Sylhet View 24 PRINT

সৌদি আরবে ‘অতিরিক্ত কাজের’ সুযোগ নেই

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১০-২০ ১৫:১৫:০৮

সিলেটভিউ ডেস্ক::  সৌদি আরবে এক সময় আকামার (কাজের অনুমতিপত্র) বাইরে কাজ করার সুযোগ ছিল প্রবাসীদের। তবে দেশটির সরকারের ‘সৌদিকরণ’ (১২ পেশায় প্রবাসীদের কাজ নিষিদ্ধ) ঘোষণার পর থেকে এখন এই সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ঘোষণার আগেও আকামার বাইরে অতিরিক্ত কাজ করা রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈধ হলেও এই বিষয়ে কোনও প্রকার কড়াকড়ি আরোপ করা হতো না। তবে ১২টি পেশায় কাজ নিষিদ্ধ করায় প্রবাসী শ্রমিকরা পড়েছেন বিপদে। এসব পেশায় তারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছিলেন। অন্য পেশায় কাজ করায় সৌদি সরকার তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। এদের একটি বড় অংশ তথাকথিত ‘ফ্রি ভিসা’ তে সে দেশে গেছেন।

জানা গেছে, আগে সৌদির নাগরিকরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করতো নিজেদের জীবনযাপনে, কিন্তু এখন সেই অবস্থা আর নেই। কারণ দেশটির বেশিরভাগ নাগরিকেরই অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা চলছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন অন্য দেশের নাগরিকরাও। মূলত স্পন্সরের কাজের কথা বলে যারা বাইরে কাজ করছেন তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সৌদি আরবে সরকার ১২টি পেশায় প্রবাসীদের কাজ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এসব ক্ষেত্রে কেবলমাত্র সৌদি আরবের নাগরিকরা কাজ করতে পারবে। প্রবাসীদের জন্য নিষিদ্ধ কর্মক্ষেত্রগুলো হলো ঘড়ি, চশমা,ওষুধ,বৈদ্যুতিক ও ইলেক্ট্রনিক, প্রাইভেটকারের খুচরা যন্ত্রাংশ, ভবন নির্মাণের উপাদান, কার্পেট, অটোমোবাইল, ফার্নিচার, প্রস্তুতকৃত তৈরি পোশাক, শিশু ও পুরুষদের পোশাক, চকলেট ও মিষ্টির দোকান।

এসব কর্মক্ষেত্রের একটি বড় অংশ পরিচালিত হতো প্রবাসী শ্রমিকদের দিয়ে, যার মধ্যে বাংলাদেশি এবং ভারতের নাগরিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে গণহারে দেশে ফেরা শুরু করেছে পুরুষ শ্রমিকরা। তাদের মধ্যে অনেকেরই আকামার মেয়াদ ছিল, আবার কারও আকামা ছিল না। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের কেউ কেউ বাইরে অতিরিক্ত আয় হিসেবে কোনও কোনও শপিং মলের সামনে গাড়ি পরিষ্কারের কাজ করতেন। প্রবাসীদের এই ধরনের কাজ সে দেশে অবৈধ বলে গণ্য করা হয়। তাই পুলিশের চোখে পড়লে তাদের ধরে নিয়ে যায় এবং দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য ডিপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়।

সৌদি ফেরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা স্পন্সরের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজ করতেন। স্পন্সরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে প্রবাসী শ্রমিকরা প্রতি মাসে স্পন্সরকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতো। এক্ষেত্রে আকামা করার প্রয়োজন হলেও শ্রমিকের নিজস্ব টাকায় স্পন্সর আকামা করে দিতেন। সম্প্রতি আকামার নবায়ন ফি বেড়ে যাওয়ায় ফ্রি ভিসায় কাজ করা কর্মীদের সেই টাকা জোগাড়ে অতিরিক্ত কাজ করতে হচ্ছে বাইরে।

জামালপুরের তারা মিয়া প্রায় আড়াই বছর আগে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ক্লিনারের কাজ করতেন। কিন্তু দেশে ফিরে তিনি বলছেন – সৌদি আরবে এখন কোনও কাজ নাই। তারা মিয়া  বলেন, ‘৯ লাখ টাকা খরচ করে গিয়েছি, প্রায় ৮ লাখ টাকার মতো উঠাতে পেরেছি। সৌদি আরবে কাজ নেই কোনও, তাই পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে দেশে চলে এসেছি।’ 

তবে তারা মিয়ার মতো ভাগ্য সবার হয়নি। সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা বেশির ভাগ পুরুষ শ্রমিকের কারও হাতে কোনও ব্যাগই দেখা যায়নি। এমনকি কোমরের বেল্টও পরার সুযোগ পায়নি কয়েকজন। তাদের ভাষ্য- মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময়ও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ কারও কথা শুনছে না। আকামা থাকা সত্ত্বেও ধরে ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

ভোলার আলাউদ্দিন বলেন, ‘পুলিশের কাছে ধরা পড়লে ২০ হাজার রিয়াল জরিমানা করে মামলা দেয়, যার কারণে কফিল (নিয়োগ কর্তা) দায়-দায়িত্ব নিতে চায় না।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মোরশেদ আলম ১৪ বছর ধরে থাকছেন সৌদি আরব। তিনিও বুধবার দেশে ফিরেছেন। সৌদি আরবে কাজ নেই উল্লেখ করে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘গণহারে ধরপাকড় হচ্ছে সৌদিতে, কোনও বাছবিচার নাই। দেশে ফেরার অপেক্ষায় জেলে এখনও অনেকে আছে। আমি নিজে তিন মাস জেলে ছিলাম।’

 সৌদি আরব থেকে এভাবেই ফিরে আসছেন পুরুষ শ্রমিকরা। সর্বশেষ সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন আরও ৮০ জন পুরুষ শ্রমিক। বুধবার (১৭ অক্টোবর) দুপুরে সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তারা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, তারা সবাই সৌদি আরবের দাম্মামের ডিপোর্ট সেন্টারে (সফর জেলে) দেশে ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। এ নিয়ে এ মাসে দেশে ফিরলেন ৫৫৮ জন পুরুষ শ্রমিক। এর আগে ১০ অক্টোবর ১০৭ জন, ৭ অক্টোবর ১১০ জন, ৫ অক্টোবর ১১৭ জন এবং ৩ অক্টোবর ১৪৪ জন পুরুষ শ্রমিক দেশে ফেরেন। তবে এর বাইরে আরও কয়েকটি ফ্লাইটে সৌদি আরব থেকে পুরুষ শ্রমিকদের ফেরত আসার খবর বিভিন্ন অসমর্থিত মাধ্যম থেকে জানা গেছে।

সৌদি আরবে অবস্থানরত কয়েকজন প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সৌদি আরবে ‘সৌদিকরণ’ ঘোষণায় কড়াকড়ি আরোপের পর থেকে যেসব শপিং মল রাত ২টা পর্যন্ত জমজমাট থাকতো সেগুলো এখন রাত ১০টা বাজলেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে সৌদির বিভিন্ন এলাকা রাত ১০টা নাগাদ ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়।

এদিকে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা আকামায় (কাজের অনুমতিপত্র) উল্লেখিত পেশা ও যে কোম্পানি বা মালিকের অধীনে কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট করা আছে সেখানে কাজ করেনি। অন্য স্থানে বা অন্য পেশায় কাজ করায় সৌদি সরকার তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে এবং তাদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। বর্তমানে যেকোনও অভিবাসীকে এসব পেশায় নিয়োজিত পাওয়া গেলে তাদের অবৈধ বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আগে নিষিদ্ধ সবজি বিক্রির দোকানে বাংলাদেশিরা কর্মরত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অবৈধ শ্রমিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সৌদি সরকারের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ।’

তবে ফিরে আসা শ্রমিকদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, দেশের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি এবং দালাল কম বেতন হলেও অতিরিক্ত কাজের সুযোগ আছে বলে তাদের সৌদি আরব পাঠাচ্ছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)। সংগঠনটির মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, ‘শুধু সৌদি আরব না, বিদেশে যেকোনও জায়গায় যে শ্রমিক যে কোম্পানিতে কাজে যাবে তার বাইরে কাজের কোনও সুযোগ নাই। এর বাইরে কাজ করলে সেটা অবৈধ। যদি কেউ কাজ করে সেটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এবং তাকে জেলে যেতে হবে এবং দেশে ফেরত পাঠাবে। এই বার্তাটা পরিষ্কারভাবে সব জায়গায় যাওয়া উচিত, যাতে কেউ কাউকে বোকা না বানাতে পারে। আমরা প্রতিনিয়ত এই বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে বলছি। এছাড়া তাদের ইথিক্যাল (নৈতিক) রিক্রুটিংয়ের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছি।’ তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) আর বায়রা মিলে এই কাজটা শুরু করেছে। গতকাল সারাদিন সেমিনার ছিল, আবার আগামীকাল থেকে দুইদিনের সেমিনার হবে। এখানে তাদের আইন সম্পর্কে বোঝানো হবে, ইথিক্যাল রিক্রুটমেন্ট সম্পর্কে বোঝানো হবে। বর্তমান সিস্টেমটি বোঝানো হবে, কীভাবে রিক্রুটমেন্ট করতে হয় তাও নির্দেশনা দেওয়া হবে। বিদেশ যাওয়ার আগে একজন কর্মীকে কী কী ব্রিফিং দিতে হবে- মোট কথা একটি নিরাপদ অভিবাসনের ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সির যেই দায়িত্বগুলো আছে সেগুলা সম্পর্কে অবহিত করা হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একটা বড় সমস্যা হলো আইন সম্পর্কে স্বল্প ধারণা। অভিবাসন আইনের ব্যাখাও অনেকে জানেন না। তাই আমরা মন্ত্রণালয়, বিএমইটিকে নিয়ে কাজটা করছি। আমরা শুরু করেছি, একদিনে তো সম্ভব না, তবে ধীরে ধীরে হবে আশা করি।’

সিলেটভিউ ২৪ডটকম/ ২০ অক্টোবর ২০১৮/এমএইচআর

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.