কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়– বিশ্বের সবচেয়ে উচু ভবনের নাম কি? বিশ্বে কোন ভবনটি ৯৫ কি.মি. দূর থেকে দেখা যায়? নিঃসন্দেহে সবাই এক বাক্যে বলে উঠবে ‘বুর্জ খলিফা’ টাওয়ারের নাম। আসলেই তাই! উচ্চতায় বিশ্বের সমস্ত স্থাপনাকে ছাড়িয়ে গেছে বুর্জ খলিফা। দুবাইয়ে অবস্থিত বুর্জ খলিফার নাম সবার জানা থাকলেও, আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা জানেন না- এই স্থাপনা সৃষ্টির সাথে জড়িয়ে আছে নানান চমকপ্রদ ঘটনা। আজ এখানে বুর্জ খলিফা নির্মাণের সেসব ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

‘বুর্জ খলিফা’ আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ ‘খলিফার টাওয়ার’। দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম ভবনটির উদ্বোধন করেন। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সম্মানে ভবনটির নামকরণ করেন বুর্জ খলিফা। আরব আমিরাতের দুবাই শহরে অবস্থিত ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি এই ভবনটি উদ্বোধন করা হয়। নির্মানাধীন সময়ে এই ভবনটিকে সবাই ‘বুর্জ দুবাই’ নামে চিনলেও উদ্বোধনের সময় নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বুর্জ খলিফা’। এই ভবনটির আরেক নাম ‘দুবাই টাওয়ার’।  

বিশ্বের সর্বোচ্চ এই ভবনটি তৈরি করতে যে পরিমাণ গ্লাস ও স্টিল ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো একসাথে রাখতে ১৭টি স্টেডিয়ামের সমান জায়গা প্রয়োজন হবে। ভবনটি তৈরি করতে যে পরিমাণ ইট-বালি-সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে তা দিয়ে ১২৮৩ মাইল লম্বা দেয়াল তৈরি করা যাবে।

আশ্চর্যের শেষ এখানেই  নয়। রকেটের মতো দেখতে ১৬৫ তলাবিশিষ্ট ‘বুর্জ খলিফা’র মোট উচ্চতা ২,৭১৭ ফুট। ছয় লাখ বর্গফুটবিশিষ্ট এই ভবনে একসঙ্গে ১২ হাজারেরও বেশি লোকের সমাবেশ হতে পারে। বুর্জ ভবনে ৫৪টি এলিভেটর বা লিফট আছে। এগুলোর গতি ঘণ্টায় ৬০ মাইল। 

সম্পূর্ণ ভবনটি তৈরি করতে মোট ব্যয় হয় ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ এগার হাজার ছয়শত সত্তর কোটি টাকা। ‘বুর্জ খলিফা’র বাইরের প্রাঙ্গনে দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা রয়েছে। এই ফোয়ারটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় এক হাজার ছয়শত একানব্বই আটত্রিশ লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার কোটি।

‘বুর্জ খলিফা’ ভবনটি তৈরি করতে প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন যাদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক এবং প্রকৌশলীও রয়েছেন। 

বিলাস বহুল এই ভবনের একেকটি কামরা কেনার জন্য বর্গ মিটার প্রতি ক্রেতাদের গুনতে হয়েছে গড়ে ৩৭,৫০০ মার্কিন ডলার। এত উচ্চ মূল্য থাকা স্বত্বেও দুই বছরের মধ্যেই ৯০০ কামরার প্রায় সবকটিই বিক্রি হয়ে গেছে। বুর্জ খলিফায় প্রতি বর্গফুট জায়গার মাসিক ভাড়া অফিস-আদালতের জন্য চার হাজার ডলার বা দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা। 

বুর্জ খলিফায় আমেরিকানদের বসবাসের অগ্রাধিকার বিশেষভাবে লক্ষনীয়। তাদের জন্য এই ভবনের ৯ থেকে ১৬ তলা পর্যন্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া ভবনের ১৯ থেকে ৩৭ তলা এবং ৭৭ থেকে ১০৮ তলায় থাকার ব্যবস্থা আছে। প্রায় ৯০০ অ্যাপার্টমেন্ট আছে ভবনে। ১৫৮ তলায় আছে একটি মসজিদ; ৪৩তম এবং ৭৬তম তলায় আছে দুটি সুইমিং পুল। আরো আছে ১৬০ কক্ষবিশিষ্ট একটি হোটেল। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট অফিস রয়েছে বুর্জ খলিফার বিভিন্ন ফ্লোরে।

বুর্জ খলিফার ১৫৯ তলা পর্যন্ত অনায়াসে যাওয়া সম্ভব হলেও, এর উপরে যেতে হলে আপনাকে অক্সিজেন সাথে নিয়ে যেতে হবে। অনেক উঁচুতে অবস্থান হওয়ার কারনে সেখানে অক্সিজেন পৌছাতে পারে না। ভবনের ১৬০ থেকে ১৬৫ তালা পর্যন্ত কেউ বাস করে না। এই ফ্লোরগুলো কারিগরি কাজের জন্য ব্যবহার হয়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে- বুর্জ খলিফা থেকে সূর্য সবার আগে দেখা যায়! বুর্জ খলিফায় বসবাসরত অধিবাসীরা দিনের শুরুতে সমতলের অধিবাসীদের চেয়ে আগে সূর্য দেখেন এবং দিনের শেষেও সমতলের অধিবাসীদের চেয়ে তারা বেশি সময় সূর্য দেখতে পান। এ জন্য তাদের কাছে দিনের পরিধি অনেক বেশি।

আর একটি চমকপ্রদ তথ্য হলো– বুর্জ খলিফা টাওয়ারটি আত্মহত্যার জন্য রেকর্ড গড়েছে। ভবনটি চালু হওয়ার ১৮ মাস পর জনৈক ব্যক্তি এই অট্টালিকার ১৪৬ তলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। লাফিয়ে পড়ার পর লোকটি ৩৮ তলায় এসে পড়ে নিহত হন। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করার রেকর্ড। এরপরও অনেকেই এই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। ফলে অনেকেই ভবনটিতে অভিশাপ আছে বলে মনে করেন।

ভবনের বাইরে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বিশাল পার্ক। ভবনটির চারপাশে রয়েছে ৭.৪ একরের অপরূপ সুন্দর উদ্যান আর ৩০ একর আয়তনের কৃত্রিম হ্রদ। বুর্জ খলিফার বাসিন্দাদের জন্য প্রতিদিন ৯,৪৬,০০ লিটার পানির প্রয়োজন পড়ে যা ১০০ কিমি. পরিমান অভ্যন্তরীণ পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রনের জন্য ৩৪ কিমি. এবং জরুরি অগ্নিনিয়ন্ত্রনের জন্য রয়েছে আরও ২১৩ কিমি. পরিমান বিশেষ পাইপ লাইন ব্যবস্থা। বিশাল এই ইমারতটি একসঙ্গে ২৫ হাজার লোকের ভার সইতে পারবে।

প্রিয় পাঠক, আপনার যদি কখনও দুবাইতে যাওয়ার সুযোগ হয়, তাহলে অবশ্যই বুর্জ খলিফা থেকে ঘুরে আসার চেষ্টা করবেন। তবে আপনি কিন্তু চাইলেই এই ভবনে যখন খুশি ঘুরতে যেতে পারবেন না! স্বশরীরে ভবনের ভেতরে যেতে হলে খরচ করতে হবে পকেটের টাকা। ১৬০ তলা ভবনের মধ্যে প্রায় এক শ’ তলায় যেতে টিকেট নেয় ২শ’ দিরহাম, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। আর ১৬০ তলায় যেতে হলে অনুমতি নিয়ে আরও অনেক বেশি দিরহাম গুনতে হয়। তাই ভবনে প্রবেশের আগে পকেটে পয়সা আছে কি না দেখে নিবেন।

সিলেটভিউ/২ অক্টোবর ২০১৮/জেইউ/পিডি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন