Sylhet View 24 PRINT

আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের ‘গেম অব ড্রোনস’

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৯-৩০ ১৯:৩১:১১

সিলেটভিউ ডেস্ক :: আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যের বর্তমান লড়াই প্রায় ত্রিশ বছর ধরে জিইয়ে রাখা সমস্যার ফল। এ লড়াই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আজারবাইজানের ভূমি অবৈধভাবে দখলকারী আর্মেনীয় দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আজারবাইজানীদের অধিকার আদায়ের লড়াই।

নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলের সমস্যা শুরুহয় উসমানীয় সম্রাজ্য পতনের পরে যখন এ অঞ্চলটি ব্রিটিশরা দখল করে নেয়। পরবর্তীতে এ অঞ্চল চলে যায় বলশেভিকদের অধীনে।

একসময় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান– উভয় দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। তারপর আজারবাইজানের ভূসীমার মধ্য থেকে নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলকে আর্মেনীয়দের নেতৃত্বে স্বায়ত্ব শাসন দিয়ে দেয় রাশিয়া। তখন থেকেই আজারবাইজানের বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে নতুন জন্ম নেয়া এই দেশটির তখন বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দেশ দুটি স্বাধীন হয়। আজারবাইজানের তুলনামূলক কম শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রাশিয়ার ইন্ধনে আর্মেনীয়রা ধীরে ধীরে নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলের আসেপাশের বিশাল ভূখণ্ড দখল করে নেয়। এ নিয়ে গত কয়েক দশক ধরে বিরোধে জড়িয়ে আছে দুই প্রতিবেশী।

রোববার বিতর্কিত নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে প্রতিবেশী দেশ আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে নতুন করে লড়াই শুরু হয়েছে। এই সংঘাতের জন্য একে অপরকে দায়ী করছে।

আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দাবি, রোববার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১০ মিনিটের দিকে হামলা চালায় আজারবাইজান। এর জবাবে আর্মেনিয়ার বাহিনী প্রতিপক্ষের দুটি হেলিকপ্টার, তিনটি ড্রোন ভূপাতিত ও তিনটি ট্যাংক ধ্বংস করেছে।

অন্যদিকে আজারবাইজান বলছে, হামলার শিকার হওয়ার পর তারা পাল্টা হামলা চালিয়ে কয়েকটি গ্রাম তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও ২০ জন আর্মেনীয় সৈন্য হত্যা এবং ডজন খানেক ট্যাংক, কিছু ভারী অস্ত্র ধ্বংসের দাবি করেছে বাকু।

কে কোন পক্ষে?

আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যকার এই লড়াই তুরস্ক এবং রাশিয়াকে আরেকবার মুখোমুখী করেছে। পশ্চিমা চাপ ও ভীতি উপেক্ষা করে তুরস্ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাশিয়ার আরো কাছে আসলেও সিরিয়া এবং লিবিয়াতে পরস্পর বিরোধী অবস্থানে আছে আঙ্কারা এবং মস্কো।

তুরস্ক এবারে খুব হাঁকডাক দিয়েই আজারবাইজানের পক্ষ নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান, তার উপদেষ্টারা, তুর্কি সেনাবাহিনী, দেশটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সহ আপামর জনসাধারণ বাকুর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।

আজারবাইজানের সঙ্গে এমনিতেই তুরস্কের জাতিগত মিল এবং ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। তুরস্ক এবং আজারবাইজানকে বলা হয় ‘দুই রাষ্ট্র এক জাতি।’

তুরস্ক এ দেশটিকে প্রকৃতপক্ষেই ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ হিসেবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। এছাড়াও দেশটি এখন তুরস্কে প্রধান গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ।
অন্যদিকে আর্মেনিয়ার সঙ্গে বৈরীতাও ঐতিহাসিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্মেনীয়রা উসমানী সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে উভয় পক্ষের লাখ লাখ লোক মারা যায়। আর্মেনীয় ডিয়াস্পোরা সেই ঘটনাকে পুঁজি করে পশ্চিমা দেশগুলোতে তুরস্কের বিরুদ্ধে তথাকথিত গণহত্যার স্বীকৃতি নিতে সক্ষম হয়েছে। বিষয়টি দুদেশের সম্পর্ককে এতটাই তিক্ত করছে যে আঙ্কারা বারবার চেষ্টা করেও এটিকে মিষ্টি সম্পর্কে উন্নীত করতে পারেনি।

এছাড়াও নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চলের অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে তুরস্ক সবসময়ই সোচ্চার ছিল।

অন্যদিকে রাশিয়া সেই সোভিয়েত আমল থেকেই আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার ওপর খবরদারি করে আসছে। দুইও দেশের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক দহরম মহরম। তবে রাশিয়া সবসময়ই আর্মেনিয়াকে আরো বেশি সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে আসছে।

তুরস্কের গেম অব ড্রোনস

আর্মেনিয়া আর আজারবাইজানের মধ্যে এর আগেও বহুবার যুদ্ধ হয়েছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে মধ্য এশিয়ার আরো অনেক দেশের মতো আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের বহু আগে থেকেই এদের মাঝে নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়।

স্বাধীনতার পরে থেমে থেমে যুদ্ধ চলে প্রায় তিন বছর. এই তিন বছরে অনেকবার সমঝোতার বৈঠকে বসলেও আর্মেনিয়ার একঘেয়েমিতে সব আলোচনা ভেস্তে যায়। এবং তখন থেকে প্রতি যুদ্ধে আর্মেনিয়া আজারবাইজানের একটু একটু করে ভূমি দখল করতে থাকে। এখন শুধু নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চলই না আর্মেনিয়া আজারবাইজানের প্রায় ২০ শতাংশ অঞ্চল দখল করে আছে।

এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ ৪-৫ টি রিসোলিউশন পাশ করেছে। আর্মেনিয়ার দখল অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং দখল করা সকল ভূখণ্ডকে আজারবাইজানের কাছে হস্তান্তর করতে বলেছে। কিন্তু বিশ্বের আরো অনেক মুসলিম জনপদের মতো আজারবাইজানের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত তোয়াক্কা করেনি আর্মেনিয়া।

আজারবাইজানের জন্য এর আগের সকল যুদ্ধ থেকে এবারের যুদ্ধটা একটু আলাদা। তিলে তিলে গড়া সেনাবাহিনী এখন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। তুর্কি সেনাবাহিনীর সিরিয়া এবং লিবিয়াতে সফল অভিজ্ঞতা। এবং তুরস্কের গেম অফ ড্রোনস।

যদিও তুরস্ক বা আজারবাইজানের পক্ষ থেকে কোন দেশের ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কিছু বলা হয়নি। কিন্তু ড্রোন ফুটেজ এবং ড্রোন হামলার ধরণ দেখে বুঝা যায় যে এগুলো তুর্কী ড্রোনেরই কারুকাজ।

সীমান্ত যুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার সাশ্রয়ী এবং কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে। সিরিয়া ও লিবিয়ায় ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়ার ডজন ডজন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে তুরস্ক।

একইভাবে নাগরনো-কারাবাখ পার্বত্য অঞ্চলে ড্রোন হামলায় রাশিয়ার তৈরী প্রায় এক ডজন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং কয়েক ডজন ট্যাংক এবং সাঁজোয়া যান ধ্বংস করেছে। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক জায়গায় আর্মেনিয়ার কাছ থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।

ইউরোপ-আমেরিকা কেন সরাসরি পক্ষ নিচ্ছে না?

পশ্চিমা বিশ্ব এই লড়াই নিয়ে আছে দোটানায়। ইউরোপ এবং আমেরিকাতে আর্মেনীয় লবি অনেক শক্তিশালী; কিন্তু এই যুদ্ধে আর্মেনিয়ার পাশে আছে পশ্চিমা শত্রু রাশিয়া। অন্যদিকে আজারবাইজান একটি মুসলিম দেশ এবং এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন আছে আরেক মুসলিম দেশ তুরস্কের। সুতরাং, আমেরিকা, ইউরোপ বা ন্যাটোর পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো দেশের পক্ষ নিয়ে বিবৃতি না দিয়ে বরং উভয় পক্ষকে সমঝোতায় আসতে বলা হয়েছে। যদিও এই যুদ্ধ নিরসনের আসল চাবিকাঠি তুরস্ক এবং রাশিয়ার হাতে।

কিন্তু তুরস্ক সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, দখলকৃত ভূমি ফেরত না দেয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। রাশিয়া মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে কিন্তু লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে আর্মেনিয়াকে কথা শোনাতে পারছে না। আর আর্মেনিয়া এই যুদ্ধে আজারবাইজানকে নয় বরং তুরস্ককে মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছে। এবং বারবার আংকারাকে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০/ যুগান্তর / জিএসি

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.